……………………………………মোঃ আব্দুল মান্নান
প্রাক ইসলামী যুগে নারীর পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে মর্যাদার কোন স্বীকৃতি ছিল না। কন্যা সন্তান জন্মদান ছিল পিতা মাতার জন্য অপমান জনক। কোন সংসারে কন্যা সন্তান জন্ম নিলে বাবা মায়ের মুখ বিবর্ণ হয়ে যেত এবং কন্যা সন্তাকে জ্যান্ত কবর দেয়া হত। মহান আল্লাহ্পাক বলেছেন, “তোমরা তোমাদের সন্তানদের হত্যা করিও না, কারন আমি’ই তাদের রিযিক প্রদান করি।”
আমাদের সমাজে কোন বাবা মা সংসারে পুত্র সন্তানের জন্য পীর ফকিরে মাজার অথবা কবিরাজের সরণাপন্ন হতে দেখা যায়। কন্যা সন্তান জন্ম নিলে পরিবার কর্তৃক স্ত্রীর প্রতি নানান নির্যাতনের ঘটনা ঘটত এবং এখনো এর ব্যতিক্রম খুব একটা কমেনি। ইসলাম ধর্মে কন্যা সন্তান জন্মদানকারী বাবা মাকে ভাগ্যবান ও জান্নাতের সুসম্মানের কথা বলা হয়েছে। প্রাচীন হিন্দু শাস্ত্রে বর্ণনা রয়েছে, মৃত্যু, নরক, আগুন, বিষ ও সাপ এগুলোর কোনটি’ই নারী অপেক্ষা মারাত্মক নয়। এক সময় হিন্দু ধর্মে যুবতী নারীকে প্রতীমার সামনে বলি দেয়া হত দেবতার সন্তোষ্টির জন্য।
বৃষ্টি ও ধন সম্পদ লাভের আশায় মৃত স্বামীর সাথে স্ত্রীকে সহমরণের জন্য “সতীদাহ্ প্রথা” পালন ছিল হিন্দু সমাজের রীতি। নারীকে সকল পাপ, অন্যায় ও অপবিত্রতার কেন্দ্র বা উৎস বলে ঘৃণা করা হ’ত হিন্দু সমাজে। এ ধর্মে নারীকে শয়তানের বাহন বলা হ’ত। নারী বিষধর সাপের ন্যায় পুরুষকে দংশন করতে দ্বিধা করত না, যা হিন্দু সমাজের আদি রীতি ছিল।
এথেন্স বাসীরা সভ্যতার ও সংস্কৃতির ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য প্রাচীনতম জাতি। এরাও নারীকে পরিতক্ত সামগ্রী বলে মনে করত। হাট বাজারে পণ্য হিসাবে প্রকাশ্যে নারীদের কেনা বেচা হত। সন্তান প্রসব, লালন পালন ছাড়া অন্য কোন মানবীয় অধিকার ছিল না নারীর। ইহুদী সমাজে নারীর অবস্থা ছিল আরো ভয়াবহ। কিতুব নামক ইহুদী বাদশা আইন করে ছিল যে, মেয়েকে বিয়ে দেয়া হলে স্বামীর ঘরে যাওয়ার আগে ঐ মেয়েকে বাদশাহ্’র সাথে এক রাত্রী যাপন বাধ্যতামুলক ছিল। খ্রিষ্টানেরাও নারীকে চরম লাঞ্চনার নিন্মতম স্তরে নিমর্জিত করেছিল। তাদের ধর্ম গুরুর মধ্যে অনেকের মতামত ছিল, “ নারী হচ্ছে শয়তানের প্রবেশস্থল এবং নারী সব সময়ই সব অন্যায়ের মুল, সে কারনে নারী থেকে দুরে থাকাই বাঞ্চনীয়।” তাদের মতে নারী হচ্ছে পুরুষের লালসার উদ্রেককারিনী।
সমাজে ও ঘরে সব অশান্তিই হয় নারীর কারনে। সভ্যতার ধ্বজাধারী ইংরেজদের দেশে ১৮০৫ সাল পর্যন্ত আইন ছিল পুরুষ তার স্ত্রীকে বিক্রি করতে পারবে। ৫৮৬ খ্রিঃ ফ্রান্সে এক সম্মেলনে অনেক আলোচনার পর তর্কে-বিতর্কে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, নারী জন্তু বা জানোয়ার নয়, নারীও মানুষ তবে তারা এমন মানুষ যে তারা পুরুষের কাছে নিরন্তর সেবিকা মাত্র বা সেবিকা হয়ে থাকার যোগ্য। গ্রীকরা মনে করত সর্প দংশন করলে তার প্রতিশেধক পাওয়া সম্ভব কিন্ত নারীর দূস্কর্মের প্রতিবিধান একেবারেই অসম্ভব। পারস্যদের মতে নারী হল পৃথিবীতে সব অনিষ্টের মূল কারন। ভারতবর্ষে নারীর অবস্থা অন্যান্য সমাজের তুলনায় অধিক নিকৃষ্ট ছিল। প্রাচীন ভারতের আইন রচয়িতা মনুম হারাজ নারী সম্পর্কে যা বলেছেন,‘‘নারীরা বালিকা হোক, বৃদ্ধা হোক তারা নিজ ঘরেও স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে না। কারন মিথ্যা বলা নারীর স্বভাব ও বৈশিষ্ট্য।
প্রতারনা, ধোকা ও হিংসা, লোভ-পঙ্কিলতা হচ্ছে নারীর স্বভাবগত দোষ। প্রাচীন আরবেও নারী অবস্থা ছিল লজ্জাকর। ঐ সময় নারী যতদিন জীবিত থাকত ততদিন স্বামীর দাস হয়ে থাকত। স্বামীর মৃত্যুর পর অন্যন্য সম্পদের মত উত্তারাধিকারী হিসাবে সংসারে নারীর মালিক হত। সৎ মা বা পিতা অন্য স্ত্রীকে নিজের স্ত্রী বানানো সে সমাজ ব্যবস্থায় কোন প্রতিবাদ বা আপত্তি কোনটাই ছিল না। ক্ষেত্র বিশেষে এ প্রথার প্রচলন অত্যন্ত ব্যপক ছিল। যুগে যুগে নারী জাতির উপর চলত নির্যাতন, মানবিক ও বর্বরোচিত অত্যাচার। পৃথিবীতে ইসলাম ধর্ম আসার পর গোটা বিশ্বের নির্যাতিতা নারীর এ হেন করুন অবস্থা থেকে মুক্তি দিয়ে সমাজে ও রাষ্ট্রে নারীকে সম্মানের আসনে প্রতিষ্টিত করেছে। একমাত্র ইসলাম ধর্মই নারীকে ঘরে-বাইরে মর্যাদাসহ ন্যায্য অধিকার প্রদান ও সম্মানের শিখরে পৌঁছে দিয়েছে। নারীকে বাবার সংসার এবং স্বামীর সংসারে অধিকারী বানিয়েছে ইসলাম ধর্ম। মুছে দিয়েছে ললাটস্থ দীর্ঘকালের অসহায়ত্বের মলিন রেখা। ইসলাম ধর্মই নারীকে সঠিক মর্যাদা ও মানবতার মুল্য দান করেছে। আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বিদায় হজ্বের ভাষণে স্ত্রীদের উপর স্বামীর হক ও দাবি যেরূপ, স্বামীদের উপরও স্ত্রীর হক ও দাবি তদ্রুপ করেছে। নারীর প্রতি সদ্ব্যবহার ও কল্যাণকর ব্যবস্থা সঠিভাবে বজায় রাখার কথা ইসলাম ধর্মেই বলা হয়েছে। যার মাধ্যমে নারীরা যুগ যুগ হতে নির্যাতন, অত্যাচার ও বঞ্চনা থেকে মুক্তি পেয়েছে।
আজ নারীরা সে আদর্শ পরিত্যাগ করে বর্তমান যুগের সাথে তাল মেলাতে আধুনিকতার নামে দূর্গতি ডেকে নিজেদের পায়ে নিজেরাই কুঠারাঘাত করেছে। তারা আধুনিক সভ্যতার ফাঁদে পড়ে নিকৃষ্ট মানসিকতা সম্পন্ন লম্পটদের নির্যাতন ও লালসাবৃত্তির শিকার হচ্ছে। তাদেরকে বাজারের নগণ্য পণ্যের মত ক্রয়-বিক্রয় ও ভোগ করা হচ্ছে। পাশবিক লালসার শিকার বানানো হচ্ছে। তাদের অমুল্য সম্পদ ইজ্জত, আব্রু কেঁড়ে নেওয়া হচ্ছে নির্মমভাবে। এতসব ঘটনার মাঝে নারীরা তাদের এ অবস্থা উত্তরণে নানান দাবী দিয়ে ১৮৫৭ সালের ৮মার্চ নিউইয়ার্কের সেলাই কারখানায় নারী শ্রমিকরা আন্দোলনে নামেন। এরপর ১৮৬০ সালে ৮মার্চ নারী শ্রমিকরা সংঘবদ্ধ হয়ে তাদের দাবী আদায়ের লক্ষ্যে নিজস্ব ইউনিয়ন গঠনে ব্যর্থ হয়। ১৮৮৯ সালে প্যারিসে অনুষ্টিত ১ম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনের নেত্রী ক্লারা জেটকিন পুরুষের পাশাপাশি নারীর সমঅধিকারের দাবি গুলো আরও জোরদার করেন। ১৯০৭ সালে জার্মানীর স্টুটগার্টে অনুষ্ঠিত হয় ১ম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন। ১৯০৮ সালে নিউইয়ার্কের সোশ্যাল ডেমোক্রাট নারী সংগঠনের পক্ষ থেকে আয়োজিত নারী সমাবেশে ক্লারা জেটকিনে’র নেত্রীত্বে আন্তর্জাতিকভাবে ১ম সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ১৯১০ সালে কোপেনহেগেনে ১৭ দেশের ১০০ জন নারী প্রতিনিধি নিয়ে অনুষ্ঠিত হয় ২য় নারী সম্মেলন। ১৯১১ সাল থেকে ৮মার্চ দিবসটিকে “নারীর সমঅধিকার দিবস” হিসাবে পালন করা হয় ক্লারা জেটকিনের নেত্রীত্বে। ১৯১১ সালের ১৯ মার্চ ১ম আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপন করা হয়। এ দিনে সুইজারল্যান্ড, ডেনমার্ক, অষ্টিয়া ও জার্মানীতে লক্ষাধীক নারী মিছিল ও সমাবেশের মধ্যদিয়ে এ দিনটি উদযাপন করে। ১৯১৪ সাল থেকে বেশ কয়েকটি দেশে ৮মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হতে থাকে।
১৯৪৫ সালে সানফ্রান্সিসকোতে “জেন্ডার ইক্যুয়িলিটি” চুক্তিতে নারী অধিকারের যৌক্তিক দিক গুলো বিবেচনায় রেখে স্বাক্ষর করে জাতিসংঘ। ১৯৭৫ সালে জাতিসংঘ ৮মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসকে স্বীকৃতি দেয়ার পথে অনেকটা এগিয়ে যায়। ১৯৭৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ৮মার্চ কে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালনের জন্য উত্থাপিত বিল অনুমোদন পায়। ১৯৮৪ সাল ৮মার্চ কে নারী দিবস ঘোষণা করে জাতিসংঘ।
ঐতিহাসিক সংগ্রামের স্বীকৃতিস্বরূপ জাতিসংঘ এ সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর ২০০৯ এ বিশ্বের ২৯ টি দেশে সরকারী ছুটিসহ প্রায় ৬০ টি দেশে সরকারীভাবে দিবসটি পালিত হয়েছে। ২০১০ সালে বিশ্বজুড়ে নারী দিবস পালন করা হয় ও অভ’তপূর্ব সাড়া মেলে। বিশ্বের অনেক দেশে এখন ৮মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারী ছুটির দিন হিসাবে পালিত হচ্ছে। তবে চীন, মেসিডোনিয়া, মাদাগাস্কার ও নেপালে শুধু মেয়েরাই এ সরকারী ছুটি ভোগ করে থাকে।
অপরাধ সংঘটিত হয় অজান্তেই। শান্তি, শৃঙ্খলা ও কল্যাণের স্বার্থে প্রত্যেকেরই নৈতিকতাকে উজ্জীবিত করা দরকার। সঙ্গীর প্রতি নারীই বেশি সহানুভ’তিশীল। মমতাময়ী হিসাবে নারীর পরিচিতিও বেশ পূরোনো। সঙ্গী বা বন্ধুর অসুস্থ্যতা বা মৃত্যুতে নারীর মধ্যেই বেশি প্রতিক্রীয়া দেখা যায়। নারীর সহানুভুতির মাত্রা পুরুষের তুলনায় অনেক বেশি। নারীর মন অত্যন্ত কোমল ও আবেগ প্রবণ। এসব বিবেচনায় ইসলাম ধর্ম প্রতিষ্ঠার পর থেকে নারীর জন্য যে জীবন ও কাজের দায়িত্ব নির্ধারন করা হয়েছে তা সবই সুনির্দিষ্ঠ ও পরিমার্জিত। ইসলাম ধর্মে নারীর স্বাভাবিক যোগ্যতার মুল্য দেয়া হয়েছে যা অন্য ধর্মে কমই লক্ষ্য করা যায়। একমাত্র ইসলাম ধর্মই নারীকে সকল ক্ষেত্রে ন্যায্য অধিকার দিয়ে সব ধরনের নির্যাতন ও অত্যচার থেকে মুক্ত করে মাতৃত্বের শ্রেষ্ঠ আসনে আসীন করেছে। নারীদেরকে শ্রেষ্ট সুযোগ সুবিধা প্রদান করেছে।
এ ধর্মে কোন কোন ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়েও অধিক সুবিধা দেয়া হয়েছে নারীকে। অথচ অনেক ধর্মে পৈত্রিক সম্পদে নারীর কোন অধিকারই স্বীকার করা হয় না। একমাত্র ইসলাম ধর্মই নারীর মান ইজ্জত ও মর্যাদার ক্ষেত্রে অধিকার ও নিশ্চয়তা দিয়েছে। পৃথিবীতে এর দৃষ্টান্ত বিরল। এ প্রসঙ্গে ড. এ্যানি বেতার বলেছেন, “এক গামিতা প্রচারকারী ধর্মের চেয়ে ইসলাম ধর্মই নারীকে অধিক নিরাপত্তা প্রদান করেছে।” নারী সমঅধিকারের ধ্বজাধারী দেশ ইংল্যান্ডেও মাত্র দু’দশক আগে নারীকে সম্পত্তির অধিকার দানে স্বীকৃতি দিয়েছে।
আমাদের দেশের সরকার প্রধান নারী। জাতীয় সংসদের স্পীকার নারী এবং সংসদের উপনেতাও নারী। ৮মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে নারীর অধিকার সুরক্ষার প্রশ্নে তাঁদের কাছে নারীদের প্রত্যাশা অনেক বেশি। নারীর অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিতকরন ও নারীর প্রতি সকল সহিংসতা বন্ধে সরকারের আরও আন্তরিক ও স্বক্রিয় হওয়া দরকার। যদিও সরকার এ ব্যপারে অগ্রণী ভুমিকা রেখেছে। শুধু আইন পাশ করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেই হবে না, বর্তমান পেক্ষাপটে নারীদিবসের দাবীকে অধিকতর বিবেচনা কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহন অত্যন্ত জরুরী। সমাজে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নৈতিকতা সংস্কারের কর্মসূচী জোরদারকরন জরুরী। প্রচলিত আইন প্রয়োগে প্রশাসনকে আরও কঠোরতা অবলম্বন ও এর পাশাপাশি প্রতিটি ক্ষেত্রে ধর্মীয় অনুভুতি জাগ্রত করার কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহন এখন সময়ের দাবী। নৈতিক, সামাজিক শিক্ষা বর্তমান প্রেক্ষাপটে পুরুষদের জন্য সবচেয়ে জরুরী এমন ধারনা পুরুষদের মাঝে জাগ্রত করতে হবে। আন্তর্জাতিক নারী দিবসে এক সারিতে নারী ও পুরুষ সমমর্যাদায় সমাজে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করবে এটাই প্রত্যাশা।
লেখক ও সাংবাদিক