বাংলাদেশে জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশনের অফিস খোলা নিয়ে দ্বিধায় রয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। সম্প্রতি ঢাকা সফর করেন জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশনার ভলকার টুর্ক। সে সময় (২৯ সেপ্টেম্বর) সমাজকল্যাণ উপদেষ্টা শারমিন এস মুরশিদ সাংবাদিকদের বলেন, অফিস খোলার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে এবং দ্রুত অফিস খোলা হবে।
এর পরের দিন ৩০ সেপ্টেম্বর পররাষ্ট্র উপদেষ্টা সাংবাদিকদের জানান, অফিস খোলার বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি এবং এটি পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে অফিস খোলার মতো রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে সমাজে।
ঢাকা সফর শেষে ভলকার টুর্ক এক বক্তব্যে বাংলাদেশ নিয়ে তার চিন্তা তুলে ধরেন। তিনি মনে করেন, মানবাধিকার ও সামাজিক ন্যায়বিচার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অন্তর্নিহিত দাবি ছিল। বাংলাদেশকে প্রতিশোধ ও শাস্তির বৃত্ত থেকে বের হয়ে আসতে হবে। একই সঙ্গে দুর্নীতি ও বড় ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রবণতা থেকে বের হতে হবে। এ লক্ষ্যে তিনি জাতিসংঘ মানবাধিকার দফতরের সর্বাত্মক সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেন।
তিনি তার দফতরের বর্ধিত উপস্থিতির (স্ট্রেনথেন অব প্রেজেন্স) জন্য পদ্ধতি চূড়ান্তকরণের বিষয়টি উত্থাপন করেন। বর্ধিত উপস্থিতি অর্থাৎ নতুন অফিস জুলাই-আগস্টে মানবাধিকার লঙ্ঘনের তদন্তের পাশাপাশি আইনি, প্রাতিষ্ঠানিক, অর্থনৈতিক, সামাজিকসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার করার ক্ষেত্রে সহায়তা দিতে পারে। এছাড়া আন্দোলন পরবর্তী সামাজিক মিটমাট (রিকনসিলসিয়েশন) এবং উপশমের (হিলিং) জন্য কাজ করবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
অফিস খোলার বিষয়ে প্রায় চূড়ান্ত একটি অবস্থান সরকারের আছে বলে ধারণা করা যায়। এর ম্যান্ডেট অনেক বড় এবং এটি বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিকসহ সব বিষয়ে প্রভাব রাখতে পারে। এ বিষয়ে জেনেভায় বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মো. সুফিউর রহমান বলেন, ‘একটি সমাজে মানবাধিকার বিষয়ক ধারণার ব্যাপ্তি কতটুকু হবে সেটি নির্ভর করে সামাজিক পরিপক্বতা, সুশিক্ষাসহ বিভিন্ন উপাদানের ওপর। একটি রাষ্ট্রের আইনি কাঠামো কীভাবে চর্চা করা হবে, সেটি রাজনৈতিক সমঝোতার ওপর নির্ভর করা উচিত। এটি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ও একান্ত বিষয়।’
উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘উন্নত বিশ্বের অনেক দেশে মানবাধিকার রক্ষণের দাবিতে মৃত্যুদণ্ড প্রথা রহিত করা হয়েছে। মানবাধিকারের অজুহাত দিয়ে বাংলাদেশে যদি মৃত্যুদণ্ড প্রথা রহিত করা হয়, সেটির প্রভাব কী ধরনের হবে, সেটি বিবেচনায় নিতে হবে।’ উল্লেখ্য, ভলকার টুর্ক ঢাকা সফরের সময়ে মৃত্যুদণ্ড প্রথা রহিত করার বিষয়ে আলোচনা করেন।
সামাজিক মিটমাট এবং উপশমের বিষয়ে মো. সুফিউর রহমান বলেন, ‘পতিত সরকারের রাজনৈতিক দল ও এর সহযোগিতাকারীদের ভবিষ্যৎ বাংলাদেশে কি হবে এবং কতটুকু ভূমিকা থাকবে, সেটি সম্পূর্ণভাবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়।’ মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাবেক এক কূটনীতিক বলেন, ‘প্রতিটি দেশে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চায় জাতিসংঘ। কিন্তু প্রতিটি সমাজের সক্ষমতা এবং বৈশিষ্ট্য এক ধরনের নয় এবং সেটি বিবেচনায় না নিয়ে জাতিসংঘ মানবাধিকার সিস্টেমের পূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য চাপ দেয়।’
মানবাধিকারের অজুহাতে ভলকার টুর্ক কর্তৃক মৃত্যুদণ্ড রহিত করার আলোচনার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘মৃত্যুদণ্ড রহিত করার বিষয়টি তারা প্রকাশ্যে বলে থাকে। কিন্তু জাতিসংঘের বিভিন্ন ফোরামের আলোচনায় সমকামিতা যেন অপরাধ হিসেবে গণ্য করা না হয় অথবা সব ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান অধিকারের ক্ষেত্রে জাতিসংঘের সমর্থনের বিষয়টি সবসময় তারা বলে থাকে।’ উল্লেখ্য, বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী সমকামিতা একটি ফৌজদারি অপরাধ। অন্যদিকে উত্তরাধিকার সম্পত্তি বণ্টনের ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের অধিকার সমান নয়।
পেনাল কোডের সংস্কার
বাংলাদেশের সিআরপিসি (ক্রিমিনাল পেনাল কোড) মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে এবং সমকামিতাও একটি অপরাধ। কিন্তু জাতিসংঘ ওই দুটি বিষয়কে মানবাধিকার লঙ্ঘন বলে মনে করে এবং যেসব দেশে এ ধরনের ‘মানবাধিকার পরিপন্থি’ আইন আছে, সেগুলো পরিবর্তনের জন্য চাপ দেয়।
বর্তমানে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র ফেলো সুফিউর রহমান বলেন, ‘একটি সমাজ সমস্যা মোকাবিলার জন্য যে দর্শন ও পদ্ধতি বেছে নেয়, তার পেনাল কোড সে ধরনের হয়। সমাজ যদি রক্ষণশীল হয়, তবে সমকামিতার মতো বিষয়গুলো নিরুৎসাহিত করার জন্য সেটির প্রতিকার ব্যবস্থা থাকবে।’
মৃত্যুদণ্ডের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের মতো দেশে নারী ও শিশুপাচার একটি বড় সমস্যা। পতিতাবৃত্তির জন্য নারী ও শিশুপাচার অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ডের বিধান আছে। এখন যদি জাতিসংঘের সুপারিশ অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ডের বিধান তুলে নেওয়া হয়, তবে নারী ও শিশুপাচার অপরাধের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকবে।’
জেনেভা থেকে সহায়তা
বাংলাদেশে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন সংশোধনের জন্য জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশন অফিস সুপারিশ করেছিল। ওই সুপারিশ তারা জেনেভা থেকে করেছিল। এ বিষয়ে একজন সাবেক কূটনীতিক বলেন, ‘জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশন অফিস যদি আমাদের সহায়তাই করতে চায়, সেটি তারা জেনেভা থেকে করতে পারে। এর জন্য তো বাংলাদেশে অফিস খোলার প্রয়োজন নেই।’ উল্লেখ্য, জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশন অফিসের সদর দফতর জেনেভাতে।
সমাজ কতটুকু তৈরি
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশের সমাজ কতটুকু তৈরি– সে বিষয়ে প্রশ্ন আছে। পৃথিবীর অনেক সমাজে একান্ত প্রয়োজন ছাড়া কেউ হর্ন বাজায় না। কিন্তু বাংলাদেশে প্রয়োজন-অপ্রয়োজনে হর্ন বাজানো হয়; যা শব্দদূষণের মাধ্যমে মানবাধিকার লঙ্ঘন।
এ বিষয়ে সুফিউর রহমান বলেন, ‘আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সমাজ কতটুকু প্রস্তুত সেটি নিয়ে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিতর্ক হতে পারে। অভ্যন্তরীণ আলোচনা ও ঐকমত্য ছাড়া একটি ছোট গোষ্ঠীর এজেন্ডা বাস্তবায়নের সুযোগ নেই।’
বাংলাদেশের সমাজ কি মৃত্যুদণ্ড রহিত করতে প্রস্তুত, এই সমাজ কি সমকামিতা গ্রহণ করবে বা উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান অধিকার মেনে নেবে– এ ধরনের আরও অনেক বিষয়ে প্রশ্নের সুরাহা না করে জাতিসংঘকে এখানে কাজ করার অবারিত জায়গা দেওয়া হলে সেটি সমাজে বিতর্ক ও বিভক্তি তৈরি করতে পারে বলে তিনি জানান। তবে তিনি বলেন, ‘ঐকমত্যের ভিত্তিতে জাতিসংঘের সহায়তাকে স্বাগত জানানো উচিত।’
ittefaq