ডেস্ক রিপোর্টঃ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ। সামনে চ্যালেঞ্জ জনগণের সুষম পুষ্টি নিশ্চিত করা। সেই পথে ভালোভাবেই অগ্রসর হচ্ছে বাংলাদেশ। গত ১০ বছরে অর্থনৈতিক উন্নয়নে বেড়েছে এই খাতের ভূমিকা। ভারত থেকে আসা গরুর ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে বাংলাদেশের খামারিরা পশু পালনে উত্সাহী হয়ে গত দশ বছরে মাংসের উত্পাদন বেড়েছে। দেশ মাংস উত্পাদনে আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠেছে।
সমস্যাই সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত মেলে ধরেছে বাংলাদেশের সামনে। যেখানে ভারত ও মিয়ানমার থেকে গবাদিপশু এসে বাংলাদেশের মাংসের চাহিদা মেটাত। সেই গবাদিপশু আসা বন্ধ হওয়ার পর নিজেরাই স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠেছে। চার বছর আগে ভারত থেকে অবৈধ পথে গরু আসা প্রায় পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। সেই মাংসের চাহিদা মেটাতেই বাংলাদেশে গড়ে ওঠে অসংখ্য খামার। সরকারের প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সহায়তায় নানামুখী প্রকল্পে চার বছরেই বদলে গেছে চিত্র। বাংলাদেশ এখন গবাদিপশু উত্পাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এখন ভারত মিয়ানমারের গবাদিপশুর ওপর নির্ভরশীলতা একেবারেই নেই।
বেশ কয়েবছর আগে শুধু কোরবানি ঈদের আগে দেশে ২০ থেকে ২২ লাখ গরু-ছাগল বৈধ-অবৈধ পথে বাংলাদেশে আসত। সারা বছরে এই সংখ্যা ছিল ৩০ থেকে ৩৫ লাখ। অবৈধ পথে গবাদিপশু আসা বন্ধ হওয়ার পর দেশে প্রতিবছর ২৫ শতাংশ হারে গবাদিপশুর খামার বেড়ে চলেছে। বর্তমানে এই খামারের সংখ্যা ১২ লাখেরও বেশি। যার কারণে, গত কোরবানির ঈদে গরু এসেছে মাত্র দেড় লাখ। যার মধ্যে বেশিরভাগই অবিক্রিত থেকে গিয়েছিল। কেননা, দেশি খামারিদের হাতে দেশি ও শংকর জাতের গরুর প্রতিই এখন ক্রেতাদের আগ্রহ।
সরকারের ভিশন-২০২১ অনুযায়ী প্রতিদিন জনপ্রতি দুধ ১৫০ মিলি লিটার ও মাংস ১১০ গ্রাম এবং বছরে ডিমের চাহিদা ১০৪টি নির্ধারণ করা হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের আগেই মাংস উত্পাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছে। যা চাহিদার চাইতে ৪৬ লাখ টন উদ্বৃত্ত এখন। এখন প্রতিদিন ৯৪ লাখ ৬০ হাজার টন দুধ এবং বছরে ১৭ কোটি ৮১ লাখ ৫০ হাজারটি ডিম উত্পাদন করতে হবে। আর সেই লক্ষ্য অচিরেই অর্জন করা সম্ভব হবে বলে সরকারের আশা।
গবাদি পশু ও মাংসের উত্পাদন বাড়ছে
সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, গত নয় বছরে মাংসের উত্পাদন বেড়ে হয়েছে সাত গুণ। প্রতি বছরই ধারাবাহিকভাবে গবাদিপশুর খামারের সংখ্যা বেড়ে চলেছে আর এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে মাংস রপ্তানিরও আশা করছেন ব্যবসায়ীরা।
প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, ২০১৭-১৮ বছরে মাংসের উত্পাদন ছিল ৭.১৫ মিলিয়ন টন। ২০০৮-৯ অর্থবছরের তুলনায় এটি ৬.০৭ মিলিয়ন টন বেশি। ওই বছর উত্পাদন ছিল ১.০৮ মিলিয়ন টন। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশের বার্ষিক চাহিদা পূরণের পর ১৯ হাজার টন উদ্বৃত্ত মাংসও ছিল। ফলে, গত তিন বছরে মাংসের চাহিদা মেটাতে গবাদি পশু আমদানির প্রয়োজন পরেনি।
২০১৭-১৮ অর্থবছরে গবাদি পশুর মোট পরিমাণ (গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া) পাঁচ কোটি ৫১ লাখ ৪০ হাজার, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ছিল গবাদি পশুর সংখ্যা পাঁচ কোটি ৪৭ লক্ষ ৪৫ হাজার। আর ২০০৮-৯ অর্থবছরে ছিল চার কোটি ৯৫ লক্ষ ৫৮ হাজার। গত ১০ বছরে ৫৬ লাখেরও বেশি গবাদি পশু উত্পাদন হয়েছে। বাংলাদেশ ডেইরি ফার্ম অ্যাসোসিয়েশন বলছে, ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে নিবন্ধিত খামারির সংখ্যা বেড়েছে ১০ হাজার। আর নিবন্ধনের বাইরে আছে আরো ১০ হাজার। ফলে এখন ভারত থেকে অবৈধ পথে আসা গরু বন্ধ করতে হবে। অবৈধ পথে গরু এলেই খামারিরা লোকসানের মুখে পড়বে। কারণ, এতে তাদের পশুর দাম কমে যাবে। উত্পাদন আরো বাড়াতে জাত উন্নয়ন ও সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধানের দিকে জোর দেয়ার কথা জানালেন খামারিরা। কেননা, ভৌগোলিক সীমারেখা ও আবহাওয়ার উপর মাংস ও দুধ উত্পাদন নির্ভর করে। তাই কর্ম পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করতে হবে। সেজন্য পাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সহযোগিতা কার্যক্রম দেশ জুড়ে বাড়ানোর কথা বলছেন খামারিরা।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের বিশেষ প্রকল্প
গবাদিপশু উত্পাদনে ও দুধ ডিম, ঘি এর উত্পাদন বাড়াতে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের এমনই একটি আদর্শ কার্যক্রম ‘দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন প্রকল্প’।
এমডিজির পর এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সাম্প্রতিক সময়ে প্রাণিসম্পদ খাতের কার্যক্রম আরো বেগবান করেছে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর। মাঠপর্যায়ে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে কারিগরি ও সেবা সহায়তা। যে খামারিরা গবাদিপশু উত্পাদনে এগিয়ে এসেছে তাদের সুরক্ষা ও আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর করে তুলে তাদের আয় বৃদ্ধির পরিকল্পনা করা হয়েছে। ২০১৫ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত খুলনা বিভাগের খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, যশোর, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, কুষ্টিয়া, মাগুরা ও নড়াইল জেলার ৬০টি উপজেলায় ‘দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন প্রকল্প’ নামে বিশেষ প্রকল্পের আওতায় প্রতিটি গ্রামে কৃষক পর্যায়ে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে বিজ্ঞানসম্মত গবাদিপশু লালন পালনে। শেখানো হচ্ছে দুগ্ধ উত্পাদন বৃদ্ধিসহ সংরক্ষণ, গরু হূষ্টপুষ্টকরণসহ নানা কৌশল। খামারিদের আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, যন্ত্রপাতি প্রদান, রোগবালাই প্রতিরোধে টিকা প্রদান ও ব্যবসা সম্প্রসারণে পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। দেখা গেছে, এতে গবাদিপশুর সংখ্যা বৃদ্ধি ও ডিম দুধ উত্পাদন যেমন বেড়েছে তেমনি খামারিদের আয় বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। এখন এই কার্যক্রম সারাদেশে বৃদ্ধি করার কথাও ভাবা হচ্ছে।
এ বিষয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় উন্নয়ন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক দিলীপ কুমার ঘোষ বলেন, ডিম, দুধ ও মাংসের উত্পাদন যে গত কয়েক বছরে বেড়েছে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। উত্পাদন বাড়ানোর ক্ষেত্রে বেশকিছু প্রতিবন্ধকতা ছিল। সেগুলোকে চিহ্নিত করে এরই মধ্যে কাজও শুরু হয়েছে। বিশেষ করে জাত উন্নয়ন, কৃত্রিম প্রজনন, মানসম্পন্ন ব্রিড তৈরি করা ছাড়াও খামারিদের নানা ধরনের সহায়তাও দেয়া হচ্ছে।
জানা গেছে, দুধের উত্পাদন বাড়াতে ব্যক্তি পর্যায়ে গাভি উত্পাদনে জোর দেওয়ার পাশাপাশি খামারিদের প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিসহ অন্যান্য সুবিধাও দেয়া হচ্ছে। মাংস ও ডিম উত্পাদনে প্রশিক্ষণ দেয়ার পাশাপাশি বিপণন কৌশল ও বাজারের সঙ্গে খামারিদের সংযোগ বাড়াতে বিভিন্ন কার্যক্রমও হাতে নেয়া হয়েছে। বিচ্ছিন্নভাবে উত্পাদনের পরিবর্তে খামারিরা যাতে উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলতে পারেন, সেজন্য তাদের প্রশিক্ষণও দেয়া হচ্ছে। এর মাধ্যমে গ্রামীণ কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্য বিমোচনেও ভূমিকা রাখা হচ্ছে। এসব কার্যক্রম পরিচালনায় বড় ধরনের প্রকল্প চলমান রয়েছে। স্বল্প সময়ের মধ্যেই মাংস, দুধ ও ডিম উত্পাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারব বলে আশা করা যায়।
সচ্ছলতা আসছে খামারিদের জীবনে
ছাগল পেলে ছেলেকে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াচ্ছেন ঝিনাইদহের কুমড়াবাড়িয়া ইউনিয়নের ধোপাবালিয়া গ্রামের বিল্লাল হোসেন। বললেন, ‘মাশাল্লা খেয়ে পরে ভালো আছি ভাই। আগে অনেক অভাব ছিল। কিন্তু ছাগল লালন পালন করে সেই অভাব দূর হয়েছে।’ বিল্লালের এখন ৬০টিরও বেশি উন্নত জাতের ব্লাক বেঙ্গল গোট আছে। অথচ শুরুতে ছিল মাত্র দুটি। বছরে দুইবার ২/৩টি করে ছাগলের বাচ্চা দেয়। সেই বাচ্চা লালন পালন করে বড় করে বাজারে বিক্রি করে বিল্লালের সংসার চলে।