এই বছরের লকডাউন এমন এক সময় আরাম্ভ হলো যেন ‘তিল থেকে তাল’। যতদূর জানা যায় সংক্রমন ও মৃত্যুর হার প্রায় কমেই এসেছিল আর আগের প্ল্যান অনুযায়ী মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস, স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালন প্রায় শেষ। উক্ত অনুষ্ঠানে যোগদানের জন্য বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র প্রধানগণ এসেছিলেন। সেই সুত্র ধরে দু’দিনের সপরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও বাংলাদেশে আসেন। মোদী আসায় ইসলামী দলগুলো তথা হেফাজতে ইসলাম হরতালের ডাক দেন। শুরু হয় অরাজকতা যেখানে অফিস, ঘরবাড়ি, রাস্তা-ঘাট, পরিবহণ কেউ রেখাই পায়নি সন্ত্রাসীদের হাত থেকে। এদিকে করোনায় সংক্রমন ও মৃত্যুর হার হু হু করে বৃদ্ধি পেতে থাকে। সিদ্ধান্ত আসে ৫ই এপ্রিল থেকে লক ডাউন যেখানে ১৮ দফা নির্দেশনা প্রদান করা হয়।
বিগত বছরের লকডাউনে মানুষের মধ্যে যে একটা আতঙ্ক কাজ করেছিলো তা যেন এবার গুরে বালি। কে শুনে কার কথা চৈত্রী মাসে বান, শুরু হলো নিজের মত চলা। পরিবহন শ্রমিকদের চিন্তা নেই ন্যায্য ভাড়া তারা পেল। শপিংমল ব্যবসায়ীগণ মিছিল-মিটিং করলো খুলে দেওয়া হলো সীমিত সময়ের জন্য ব্যবসা করার সুযোগ। দিন দিন বেড়েই চলছে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা তাই সরকারের মাথায় আসলো এক সপ্তাহের লকডাউন। ঘোষণা হতে না হতেই মানুষ ঢাকা ছাড়ার প্ল্যানে মেতে উঠলো। বিশেষ করে দিনে এনে দিনে খাওয়া মানুষগুলো বা ঘরে বসে থাকা মানুষগুলো গ্রামের পানে ছুটে চললো। কম-বেশি অনেক ঘটনা ঘটেছে তার মধ্যে লক্ষণীয় নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীতে লঞ্চডুবির ঘটনা যেখানে না ফেরার দেশে চলে গেল প্রায় অর্ধ শত প্রাণ।
৯ই এপ্রিল’২১ আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, দেশে করোনা সংক্রমণ ভয়াবহ রূপ নেয়ায় আগামী ১৪ এপ্রিল থেকে আরও এক সপ্তাহের জন্য সর্বাত্মক লকডাউনের কথা ভাবছে সরকার। যেই কথা সেই কাজ, সত্যি সত্যি ১৮ এপ্রিল থেকে সর্বাত্মক লকডাউন শুরু হলো। এর মাঝখানে যে যেভাবে পারে প্রস্তুতি নিলো লকডাউন মেনে চলার জন্য। প্রজ্ঞাপনে সরকার যেসব বিধিনিষেধ দিয়েছেন তা এক নজরে দেখা যাক।
- সব সরকারি, আধাসরকারি, সায়ত্ত্বশাসিত ও বেসরকারি অফিস, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। প্রতিষ্ঠানের সব কর্মকর্তা-কর্মচারী নিজ নিজ কর্মস্থলে অবস্থান করবেন। তবে বিমান, সমুদ্র, নৌ ও স্থল বন্দর এবং তৎসংশ্লিষ্ট অফিসগুলো এ নিষেধাজ্ঞার আওতামুক্ত থাকবে।
- বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আদালতগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা জারি করবে।
- সব ধরনের পরিবহন (সড়ক, নৌ, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ফ্লাইট) বন্ধ থাকবে। তবে পণ্য পরিবহন, উৎপাদন ব্যবস্থা ও জরুরি সেবাদানের ক্ষেত্রে এ আদেশ প্রযোজ্য হবে না।
- শিল্প-কারখানাগুলো স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণপূর্বক নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় চালু থাকবে। তবে শ্রমিকদের স্ব স্ব প্রতিষ্ঠান থেকে নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থাপনায় আনা-নেওয়া নিশ্চিত করতে হবে।
- আইন-শৃঙ্খলা এবং জরুরি পরিসেবা, যেমন- কৃষি উপকরণ (সার, বীজ, কীটনাশক, কৃষি যন্ত্রপাতি ইত্যাদি), খাদ্যশস্য ও খাদ্যদ্রব্য পরিবহন, ত্রাণ বিতরণ, স্বাস্থ্যসেবা, কোভিড-১৯ টিকা প্রদান, বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস/জ্বালানি, ফায়ার সার্ভিস, বন্দরগুলোর (স্থল, নদী ও সমুদ্রবন্দর) কার্যক্রম, টেলিফোন ও ইন্টারনেট (সরকারি-বেসরকারি), গণমাধ্যম (প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া), বেসরকারি নিরাপত্তা ব্যবস্থা, ডাক সেবাসহ অন্যান্য জরুরি ও অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ও সেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অফিসসমূহ, তাদের কর্মচারী ও যানবাহন এ নিষেধাজ্ঞার আওতা বহির্ভূত থাকবে।
- অতি জরুরি প্রয়োজন ছাড়া (ওষুধ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ক্রয়, চিকিৎসা সেবা, মৃতদেহ দাফন/সৎকার ইত্যাদি) কোনোভাবেই বাড়ির বাইরে বের হওয়া যাবে না। তবে টিকা কার্ড প্রদর্শন সাপেক্ষে টিকা গ্রহণের জন্য যাতায়াত করা যাবে।
- খাবারের দোকান ও হোটেল-রেস্তোরাঁয় দুপুর ১২টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা এবং রাত ১২টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত কেবল খাদ্য বিক্রয়/সরবরাহ করা যাবে। শপিংমলসহ অন্যান্য দোকান বন্ধ থাকবে।
- কাঁচাবাজার এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত উন্মুক্ত স্থানে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ক্রয়-বিক্রয় করা যাবে। বাজার কর্তৃপক্ষ স্থানীয় প্রশাসন বিষয়টি নিশ্চিত করবে।
- বোরো ধান কাটার জরুরি প্রয়োজনে কৃষি শ্রমিক পরিবহনে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসন সমন্বয় করবে।
- সারাদেশে জেলা ও মাঠ প্রশাসন উল্লেখিত নির্দেশনা বাস্তবায়নে কার্যকর পদপেক্ষ গ্রহণ করবে এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী নিয়মিত টহল জোরদার করবে।
- স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক তার পক্ষে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ বিভাগকে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজনীয় ক্ষমতা প্রদান করবেন।
- স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে জুমা ও তারাবির নামাজে জমায়েত বিষয়ে ধর্ম মন্ত্রণালয় নির্দেশনা জারি করবে।
- উপরোক্ত নির্দেশনা বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/বিভাগ প্রয়োজনে সম্পূরক নির্দেশনা জারি করতে পারবে।
১৪ই এপ্রিল এর পূর্বে প্রত্যেকটা খাত যেমন ব্যস্ত ছিল তেমনি ব্যাংকগুলোতে মানুষের উপছে পড়া ভিড় ছিল দেখার মত। তাই কেন্দ্রীও ব্যাংক যদিও প্রথম অবস্থায় ব্যাংক বন্ধের ঘোষণা দিয়েছিল পরবর্তীতে সকাল ১০টা থেকে ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু হয়ে চলবে বেলা একটা পর্যন্ত। এ ছাড়া ব্যাংক খোলা থাকবে বেলা আড়াইটা পর্যন্ত। যাইহোক মানুষের মধ্যে কিছুটা সস্তি ফিরে এলো।
১৪ই এপ্রিল’২১, এই দিনটি ছিল সমসাময়িক ত্রিমুখী সমন্বয় যা মানব জাতির জন্য কল্যাণময়। এই দিনে বাঙালীজাতি ব্যস্ত থাকে নববর্ষ পালন নিয়ে যায় আজ সোশ্যাল মিডিয়ায় পালিত হলো টাইমলাইনে টাইমলাইনে। মুসলিম জাতির জন্য রমজান মাস সিয়াম সাধনার মাস, এই দিনে ১ম রোজা পালন করা হয়। আর সংক্রামণ ব্যাধির হাত থেকে রক্ষার পাওয়ার জন্য সরকারে ঘোষিত লকডাউন।
সর্বাত্মক লকডাউনের প্রথম দিন থেকেই কড়া নজরে রেখেছে প্রশাসনের লোক। গণপরিবহণ রাস্তায় একেবারেই নেই, নেই কোন মানুষের চাপ তবে এই দিন বৈশাখের ছুটি থাকায় বাংলার জনগণ ঘরের ভিতর বেশি আবস্থান করেছিল। ছিলো না কোন দোকানপাট খোলা আর সকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল তাছাড়া ১ম রমজান সবমিলে লকডাউন ভালোই চলছিল। বিছিন্ন দুই একটি ঘটনা ছাড়া ১ম দিন প্রশাসনের লোকরা বিশেষ করে শহরের রাস্তাঘাটে কড়া নজরে রাখাছিলো। পরের দিন থেকে রাস্তাঘাটে যান চলাচলের চাপ বাড়তে থাকে তবে গনপরিবহন চলাচল বন্ধ ছিল। সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী শিল্প-কারখানা, খাবারের দোকান, হোটেল-রেস্তোরাঁ, কাঁচাবাজার এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি জন্য স্বল্প পরিসরে খোলা থাকবে। তাই রাস্তা ঘাটে গণ পরিবহণ চলাচল বন্ধ থাকায় স্বপরিবহন ছাড়াও রিকসা, সিএনজি, অটো রিকশায় লোক সমাগম দেখা যায়।
এদিকে গ্রাম বাংলার চিত্র একেবারেই ভিন্ন যেখানে সরকারের এত কোঠর বিধি-নিষেধ তারপরেও স্বাস্থ্যবিধিকে তোয়াক্কা না করে মাস্ক বিহীন আবাধে চলাফেরা করছে। জেলা বা উপজেলা পর্যায়ে প্রশাসনের লোকের নজরদারী বেশি থাকায় উনিয়ন পর্যায়ের জনগণ এই অনিয়ম বেশি করছে। যাইহোক ২০২০ইং সালের লকডাউন আমরা দেখেছি কোঠর বিধি-নিষেধ থাকা সত্ত্বেও মানুষের অবাধ চলাফেরা কিন্তু সেই সময়ে সংক্রামণ ও মৃত্যুর হার বর্তমানের তুলনায় কম ছিল। তবে মানুষের ভিতর একটা আতঙ্ক কাজ করেছিলো কখন কি হয়ে যায় তাই অবাধ চলাফেরা করলেও স্বচেতনতার অভাব ছিল কম। সারা বিশ্বের দিকে তাকিয়ে মানুষের মনে একটা দুর্বলতা কাজ করতো। তারপরেও জীবন ও জিবিকার তাগিদে মানুষকে ছুটতে হতো এপ্রান্তে থেকে ওপ্রান্তে।
লকডাউন মেনে চলা আমাদের একটা নৈতিক দায়িত্ব তারপরও আমরা উদাসিন। তাই সরকারের পদক্ষেপ মেনে নিতে বাধ্য করছে প্রশাসনের লোক। ফলে “ডাক্তার বড় না পুলিশ বড়” এধরণের বাকবিতণ্ডা শোনা যায়। শোনা যায় সাধারণ মানুষের পুলিশি হয়রানি। বিভিন্ন কৌশলগতভাবে লকডাউন চলছে যা কারও কাছে হয়রানি, কারও কাছে বন্ধী, কারও কাছে ফন্ধি ইত্যাদি ইত্যাদি। এদিকে মোটর শ্রমিক ও ব্যবসায়িক মহলের সংবাদ-সন্মেলন যেন দোকানপাট ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও গনপরিবহন খুলে দেওয়া হয়। সেই সুত্র ধরে ২৫ই আপ্রিল’২১ দোকানপাট ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হচ্ছে স্বাস্থ্যবিধি মেনে। লকডাউন শেষে গণপরিবহণ খুলে দেওয়া হবে বলে আলোচনা চলছে। মানুষ এখন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে মনে হয় বন্ধী হয়ে না খেয়ে মরার চেয়ে করনায় মরা ভালো। তাই মানুষের আচার আচারনের উপর ভিত্তি করে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিবে বলে ধরনা করা হচ্ছে।
এবার(২০২১ইং) করনার ২য় ঢেউ-এ মানুষের ভিতর স্বচেতনার হার ততোটা লক্ষ্য করা যায় না। অথচ সংক্রামণ ও মৃত্যুর হার এবার তুলনামূলকভাবে বেশি। জীবন ও জিবিকার তাগিদে মানুষ এখন ছুটে চলছে তবে মানুষের মনে এতটুকু সাহস জুটিয়েছে যে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রেজেনেকা টিকা হাতে হাতে চলে আচ্ছে সাথে রাশিয়া, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, গ্যাভি- কোভ্যাক্স উদ্যোগে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক প্ল্যাটফর্ম থেকে টিকা আনতে জোরালো তৎপরতা শুরু করেছে সরকার। ইতিমধ্যে ১ম ডোজের পর ২য় ডোজের টিকা দেওয়া শুরু হয়েছে। হয়তো টিকা এসেছে বলে মানুষ এখন উদাসিন হয়েছে। করোনাকে পাত্তাই দিচ্ছে না তবে করোনায় মানুষ যে মারা যাচ্ছে না তা কিন্তু নয়। সব কথার শেষ কথা করোনার হাত থেকে বাঁচতে গেলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে আর ‘নো মাস্ক নো সার্ভিস’-কে কার্যকারী করতে হবে।
লেখক- কলামিস্ট, সম্পাদক ও সাহিত্যিক