………………… মোঃ আব্দুল মান্নান
রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন বর্তমান প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত জরুরী।স্বাধীনতার ৪৯ বছর পেরিয়ে গেলেও দেশের রাজনীতিতে ইতিবাচক অর্জন খুবই কম।সংঘাত, সংঘর্ষ ও প্রতিহিংসার রাজনীতিই এখন দেশে বিদ্যমান।নেতৃবৃন্দের নিত্যদিনের রাজনৈতিক বক্তব্য হলো রাজনীতিতে এককভাবে কর্তৃত্বের দাবি করা, যা বর্তমান রাজনীতির মূখ্য বিষয় হিসেবে ধরা যায়।ক্ষমতায় টিকে থাকা এবং ক্ষমতায় যাওয়ার প্রবনতাই এখন বেশি বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।ঔপনিবেশিক আমলের প্রবনতার মাধ্যমে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলে জাতিকে দ্বিধাবিভক্তিতে রাখার কৌশল বাস্তবায়নে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এখন সদা ব্যস্ত। দলের অভ্যন্তরের নেতৃত্ব ও গনতান্ত্রিক সংস্কৃতির অভাব অধিকাংশ ক্ষেত্রে, তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম লক্ষ্যনীয়।আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মাঝে ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় একরকম এবং ক্ষমতায় না থাকা অবস্থায় ভিন্ন রকমের মনোভাব লক্ষ্যনীয়।তারা ক্ষমতায় যাওয়ার আগে বিভিন্ন রকমের ওয়াদা দেয় এবং ক্ষমতায় গেলে ওয়াদা পূরণ করে না। অতীত বিমূখীতা ও ব্যক্তি সত্তার ভূঁয়সী প্রশংসা করার প্রবল মানসিকতা ক্ষমতাসীন দল ও ক্ষমতার বাহিরে থাকা দলগুলোর নেতৃবৃন্দের নিত্যদিনের ঘটনা।
ছাত্র ও যুব-সমাজের মাঝে আদর্শগত কর্মসূচী ও যুক্তির পরিবর্তে পেশি শক্তির ব্যবহার এবং ক্ষেত্র বিশেষে অনৈতিক ও অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটাতে দেখা যাচ্ছে ।এ কারনে মূল দল ও আদর্শবান নেতাদের নিজ নিজ ভাবমূর্তি রক্ষা করা যেন কঠিন হয়ে পড়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পেশি শক্তির প্রভাব রাজনীতিকে প্রশ্নবিদ্য করে ফেলছে।ছাত্র ও যুবসংগঠন গুলো মূল দলের সাথে অঙ্গসংগঠনে পরিণত হচ্ছে এবং অধিকতর রাজনীতি প্রবণ হয়ে উঠছে।ছাত্রদের মাঝে পেশাদার নেতৃত্বের বিকাশ ঘটেছে।মূলদলের নেতৃত্বের উপর ছাত্র ও যুব সংগঠন গুলোর কর্তৃত্ব রাখার প্রবণতা বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ফলে সৎ,নিষ্ঠাবান ও প্রবীণ রাজনীতিবিদ্গণ এখন রাজনীতিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন।অসৎ ও কালোটাকার মালিকদের দলে ঠাই দেয়ার মাধ্যমে রাজনীতিতে দূর্বিত্তায়ন ঘটানো হয়েছে। অসৎ রাজনীতিবিদ দ্বারা প্রভাবিত করা হচ্ছে রাজনীতির অঙ্গনকে। এসব দুর্নীতিগ্রস্থ রাজনীতিবিদ দ্বারা কলুষিত হচ্ছে রাজনীতি। রাজনৈতিক নেতাদের মাঝে এ কারনে দিন দিন দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। নস্ট হচ্ছে রাজনীতিতে সহনশীলতা ও পারস্পারিক মর্যাদাবোধ। লাগামহীন অশালীন বক্তব্য প্রদানে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে রাজনৈতিক শিষ্ঠাচার, ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে গনতন্ত্রের মূলধারা।জাতীয় সমস্যা সমাধানে বিদেশি শক্তিকে জড়িয়ে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে তাদের হস্তক্ষেপের সুযোগ সৃস্টির মাধ্যমে রাজনীতিতে নাক গলানোর ঘটনা জাতীয় মর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ করছে। নির্বাচনকে ব্যয়বহুল ও প্রশ্নবিদ্য করে একশ্রেনীর রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও দুর্নীতিপরায়ন আমলা চক্রের অত্যন্ত আঁতাতের মাধ্যমে রাজনীতির অঙ্গনকে প্রভাবিতকরন ও তাদের মাধ্যমে অবৈধ উপায়ে ক্ষমতার হাতবদলের ভূমিকা পালনের সুযোগের প্রবণতা বৃদ্ধি রাজনীতিতে হালে কালো ছায়া ফেলছে।প্রধান প্রধান জাতীয় ইস্যুতে দলের বক্তব্য ও কর্মসুচী ব্যাখ্যা করে জনগণের সমর্থন আদায় এবং জনপ্রিয়তা অর্জনের পরিবর্তে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে বিষাদাগার ও প্রতিহিংসামূলক বক্তব্যের মাধ্যমে এখন নেতৃবৃন্দের সময়ক্ষেপন হচ্ছে। এ ছাড়াও জাতীয় সংসদকে বিরোধীদলের নেতৃবৃন্দের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিনত না করে বিক্ষোভ, হরতাল ও ধ্বংসাত্মক কর্মসূচীর প্রবণতার সুযোগ সৃষ্টি করা হচ্ছে। সরকারী দলে থাকলে হরতাল না করার ঘোষণা এবং বিরোধীদল হলে অঙ্গিকার ভঙ্গ করে হরতাল করার চর্চা বর্তমান রাজনৈতিক কালচারে পরিনত হয়েছে।রাজনৈতিক দলগুলোর এ সব সুবিধাবাদী আচরণ ও নীতি গ্রহনে নির্লজ্জ প্রয়াসও জনগনকে হতাশ করেছে। ক্ষমতা দখলের জন্য দেশ ও জনগনের প্রতি দায়বদ্ধতার পরিবর্তে ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে জনগনের সাথে প্রতারনার অভিনব কায়দা কৌশল অহরহ করা হচ্ছে; যা সুস্থ গনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কারই কাম্য নহে এবং তা জনমনে বিরুপ প্রভাব ফেলছে। জনগনের ভাগ্য গড়ার চেয়ে নিজেদের ভাগ্য গড়ার নগ্ন প্রয়াস জাতিকে বিচলিত করলেও রাজনৈতিক মহল তাতে মোটেই উৎকণ্ঠিত নন। সন্ত্রাসী, চাদাবাজী, ক্যাসিনোদের সাথে রাজনীতি ও প্রশাসনের যোগসাজশে বা প্রশ্রয়ে বর্তমান পরিস্থিতির উদ্বেগজনক অবনতি দেশের বুদ্ধিজীবী ও সচেতন মহলকে ভাবিয়ে তুলেছে। সুশীল সমাজ ও বুদ্ধিজীবী মহলকে রাজনীতির গুটিতে পরিনত করা হয়েছে। শিক্ষক ও ব্যবসায়ী সমাজসহ প্রতিটি সেক্টর রাজনৈতিক বিভাজনের শিকার হয়েছে। জীবনমানের উন্নয়ন ঘটানোর পরিবর্তে অর্থহীন ও অযৌক্তিক বক্তব্য নিয়ে ব্যস্ত থাকা রাজনৈতিক নেতৃত্ব, বুদ্ধিজীবী ও সংবাদ মাধ্যমগুলো এখান থেকে এখনও মুক্ত হতে পারে নি।
দেশের অনেক মানুষ এখনও আশ্রয়হীন।যদিও সরকারী জমি আছে ঘর নাই এরূপ মানুষকে দূর্যোগসহনীয় ঘর তৈরীর প্রকল্পের মাধ্যমে কার্যক্রম শুরু করেছেন, ভবিষ্যতে এ কার্যক্রম চালু থাকলে হয়ত এ সমস্যা সমাধান সম্ভব হবে। রাজনৈতিক দুর্বিত্তগনের কারনে বৃদ্ধি পাচ্ছে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য। অতি অল্পসংখ্যক সুবিধাভোগি মানুষের হাতে চলে গেছে নব্বইভাগ সম্পদ। ব্যাংকিং এর মাধ্যমে বিদেশে পাচার করা হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। ব্যাংক,বীমাসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে সর্বাধিক সুবিধা ভোগ করছে অসাধু আমলা, দূর্বিত্ত রাজনীতিবিদ ও সুযোগ সন্ধানী কিছু অসাধু বিত্তবান মানুষ। এর প্রেক্ষিতে দেশে ভয়ঙ্কর ও ভারসাম্যহীন সমাজ ব্যবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। শোষণ ও জুলুমের শিকার হচ্ছে দেশের নিরীহ জনগন।দেশে বর্তমানে চলছে ধর্ষণের বর্বরতা।নারী ও শিশু ধর্ষণ ও নির্যাতনের ঘটনা সর্বকালের সব রেকর্ডকে অতিক্রম করেছে। ধর্ষকের শাস্তি মৃত্যদন্ড ঘোষণা হলেও কমছে না ধর্ষণের ঘটনা। সরকার এ ব্যাপারে কঠোর হওয়া সত্তেও পরিস্থিতির কোন উন্নতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। মানবপ্রেম, শ্রদ্ধা ও ভালবাসা দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে দেশ থেকে। প্রতিদিন ঘটেই চলছে পাশবিক ও বর্বরোচিত যতসব ঘটনা। তাই অন্ধকারগলি ও সংকীর্ণবৃত্ত থেকে এখন আমাদের বের হয়ে আসার সঠিক পথ খুজতেই হবে। দেশে গনতান্ত্রিক ধারাকে নিষ্কলুস ও গ্রহনযোগ্য করার প্রক্রিয়াকে ক্ষমতাসীনদেরই বাস্তবায়ন করতে হবে। ক্ষমতাসীন দলই পারে গণতান্ত্রিক ধারাকে সমুজ্জল রাখতে;যে কারনে গনতন্ত্রে গুনগত পরিবর্তন আনার প্রক্রিয়া ক্ষমতাসীন দলকেই শুরু করতে হয়। তবেই প্রকৃত গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। তবে বিরোধীদলকেও গনতন্ত্রের স্বার্থে ধ্বংসাত্মক রাজনীতির বেড়াজাল থেকে মুক্ত হয়ে সুস্থধারার গনতান্ত্রিক পথ অনুসন্ধান করতে হবে। উভয় পক্ষকেই মনে রাখতে হবে, রাজনীতি করা হয় দেশ এবং দেশের মানুষের কল্যানের জন্য। ক্ষমতার সিঁড়ি হলো অত্যন্ত পিচ্ছিল,কখন ফসকাবে তা বলা মুশকিল। দেশের মানুষ চায় একটি সুষ্ঠ গনতান্ত্রিক ধারা চলমান থাকুক। দেশে সুষ্ঠ গনতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু থাকলে দেশের উন্নয়নের ধারা এগিয়ে যাবে তখনই দেশ বিশ্বের দরবারে ধনীরাষ্ট্রের মর্যাদার আসন জয় করবে। দেশ ও জাতির স্বার্থে তাই রাজনীতিতে গুনগত পরিবর্তন আনা এখন অত্যন্ত জরুরী।
লেখক – সাংবাদিক ও কলামিস্ট