জুয়েল ইসলাম, তারাগঞ্জ (রংপুর) প্রতিনিধি: রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ মোছাঃ শামসুন্নাহারের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। ইতিমধ্যে তাঁর বিরুদ্ধে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরত চিকিৎসকরা রংপুর সিভিল সার্জন বারবরে লিখিত অভিযোগ করেছেন।
কোভিড-১৯ টিকাদান কর্মকর্তা নিয়োজিত স্বেচ্ছাসেবীদের বরাদ্দকৃত টাকাও নয়ছয় করার অভিযোগ ইউএনওকে করেছে স্বেচ্ছাসেবীরা। চিকিৎসকদের অভিযোগ, উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও দায়িত্ব বন্টনে অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলার কারণে একাগ্রতা ও নিষ্ঠা চিকিৎসকদের মধ্যে হারিয়ে যেতে বসেছে। স্বাস্থ্য কর্মকর্তা তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী বহির্ভূতভাবে দায়িত্ব বন্টন করার কারণে মেডিকেল অফিসারগণ তাঁর স্বীয় দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হচ্ছেন। যার ফলে স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত না হয়ে বর্তমানে হাসপাতালের সার্বিক ব্যবস্থাপনা ক্ষুন্ন হচ্ছে।
ডাঃ মোছাঃ শামসুন্নাহার যোগদানের পর থেকে অদ্যবধি কর্ম ক্ষেত্রে অনিয়মিত উপস্থিতি ও স্বল্প সময়ে অফিসে অবস্থান করার কারণে গুরুত্বপূর্ণ অনেক কাজ ব্যহত হচ্ছে। কর্মক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা প্রধান সহকারী ও নৈশ প্রহরীর মাধ্যমে শুনে চিকিৎসকদের কর্ম সম্পাদন করতে বাধ্য হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে তাঁদের অশোভন আচরণের স্বীকার হতে হচ্ছে চিকিৎসকদের। স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার হাসপাতালে অনিয়মিত উপস্থিতির জন্য কর্মচারীদের মধ্যে এক ধরনের শিথিলতা বিরাজ করছে। ফলে নিয়মিত সেবাদান কার্যক্রম ভেঙে পড়ছে। ফলে চিকিৎসকদের স্থানীয় জনগণের রোষানলে পড়তে হচ্ছে। হাসপাতালে নিয়োজিত পরিচ্ছন্ন কর্মী ও আয়ার একটি অংশ ওই কর্মকর্তা তাঁর নিজ আবাসস্থলে নিয়োযুক্ত করেছে। ফলে হাসপাতাল পরিচ্ছন্নতা সহ সার্বিক সেবা কার্যক্রম বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। বিশেষ করে যারা জরুরি বিভাগে কাজ করে তাদের জন্য জরুরি বিভাগ সহ আন্ত বিভাগ পরিচ্ছন্ন রাখা চ্যালেঞ্জ হয়ে পড়ছে।
উপজেলা পরিষদের মাসিক সভা সহ অন্যান্য সভায় ওই স্বাস্থ্য কর্মকর্তা নিজে উপস্থিত না থেকে প্রায়শই কোন পূর্ব নির্দেশনা ছাড়াই মেডিকেল অফিসারকে প্রেরণ করে থাকে। ফলে হাসপাতালের স্বাস্থ্য সেবা ও অন্যান্য বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য সর্ম্পকে সম্যক ধারণা না থাকায় তা সভায় সকলকে জানানো সম্ভব হয় না। উপস্থিত মেডিকেল অফিসারকে বিভিন্নভাবে নাজেহাল হতে হয়। বিষয়গুলো পরবর্তিতে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাকে জানানো হলেও তা থেকে উত্তরোণের কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। ওই অভিযোগে আরও উল্লেখ করা হয় , ওই স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্যক্তিগত পছন্দ অনুযায়ী বারবার অফিস আদেশ প্রণয়ন ও পরিবর্তনের মাধ্যমে দৈনন্দিন কাজ কর্ম করার নির্দেশ দিয়ে থাকেন। ফলে কাজের সুসমন্বয় না হয়ে বিশৃঙ্খলা দেখা দিচ্ছে, যা বর্তমানে নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। যার ফলে চিকিৎসক সহ সকল কর্মীদের মধ্যে চেইন অফ কমান্ড মুখ থুবরে পড়ছে। তিনি হাসপাতালের চিকিৎসক সেবিকা সহ সকল কর্মীচারীদের সাথে সামান্য বিষয়ে জনসম্মুখে খারাপ আচরণ সহ অসত্য ও কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করেন। যা চাকুরী বিধির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। যার ফলে কর্মকর্তা কর্মচারীদের কর্মস্পৃহা কমে যাচ্ছে।
কোভিড-১৯ টিকা কর্মসূচির আওতায় প্রশিক্ষণ কার্যক্রম সহ টিকাদান কর্মসূচির বিভিন্ন ধরনের আর্থিক প্রণোদনা বা সম্মানি প্রদানের ক্ষেত্রে বর্তমান পদে আসীন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা আমাদের বিভিন্ন অজুহাতের মাধ্যমে অর্থ না থাকার বিষয়টি উল্লেখ করেন। কিন্তু বাজেট পাওয়া সাপেক্ষে অর্থনৈতিক প্রণোদনার বিষয়টি পূণরায় ব্যক্ত করলে তিনি একই অভিব্যক্তি পূর্ণরায় ব্যক্ত করেন। উক্ত অর্থ প্রদানের ক্ষেত্রে যে অনিয়ম চিকিৎসকদের কাছে প্রতিয়মান হয়েছে তাঁর প্রতিকার চেয়ে সিভিল সার্জনের কাছে লিখিত আকারে অভিযোগ দায়েরে করেছেন।
২০২০-২০২১ অর্থবছরে গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার (টিআর অবকাঠামোর নগদ অর্থ) উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের রোগীর সহযোগীগনের খাবার স্থান নির্মাণের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার প্রধান সহকারীর মাধ্যমে গ্রহণ করেন। কিন্তু প্রদানকৃত উক্ত অর্থের ব্যবহার কমিটির মাধ্যমে হওয়ার কথা থাকলেও আজ পর্যন্ত কমিটির কোনো কার্যাবলি পরিলক্ষিত হয় নাই বলেও অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যদিকে টিকাদান কর্মকান্ডে নিয়োজিত থাকা স্বেচ্ছাসেবীদের বরাদ্দের টাকা নয়ছয়ে অভিযোগ উঠেছে। কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবী উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ মোছাঃ শামসুন্নাহারের বিরুদ্ধে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইউএনওকে এ অভিযোগ করেছে।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার কার্যালয়ের সূত্রে জানা গেছে, তারাগঞ্জ উপজেলায় পাঁচটি ইউনিয়নের ১৫টি কমিউনিটি ক্লিনিকে ৯১জন মাল্টিপারপাস হেলথ ভলান্টিয়ার রয়েছে। গ্রামে ঘুরে খানা জরিপ, কমিউনিটি ক্লিনিকে রোগী প্রেরণ, স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ করেন। এ জন্য তাদের প্রত্যেক মাসে ৩ হাজার ৬০০ টাকা সম্মানি দেওয়া হয়। এবারে করোনা ভাইরাসের টিকাদান কর্মসূচিতে তাঁরা শুরু থেকে কাজ করেছেন। তারাগঞ্জের করোনার টিকা প্রদানের জন্য পাঁচটি ইউনিয়ন ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ ৮টি বুথ খোলা হয়েছিল। ওই ৮টি বুথে ১৬জন টিকাদান কর্মী ও ৩২জন স্বেচ্ছাসেবী কাজ করেন। টিকাদান বুথে নিয়োজিত স্বেচ্ছাসেবী ও টিকাদান কর্মীর জন্য প্রতিদিন আপ্যায়ন বাবদ ২০০ টাকা বরাদ্দ করা হয়। ৪৮ জনের বিপরীতে মোট ৬ লাখ ৯১ হাজার ২০০ টাকা জুন মাসে উত্তোলন করা হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত ওই টাকা স্বেচ্ছাসেবীদের দেওয়া হয়নি। টাকা দিতে নানা রকম টালবাহানা করছেন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ মোছাঃ শামসুন্নাহার। টাকা চাওয়ায় টিকাদান বুথে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে নিয়োজিত মাল্টিপারপাস হেলথ ভলান্টিয়ারদের চাকুরী চ্যুত্তির হুমকিও দেন। বাধ্য হয়ে স্বেচ্ছাসেবীরা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও রংপুরের সিভিল সার্জনকে অভিযোগ করেন।
ওই অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে, কোভিড-১৯ টিকাদান কেন্দ্রে নিয়োজিত ৩২জন স্বেচ্ছাসেবীর প্রত্যেক জনের জন্য আপ্যায়ন বাবদ ২০০ টাকা করে মোট ৭২ কার্য দিবসের ১৪ হাজার ৪০০টাকা করে বরাদ্দ আসে। কিন্তু গত ১২ আগস্ট ও ১৪আগস্ট স্বেচ্ছাসেবীদের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডেকে প্রতিজনকে চার শত টাকা প্রশিক্ষণ বাবদ এবং এক হাজার টাকা আপ্যায়ন বাবদ গ্রহণ করার জন্য চাপ প্রয়োগ করেন। স্বেচ্ছাসেবীরা আপত্তি জানালে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা স্বেচ্ছাসেবীদের নানা রকম ভয়ভীতি এবং চাকুরিচ্যুতি করার হুমকি দেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক স্বেচ্ছাসেবী বলেন, টাকা নয়ছয় করার ঘটনা ধামাচাপা দিতে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা উঠে পড়ে লেগেছে। ৩০জুন আমাদের নামে বরাদ্দকৃত টাকা উত্তোলন করলেও সেই টাকা আমাদেরকে দেননি। জরুরি মিটিংয়ের কথা বলে ১২ আগস্ট হাসপাতালে আমাদের ডেকে কোনো কিছু না জানিয়ে এক হাজার করে টাকা দিতে চেয়েছেন। আমরা সেই টাকা না নেওয়া নানা রকম হুমকি দেন।
আরও বিশেষ সুত্রে জানা যায় যে উপজেলা স্বাস্থ্যকমপ্লেক্স এর কর্মকর্তা কোভড-১৯ টিকা দান কর্মসূচিতে ভ্যাক্সিন রংপুর থেকে সরকারি এম্বুলেন্সে নিয়ে আসেন ও ইউনিট পর্যায়ে কোভড-১৯ টিকা কেন্দ্রে পোঁছান।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা শামসুন্নাহার বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছে। টিকাদানকর্মী ও স্বেচ্ছাসেবীদের নামে যে বরাদ্দ পেয়েছি, তা ১০৮জনের মধ্যে বিতরণ করে দিয়েছি।’ ইউএনও আমিনুল ইসলাম বলেন, স্বেচ্ছাসেবীদের লিখিত অভিযোগ আজকে হাতে পেয়েছি। উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান বলেন, কয়েকজন স্বাস্থ্যকর্মী বিষয়টি আমাকে জানিয়েছেন। বিষয়টি সমাধানের জন্য আমি স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাকে জানিয়েছি।