…………………মাহফুজার রহমান মণ্ডল
সামাজিক দূরত্ব সমাজে কতটুকু দরকার তা পরিমাপ করার আগে আমাদের দেশের সমাজ সম্পর্কে আগে জানা দরকার। প্রাচীন কাল থেকে মানুষ বসবাস করে এসেছে সমাজবদ্ধভাবে। একে অপরের সাথে, সংবদ্ধভাবে যেখানে বসবাস সেখানে আলাদভাবে দেখার প্রশ্নই ওঠে না। সম্পর্কটা বাপ-দাদা দিয়ে গড়ে ওঠে শুরু হয় পরিবার, যেখানেই থাকি না কেন একনজর একে অপরকে না দেখিলে থাকা বড় দায়। আর এই পরিবেশেই বসবাস আপনার ও আমার ভেবে দেখলেই বুঝতে পারবেন।
আদিকাল থেকেই সকাল-সন্ধ্যা অব্দি মাঠে কাজ আর সন্ধ্যা হলে বাজার, বাজার শেষে বাড়ি ফেরা এযেন দৈনান্দিন জীবনের রুটিন, শুরু যে হয়েছে শেষ হতে চায় না। মাঠের বাইরেও কাজ থাকে যেমন ব্যাবসা-বাণিজ্য, পড়া-লেখা, অফিস-আদালত, চাকুরী আরও কতকিছু। তবে কৃষি বাদ দিয়ে যা কিছু করি না কেন সবাই আধুনিক যুগের ছোয়া। কৃষির পাশাপাশি বা বাদ দিয়ে যা করতে যাই না কেন প্রয়োজনের তাগিদে আমাদের করতে হচ্ছে। তাই দিন দিন অনেক কিছুর পরিবর্তন ঘটছে।
জাতি আজ বিবর্তীত হয়ে ভিন্ন ভিন্ন জাতিতে পরিণত হচ্ছে। তাই সৃষ্টি হচ্ছে উন্নত জাতি বা উচ্চ শ্রেণীর জাত ও নিম্ন শ্রেণীর। কিন্তু তাতে কি আসে যায়, গ্রামবাংলায় এগুলো একটু কমই বুঝে কারণ যারা স্বয়ং সংপূর্ণ তারা নিজেকে রাজা-বাদশার চেয় বেশি মনে করে। যাইহোক এখান প্রাধন্য দেওয়া দরকার শিক্ষাকে কথায় আছে “শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড”। তাহলে বুঝা যাচ্ছে শিক্ষাই জাতিকে উন্নত করে। আজ শিক্ষা আরোহনের ফলে মানুষ নিজেকে বদলে ফেলেছে নানান বুদ্ধি খাটিয়ে বিশ্বকে সুন্দর করে সাজিয়েছে।
আজ উন্নত জাতি যেখানে করোনার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত সেখানে আমরা কোন জাতি যে এই ভাইরাস -এর হাত থেকে রক্ষা পাব? আমি বলছি না যে আমরা উন্নত জাতি নই , যদিও চীন থেকে এই নবেল করোনা ভাইরাস -এর উৎপত্তি, চীন থেকে এর কোন সমাধান হবে বলে মনে হয় না। নিজের সমস্যা নিজেকে সমাধান করতে হবে। উন্নত দেশ বা জাতি আজ হাবুডু খাচ্ছে লাশের স্তুপে ভরে গেছে শহরগুলো কোথায় মাটি দিবে জায়গা পর্যন্ত খুঁজে পেতে হিমশিম খাচ্ছে। সবাই আজ আকাশের দিকে তাকিয়ে সৃষ্টি কর্তার অনুগ্রহের পানে চেয়ে আছে।
এ ভাইরাস থেকে রক্ষা পেতে যা প্রয়োজন বা যেভাবে চলা উচিৎ আমাদের তার অভাব আছে বটে কিন্তু অস্বীকার করার উপায় নেই। ইচ্ছা করলেও তা সবাই ম্যানেজ করতে পারবে না। তাহলে উপায়? তাই অতীতকে ভুলে বর্তমান যে অবস্থা তা মেনে নেওয়া ও স্বাস্থ্যবিধি মোতাবেক চলা। তা না করে প্রায় বেশিরভাগ জনগোষ্ঠী উদাসীনতা দেখাচ্ছে। প্রথম যখন সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়, তা ছিল জনসাধারণের জন্য একটি মঙ্গলময় মুহূর্ত। উদ্দেশ্য একটাই করোনা ভাইরাসের হাত থেকে নিজেকে সুরক্ষা করা। তাই প্রয়োজন সামাজিক দুরুত্ব বজায় রাখা। আমরা কি তা করতে পেরেছি? বাস, ট্রাক, ট্রেন, লরি ইত্যাদি যানবহনে যে যেভাবে পেয়েছি ঢাকা ছেড়েছি সাথে আবার বিদেশ ফিরত ভাইয়েরা যোগ দিয়েছে ফলে পাল্লা ভারী হয়েছে। যেদিকে তাকাই মানুষ আর মানুষ দুই তিন দিন ধরে মনে হয় ঈদ-এর ছুটিতে ঈদ করার জন্য নারীর টানে ঘরে ফিরছে। তখনো তাদের সামাজিক দুরুত্ব বজায় রাখার দিকে নজরই ছিল না।
যাইহোক সপ্তাহ জুড়ে বাড়ির পানে ছুটে সবার তৃষ্ণা মিটেছে বটে কিন্তু সরকারের বেঁধে দেওয়া ১৪ দিন হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে ইহা মানছে কয়জন? মহল্লায় মহল্লায় দলবেঁধে আড্ডা, বাজারে ভীড়জমানো, আত্মীয়স্বজনের বাড়ীতে ঘুরতে যাওয়া সবকিছু যথারীতি চলছে। প্রশাসন আছে বটে কিন্তু কতজনকে তারা কন্ট্রোকলে আনবে? আবার এর মধ্যে কেউ কেউ বিয়ে করার ব্যবস্থা করেছেন বা কেউ কেউ করেও ফেলেছে। তবে ধীরে ধীরে প্রশাসনের সহায়তায় কিছুটা কন্ট্রোলে এসেছে। ইতিমধ্যে ঢাকা ও ঢাকার আশেপাশে কিছু জেলায় আক্রান্তের সংখা দিন দিন বেড়েই চলছে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও।
আমাদের দেশ মুলত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ, দলে দলে নামাজের সময় নামজে যাওয়ার প্রবণতা ধরে রাখতে চায়। শহরে কিছুটা শিথিল হলেও গ্রাম পর্যায়ে জামাত বাদ দিতে একেবারেই নারাজ। যেখানে ধর্ম মন্ত্রলায় ঘোষণা দিয়েছে বাড়িতে নামাজ আদায় করতে সেখানে সরকারী হকুমও বিলীন হয়ে যাচ্ছে। তাহলে আমরা কিভাবে বুঝবো যে ইতালি, ইউকে, ইউএসএ, স্পেইন – এর মত অবস্থা আমাদের হবে না। সারাদেশে প্রায় সকল জেলায় কম বেশি আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে।
গার্মেন্টস মালিক গার্মেন্টসগুলো সচল রেখেছেন তাই রবিবার(০৫/০৪/২০২০ইং) থেকে চালু থাকবে কারখানা। নিরুপায় হয়ে শ্রমিকরা ঢাকামুখী হতে শুরু করলো যে যেভাবে পারলো কর্মস্থানে যোগ দেওয়ার জন্য দল বেঁধে ছুটে চললো ফলে সামাজিক দুরুত্ব কোথায় গেল? কে নিবে এর দায়? যদিও তারা বুক ভরা আশা নিয়ে ঢাকা এসেছিলে কর্মস্থলে যোগ দেওয়ার জন্য হয়তো সামনের মাসের বেতন পাবে আবার পূর্বের অবস্থায় কাজে যোগদান করবে কিন্তু ১ম দিনেই বিজিএমইএ সভাপতি ড রুবানা হক ঘোষণা দেন ১১ই এপ্রিল পর্যন্ত কারখানা বন্ধ রাখার। এবার ঢাকায় কষ্ট করে এসে কি লাভ হলো? ঘোষণা শুনে হতভম্ব প্রায় শ্রমিকরা কান্নায় ভেঙ্গে পরলো বেতন পাবে কি না তাও অনিচ্ছিত। এদিকে যানবহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আছে, গ্রামে ফিরে যাওয়ার কল্পনাও করা যাবে না। যাইহোক বেশির ভাগ শ্রমিকরা বেতনটা শেষপর্যন্ত পেয়েছে।
এইতো কয়েকদিন আগে (১৮/০৪/২০২০ইং) নায়েবে আমির মাওলানা জুবায়ের আহমেদ আনসারীর জানাজায় শরিক হওয়ার জন্য ব্রাক্ষণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলায় লক্ষ মানুষ জমায়েত হয়েছিলো । মুসুল্লিরা এসেছিল আশপাশের কয়েকটি জেলা থেকে কিন্তু তাদের কি মনে আছে সামাজিক দুরুত্বের কথা। সেখানে যে আক্রান্ত ব্যক্তি ছিলেন না তার প্রমান কি? এদিকে প্রশাসন নিরুপায় ছিল এত বড় জামায়েত হবে তারা কল্পনাও করতে পারেনি। শেষপর্যন্ত উচ্চপর্যায়ের কিছু কর্মকর্তা প্রত্যাহার হয়েছিলো এবং সরকার সবাইকে ১৪ দিন হোম কোয়ারেন্টাইন মেনে চলার আহ্বান করেন। তবে সরকারের কাজ সরকার করেছে কিন্তু এই জমায়েতে যদি কেউ আক্রান্ত হন এর দায় দায়িত্ব কে নিবে?
“ভাত দে হারামজাদা, নইলে মানচিত্র খাবো” কবি রফিক আজাদ –এর ভাষায় খিদার আর্তনাদ মানুষকে হতাশ করে ফেলেছে। খিদার রাজ্যে পৃথিবী যেখানে গদ্ধময় এখানে মানুষকে ঘড়ে বেঁধে রাখা দায়। তাই সত্যি বলতে বর্তমান সময়ে করোনার কারনে ঘড়ে বন্ধি থাকতে হবে এটা মানুষ কখনও ভাবেনি। যাদেরকে এভাবে ছুটাছুটি করতে দেখেছি তারা হয়তো করোনার ভয় বুঝে কিন্তু নিরুপায় কি করবে সিদ্ধান্ত যে নিজেকে নিতে হয়। সরকার বিভিন্নভাবে চাল, ডাল, আলু, তেল ইত্যাদি পরিবেশন করছেন। সরকারের পাশাপাশি বেসকারি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। তবে সবাইতো আর সেই সাহায্য পাবে না। নিম্ন শ্রেণির মানুষ গুলো এই সাহায্য পাচ্ছে কিন্তু মধ্যবিত্ত পরিবারের অবস্থা কি? তারাতো আর হাত পাত্তে পারে না। যাইহোক পরিকল্পনা মাপিক দেশ পরিচালিত হচ্ছে ঠিকই কিন্তু সমন্বয়ের আরো প্রয়োজন আছে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে ভাতের সমস্যা যেমন সমাধান করা দরকার তেমনি প্রয়োজন করোনার পরিস্থিতি সামাল দেওয়া। তাই আমাদের উচিৎ সামাজিক দুরুত্ব বজায় রেখে চলা, আক্রান্ত বাক্তির সংস্পর্শে না আসা, সন্দেহজনক বাক্তিকে চিহ্নিত করে প্রশাসনের সহায়তা নেওয়া, প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে না যাওয়া। তাহলে এই মরণ ব্যাধির হাত থেকে আমরা রক্ষা পাবো, বাঁচাতে পারবো পরিবারকে আর পরিবার বাঁচলে বাঁচবে সমাজ। সমাজের সমস্থ লোক যদি সবার সমন্বয়ে রক্ষা পায় তাহলে বাঁচবে আমাদের সবুজ ঘেরা সোনার দেশ।
লেখক – কলামিষ্ট, সম্পাদক ও কবি