………………………………মোঃ আবদুল মান্নান
বিশ্বাস বা জীবনাদর্শের সাথে সামর্থের সম্পর্ক না থাকায় মানুষ কোন না কোন বিশ্বাস তার হৃদয়ে লালন করে এবং জীবন পদ্ধতি ও জীবনাচরণে এর প্রতিফলন ঘটায়। এ প্রতিফলনই হচ্ছে মানুষের সংস্কৃতি বা সেই জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি। পৃথিবীর দুটি রূপ, একটি প্রাকৃতিক অন্যটি মানুষের গড়া রূপ।
সময়ের সাথে সাথে পৃথিবীর শুরু থেকে প্রাকৃতিক রূপের যেমন বিবর্তন এসেছে তেমনিভাবে পরিবর্তন এসেছে মানুষের সভ্যতার রূপেরও। প্রাকৃতিক রূপের রূপকার যিনি, মানুষের গড়া সভ্যতার রূপকারও তিনি। প্রাকৃতিক এ রূপের এবং সভ্যতার বিবর্তন নিয়ে বিভিন্নভাবে গবেষণাও হচ্ছে দেশে দেশে। প্রাকৃতিক রূপের বিবর্তনে মানুষের সম্পৃক্ততা এতটুকু নয়, যতটুকু মানুষের নিজের গড়া কোন জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতিকে বুঝায় এবং যা সেই জনগোষ্ঠীর সার্বিক জীবন যাপন পদ্ধতিকেই পরিচিত করে। এ জীবন পদ্ধতির পিছনে যেমন একদিকে রয়েছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অবদান, তেমনি অন্যদিকে রয়েছে জীবন ও জগৎ সম্পর্কে বিশ্বাস।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং বিশ্বাসের মধ্যে মানুষের কোনটি বেশি প্রবল তা নির্ণয় করলে দেখা যায়, মানুষের হৃদয়ে লালিত বিশ্বাসই সবচেয়ে বেশী প্রবল। হৃদয়ে বিশ্বাসের জন্য মানুষ যেভাবে জীবন উৎসর্গ করে, অন্য কোন অনুভূতির জন্য মানুষকে তা করতে দেখা যায় না। অনেক সময়ে এ বিশ্বাস থেকেই মানুষ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে শাসন করতে চায়। তাই, মানুষের জীবন পদ্ধতি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চেয়ে তার বিশ্বাস বেশি সক্রীয়ভাবে কাজ করে। আর তাই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রভাব পৃথিবীর সব মানুষকে স্পর্শ করে না। কারণ, এ বিষয়ে আর্থিক সামর্থ জড়িয়ে আছে। কিন্তু জীবনার্দশের সাথে আর্থিক সামর্থের সর্ম্পক না থাকায় মানুষ কোন না কোন বিশ্বাস হৃদয়ে লালন করে, যা তার সমস্ত জীবন পদ্ধতিতে প্রতিফলন ঘটায়।
সংস্কৃতির সাথে অপরিহার্যভাবে জড়িয়ে আছে মানুষের জীবনাদর্শের। সংস্কৃতির সাথে সাধারণভাবে সাহিত্য, গান, নাটক, নাচ ইত্যাদির প্রাধান্য থাকে, এ গুলোই হলো সংস্কৃতির বাহন। কেননা সংস্কৃতির উৎসই হলো মানুষের জীবনাদর্শের ভিতরেই যা পরোক্ষভাবে মানুষের জীবনে প্রতিফলিত হয়ে থাকে। পার্থিব জীবন উপভোগ করাকে কেন্দ্র করেই মূলত পাশ্চাত্য সভ্যতার জীবনাদর্শ গড়ে উঠেছে।
অশ্লীল চলচিত্র থেকে শুরু করে জীবনের সর্বক্ষেত্রে ভোগবাদী জীবন পদ্ধতি দেখলেই পশ্চিমা সভ্যতার পরিচয় নিশ্চিত করে বলা যায়। ভোগের তিব্রতা সেখানে এত বেশি যে এর দ্বারা মানুষ পশুকেও হার মানিয়েছে। যেখানে সন্তান ও পিতা-মাতার সম্পর্ক কোথাও কোথাও একাকার হয়ে আছে। জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপকে ভোগের সংজ্ঞায় বিবেচনা করা হয় পশ্চিমা সংস্কৃতিতে। আর এরূপ জীবনাদর্শের মানুষ কোন ভাবেই ভোগবাদী এ সব আচরণ থেকে মুক্ত হতে পারে না।
জীবনাদর্শের পার্থক্যের কারণেই মানুষের মধ্যে সংস্কৃতির পার্থক্য সূচীত হয়। যা ব্যক্তি জীবনের আদর্শের ক্ষেত্রেও দেখা যায়। আর দেশে দেশে তাই সংস্কৃতির পার্থক্য খুব সহজেই খুঁজে পাওয়া যায়। বর্তমানে মুসলমানদের জীবনে প্রতিফলিত সংস্কৃতিকে ইসলামী সংস্কৃতি বলা যায় না। কারণ অনেক মুসলমানই ইসলামী আদর্শ বিশ্বাসের পরিবর্তে পশ্চিমা জীবনাদর্শ ও সংস্কৃতি লালন করছে এবং ইহা এখন ব্যক্তি পর্যায় থেকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে পৌছে গেছে। আসলে সংস্কৃতিই প্রকৃতপক্ষে ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্য মানবিক আচরণের প্রকৃত উৎস। আর ইসলামিক সংস্কৃতিই হলো মানবিক সংস্কৃতি। এ সংস্কৃতিকে মানুষের কাছে প্রকৃতভাবে তুলে ধরতে পারলে মানুষ ইসলামী সংস্কৃতি ছাড়া অন্য কোন সংস্কৃতিকে গ্রহণ করত না।
দুঃখজনক হলেও বলতে হয় বর্তমান প্রেক্ষাপটে মুসলমানরা নিজেরাই তাদের সংস্কৃতি পালন করতে ব্যর্থ। তারা পশ্চিমাদের সেই অমানবিক সংস্কৃতির আগ্রাসনেরই শিকারে পরিণত হয়েছে। মুসলিম দেশগুলোর সংস্কৃতির পরিস্থিতিই এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। অথচ ইসলামী জীবনাদর্শের সাথে মানুষের সম্মান ও মর্যাদার যেভাবে মিল খুঁজে পাওয়া যায় তা অন্যকোন জীবনাদর্শে নেই। তবে জীবনাদর্শকে যুযোপযোগিভাবে উপস্থাপনের কৌশল নির্ধারণ ও ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় আপোষহীন ভূমিকা পালনই কেবল ইসলামী সংস্কৃতিকে প্রকৃত পক্ষে গণ মানুষের সংস্কৃতিতে পরিণত করা সম্ভব। একমাত্র মানবিক সংস্কৃতিই হতে পারে মানুষের সংস্কৃতি। আর ইসলামী সংস্কৃতিই হলো মানবিক সংস্কৃতি। ইসলামী সংস্কৃতির মানুষই পারে মাদক প্রতিরোধ, নারী নির্যাতন, ধর্ষনসহ সকল প্রকার অনাচার থেকে সমাজ ও দেশকে মুক্ত করতে।
তাই ব্যক্তি থেকে সমাজের সর্বত্র ইসলামী জীবনাদর্শের চর্চাকে ছড়িয়ে দিতে হবে, তাহলেই দেশে তথা বিশ্বে মানবিকতা নিশ্চিত হবে। প্রতিষ্ঠিত হবে ইসলামী জীবনাদর্শ ও ইসলামী সংস্কৃতি।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিষ্ট