রাজধানীর বেশির ভাগ সড়কেই ফুটপাত নেই। যেগুলোতে ফুটপাত আছে সেগুলোর একটি উল্লেখযোগ্য অংশই হকার কিংবা ছিন্নমূলদের দখলে। নির্মাণসামগ্রী রেখে ফুটপাত অবরুদ্ধ করার ঘটনাও অহরহ ঘটছে রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনে। রাজধানীর সড়কগুলোতে ২ হাজার ২৪৩ কিলোমিটার সড়কের বিপরীতে রয়েছে মাত্র ৬৮১ কিলোমিটার ফুটপাত। ফলে নিরাপদে হাঁটার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন নাগরিকরা।
দুই সিটির মোট ৬৮১ কিলোমিটার ফুটপাতের মধ্যে ঢাকা উত্তরে ৪৫০ ও দক্ষিণে ২৩১ কিলোমিটার ফুটপাত। সোজা কথায় ৭০ শতাংশেরও বেশি সড়কে কোনো ফুটপাত নেই। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণে গত তিন বছরে নতুন ১৪৯ কিলোমিটার ফুটপাত নির্মাণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা উত্তরে ১১০ ও ঢাকা দক্ষিণে ৩৯ কিলোমিটার। যে ফুটপাত রয়েছে, তার বেশির ভাগই চলাচলের অনুপযোগী। রাজধানীর ফুটপাতগুলোর বেশির ভাগই পথচারীদের অধিকারে নেই। নগরের ফুটপাতে গড়ে উঠেছে দোকান, ছিন্নমূল মানুষের পলিথিনের ছাপড়া ঘর ও রিকশার অস্থায়ী গ্যারেজ। গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে ফুটপাতের একটি অংশ।
রাজধানীর সদরঘাট, ফুলবাড়িয়া, বঙ্গবন্ধু এভিনিউ, মতিঝিল, দৈনিক বাংলা, পল্টন, জিপিও, বায়তুল মোকাররম, নিউমার্কেট, এলিফ্যান্ট রোড, ফার্মগেট, মগবাজার, মালিবাগ, মৌচাক, কাকরাইল, বাড্ডা, বিমানবন্দর, উত্তরা, মিরপুর, গাবতলী ও মোহাম্মদপুরে এ যেন এক সাধারণ চিত্র। ফুটপাতে যেসব দোকান বসে কিংবা পলিথিনের ছাপড়া ঘর রয়েছে সেখান থেকে পুলিশের কিছু অসৎ সদস্য, স্থানীয় রাজনৈতিক টাউট, মাস্তান নামধারীরা নিয়মিত মাসোহারা পায় এমন অভিযোগ ওপেন সিক্রেট। নগরবিদদের মতে, কোনো নগরীতে সড়কের চেয়ে ফুটপাত থাকবে এক-চতুর্থাংশ এটি সভ্য নগরীর বৈশিষ্ট্য নয়।
ফুটপাতে স্বাচ্ছন্দ্যভাবে চলাচলের সুযোগ না থাকাও অকল্পনীয় বিষয়। ১৭ কোটি মানুষের রাজধানী ঢাকার ২ কোটি মানুষ প্রতি মুহূর্তের সে বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছে। যার অবসান হওয়া উচিত। রাজধানী ঢাকায় পথচারীদের জন্য যে ফুটপাত রয়েছে তা এখন পথচারীদের দখলে নেই। নানা পণ্যের বিকিকিনি চলছে সেই সব ফুটপাতে। হকাররা তাদের পসরা সাজিয়ে পথচারীদের চলাচলে বিগ্ন সৃষ্টি করছে। আর তা নির্বিঘ্নে করা সম্ভব হচ্ছে স্থানীয় সরকার দলীয় নেতা, আইন-ম্যান – আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী অসৎ সদস্য ও সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলরদের যোগসাজশে। হকারদের কাছ থেকে নানা অংকের চাঁদা তুলে নিজেদের মধ্যে ভাগ বাটেয়ারা করে। আর এ চাঁদার পরিমাণ সারা ঢাকায় বিরাট অংকের। শ্যামবাজার, বাহাদুর শাহ-পার্ক, লক্ষ্মীবাজার, গুলিস্তান, পল্টন, মতিঝিল, যাত্রাবাড়ী, জুরাইন, নিউমার্কেট, ফার্ম গেট, মিরপুর, উত্তরাসহ রাজধানীর ৬৫ টি এলাকার ফুটপাতে এসব হকাররা তাদের ব্যবসা করছেন প্রতিদিন চাঁদা দিয়ে। আর এ চাঁদা তোলার জন্য ৩৮ জন লাইন ম্যান রয়েছে। চাঁদা তোলার সময় এসব লাইন ম্যানের সাথে আরো ৫/৬ জন থাকেন। কেউ চাঁদা দিতে অস্বীকার করলে বা গড়িমসি করলে দোকান ভেঙ্গে পসরা রাস্তায় ছিটিয়ে দেওয়াসহ সংশ্লিষ্ট হকারকে শারীরিক ভাবে প্রহার করা হয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, ফুটপাতে হকাররা বিভিন্ন পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসায় পথচারীরা ফুটপাত ব্যবহার করতে পারছেন না। এ কারণে রাস্তায় চলাচলকারী অগণিত পথচারী প্রতিদিন চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। তাছাড়া অবৈধভাবে ফুটপাত দখল করায় যানজটসহ সড়কে সৃষ্টি হচ্ছে আরও নানারকম প্রতিবন্ধকতা।
এছাড়া চাঁদাবাজির কারণে পণ্যমূল্য বৃদ্ধির অভিযোগও দীর্ঘদিনের। কাজেই ফুটপাতের অবৈধ দখল এবং একে কেন্দ্র করে কোটি কোটি টাকার চাঁদাবাজি বন্ধে নিতে হবে কার্যকর পদক্ষেপ। অপ্রিয় হলেও সত্য, দেশে চাঁদাবাজি, দখলবাজি ও টেন্ডারবাজির জন্য দায়ী মূলত রাজনীতির বর্তমান ধারা। হতাশার বিষয় হলো, দেশের কোথাও এটা লক্ষ করা যায় না; বরং প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে মানুষ হয়রানি ও দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে। আমরা মনে করি, ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন শহরের ফুটপাতে অবৈধ চাঁদাবাজির ঘটনাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।
চাঁদাবাজ-সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থ হলে শাসনব্যবস্থা ও আইনের প্রতি মানুষের আস্থা নষ্ট হয়ে যেতে পারে, যা মোটেই কাম্য নয়। এ অবস্থায় ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ সারা দেশে ফুটপাতকেন্দ্রিক চাঁদাবাজি নির্মূলে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে, এটাই প্রত্যাশা।
লেখক: দয়াল কুমার বড়ুয়া: কলামিস্ট ও জাতীয় পার্টি নেতা, সভাপতি, চবি অ্যালামনাই বসুন্ধরা। সংসদ সদস্য প্রার্থী ঢাকা-১৮ আসন।