টানা ছয় দফা মৃদু ভূমিকম্পে সিলেট শহরসহ আশপাশের এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। দেশের অন্য বড় শহরগুলো নিয়ে কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়েছে দেশের ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞদের। কারণ, বেশির ভাগ বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, টানা এই ভূকম্পন বড় ভূমিকম্পের আভাস। ভারতের মেঘালয়ের শিলং থেকে সিলেট হয়ে ভুটান পর্যন্ত ভূগর্ভে যে চ্যুতি আছে, তাতে বিপুল পরিমাণে শক্তি জমা হয়েছে। সেটি মৃদু ভূমিকম্পের মাধ্যমে বেরিয়ে এসে বড় ভূমিকম্পের ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
২০১৬ সালে বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানবিষয়ক সাময়িকী নেচার জিওসায়েন্স–এ এ বিষয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ গবেষণা প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়েছিল। সেখানে বলা হয়, ভূগর্ভে যে পরিমাণে শক্তি জমা হয়েছে, তাতে সিলেট অঞ্চলে ৭ থেকে ৮ মাত্রার এবং চট্টগ্রাম-কক্সবাজার ও পার্বত্য চট্টগ্রামে ৮ থেকে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প যেকোনো সময় হতে পারে। ওই গবেষণা প্রতিবেদন প্রস্তুতের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক হুমায়ুন আখতারের নেতৃত্বে একটি দল ও যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক যুক্ত ছিলেন।
ওই গবেষণা প্রকাশের পর দেশের ভূতত্ত্ববিদ ও পুরকৌশল বিশেষজ্ঞরা নড়েচড়ে বসেন। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে এরপর বিভিন্ন সময়ে করা জরিপে দেখা যায়, ঢাকায় মোট ১৩ লাখ, চট্টগ্রামে ৩ লাখ ও সিলেটে ১ লাখ বহুতল ভবন রয়েছে। এসব ভবনের ৭৫ শতাংশ হচ্ছে ছয়তলা বা তার চেয়ে বেশি। ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে এই ভবনগুলো ও এর বাসিন্দারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
এ ব্যাপারে অধ্যাপক হুমায়ুন আখতার প্রথম আলোকে বলেন, মেঘালয়ের শিলং থেকে সিলেট হয়ে ভুটান পর্যন্ত ভূগর্ভে যে চ্যুতি আছে, তাতে বিপুল পরিমাণে শক্তি জমা হয়েছে। সেটি মৃদু ভূমিকম্পের মাধ্যমে বেরিয়ে এসে বড় ভূমিকম্পের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এভাবে টানা অনেকগুলো ভূমিকম্প হওয়া একটি বড় ভূমিকম্প সৃষ্টির লক্ষণ। তিনি আরও বলেন, ‘তাই আমাদের আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে জরুরি ভিত্তিতে সিলেটসহ দেশের প্রধান শহরগুলোতে ভূমিকম্পের সময় কী করতে হবে, তার মহড়া দেওয়া শুরু করতে হবে। করোনাকালে আমরা যেমন মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করেছি, তেমনি ভূমিকম্প মোকাবিলার প্রস্তুতি ও মহড়াকে নিয়মিত চর্চায় নিয়ে আসতে হবে।’
এর আগে ২০১৩ সালে ঢাকার সাভারের রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি থেকে সরকারসহ দেশের সংশ্লিষ্ট সব কটি সংস্থা বুঝতে পারে যে বহুতল ভবন ভেঙে পড়লে তাতে উদ্ধারকাজ চালানো এবং মানুষের জীবন রক্ষা করা কত কঠিন। ওই দুর্ঘটনার পর সরকারি উদ্যোগে বুয়েটকে দিয়ে দেশের পাঁচ হাজার তৈরি পোশাক কারখানা কতটুকু ভূমিকম্প সহনশীল, তা নিয়ে সমীক্ষা করা হয়। তাতে দেখা যায়, ৩০ শতাংশ ভবনই ভূমিকম্পসহ নানা কারণে ঝুঁকিতে। পরে সব কটি ভবন পর্যায়ক্রমে ঝুঁকিমুক্ত ও টেকসই করা হয়।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর থেকে ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির মতো ভূমিকম্প–পরবর্তী সময়ে কাজ করার জন্য স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেটি মাঝপথে আটকে আছে। দেশের ইমরাত নির্মাণ বিধিমালা এবং ভবন কোড চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পকে আমলে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রার ওপরে ভূমিকম্প হলে দেশের কতটি ভবন টিকবে, তা নিয়ে দেশের ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।
এ ব্যাপারে বুয়েটের অধ্যাপক ও ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ মেহেদী আহমেদ আনসারী প্রথম আলোকে বলেন, দ্রুত দেশের ২০ লাখ বহুতল ভবনের সব কটিকে ভূমিকম্প সহনশীল করতে হবে। সেটা করার মতো কারিগরি দক্ষতা এবং সামর্থ্য বাংলাদেশের আছে। তবে এ জন্য সরকারের জরুরি উদ্যোগ দরকার।
এদিকে গত রোববারের ভূমিকম্পের পর সিলেট নগরের আম্বরখানা মণিপুরিপাড়ায় একটি পুকুরের পাড় ধসে গেছে। এতে ঝুঁকির মুখে পড়েছে পুকুরপাড়ে থাকা একটি তিনতলা ভবন। কয়েক দফা ভূকম্পন আর অতিবৃষ্টির কারণে এ ঘটনা ঘটেছে বলে স্থানীয় লোকজন দাবি করেছেন। এ অবস্থায় ভবনে থাকা পাঁচটি পরিবারকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
সিলেট সিটি কর্তৃপক্ষ ২০১৯ সালের ৩০ এপ্রিল নগরের ২৩টি ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে। এর মধ্যে করপোরেশনের মালিকানাধীন সিটি সুপার মার্কেটও (তিনতলা) আছে। ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত এ বিপণিবিতানে ৩৪৫টি দোকান রয়েছে। সিটি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে দোকান ইজারা নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করছেন ব্যবসায়ীরা।
এই পরিস্থিতিতে ভূমিকম্প মোকাবিলায় করণীয় নিয়ে আজ মঙ্গলবার ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় জরুরি বৈঠক ডেকেছে। সরকারি কর্মকর্তারা ছাড়াও সেখানে দেশের শীর্ষস্থানীয় ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ ও প্রকৌশলীরা থাকবেন বলে জানা গেছে।
Pr/N