…………………মোঃ আব্দুল মান্নান

বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ এক ব্যক্তির নেতৃত্বেই হয়েছে। সেই মহান ব্যক্তিটি হলেন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও বিচক্ষণতার মাধ্যমে বাঙ্গালী জাতিকে সুসংগঠিত করে স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর ডাকেই সাড়া দিয়ে বাঙ্গালী জাতি স্বাধীনতার জন্য জীবনদান করেছে এবং সম্ভ্রম হারিয়েছে প্রায় আড়াই লক্ষ মা-বোন। বঙ্গবন্ধু, যিনি বাঙ্গালী জাতির অবিসংবাদিত নেতা, তিনি তাঁর নিজের বহুমুখী প্রতিভা,মানবিক গুণাবলি,উদারতা,বিচক্ষণতা ও সম্মোহনী নেতৃত্বদানের মাধ্যমে তাঁর প্রতি বাঙ্গালী জাতির অকৃত্রিম ভালবাসা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সেই মহান নেতা, বাঙ্গালী জাতির স্বপ্নদ্রস্টা, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ পালনে আনন্দের মুহুর্তে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিল ১৫ আগষ্ট ১৯৭৫ এর সেই নারকীয় হত্যাকান্ডের কথা। যে রাতে বঙ্গবন্ধুকে স্ব-পরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি পরাজিত শাসকদলের প্রেতাত্মারা।


বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রথমেই প্রকাশ্যে প্রতিবাদ জানান বাংলার বিবেক, অধ্যাপক আবুল ফজল “মৃতের আত্মহত্যা” নামক একটি গল্প লিখে। তিনি তাঁর প্রতিবাদের কথা সেই গল্পের মাধ্যমে দেশবাসীকে জানিয়ে দিয়েছিলেন সেই সময়। এ গল্পটি ১৯৭৭ সালে কবি সিকান্দার আবু জাফর প্রতিক্ষিত এবং হাসান হাফিজুর রহমান ও ইসমাইল মোহাম্মদ (উদয় চৌধুরী) সম্পাদিত প্রগতিশীল মাসিক পত্র “সমকালে” প্রকাশিত হয়। ১৯৭৭ সালে এ পত্রিকাটিতেই কবি নির্মলেণ্দু গুণ, বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করেন তাঁর লেখা কবিতা, ”আমি আজ কারো রক্ত চাহিতে আঁসিনি” প্রকাশের মাধ্যমে। এর পরের সংখ্যায় প্রকাশিত হয়, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকে নিয়ে পল্লব ওয়াসির এর লেখা “রাখাল রাজার জন্য” শীর্ষক ২০ লাইনের ছড়াধর্মী গদ্যে। প্রতিবাদী এ সব লেখা প্রকাশের পর সে সময় “সমকাল” হয়ে ওঠে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ ও শ্রদ্ধাঞ্জলীর হাতিয়ার। এ সময়েই সাপ্তাহিক “মুক্তবাণী” ও সাপ্তাহিক “খবর” বঙ্গবন্ধু হত্যার ওপর নিবন্ধ প্রকাশ শুরু করে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী ও বঙ্গবন্ধুপ্রেমী একদল কবি-সাহিত্যিক ও ছড়াকার এ সময় বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে লেখালেখি করতে থাকেন। এদের মধ্যে সূর্য্যতরুণ গোষ্ঠী অতিগোপনে প্রকাশ করে, “এ লাশ রাখবো কোথায়” শীর্ষক একটি সংকলন । এ সংকলনটি খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল।


১৯৮১ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার তীব্র প্রতিবাদী কবি-সাহিত্যিকদের মাঝে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখালেখির মাত্রা বৃদ্ধি পায়। বঙ্গবন্ধুর প্রতি ভালোবাসা,শ্রদ্ধা ও শোক প্রকাশ করতে থাকে অনেকেই তাদের লেখনির মাধ্যমে। প্রকাশ হতে থাকে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কিত বই বাংলা ও ইংরেজিতে। সংস্কৃতি প্রেমীগণ বঙ্গবন্ধুর জীবন কর্ম নিয়ে গান, নাটক ও পূঁথি লেখা শুরু করেন যা এখনও চলমান রয়েছে। ঐ সময়ে অন্তর নিংড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর ছবি এঁকেছিলেন শিল্পী শাহাব উদ্দীন আহম্মদ, কাইয়ুম চৌধুরী, হাশেম খাঁন, আব্দুল মান্নানসহ অনেকেই। তখন কবি-সাহিত্যিকদের লেখা ছড়া, কবিতা সাধারণ পাঠক ও জনগণের মাঝে বেশি গ্রহনযোগ্য হয়েছিল এবং আশাতিরিক্তভাবে সমাদৃত হয়েছিল এসব ছড়া ও কবিতা। এ দেশের নামজাদা কবি-সাহিত্যিক ও ছড়াকারগণ গণমাধ্যমকে বেছে নিয়ে সৃষ্টি করেছিলেন অসংখ্য ছড়া ও কবিতা। কবি সুফিয়া কামাল থেকে শুরু করে পল্লীকবি জসীম উদ্দীনসহ অনেক খ্যাতিমান লেখক ও কবি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লিখেছিলেন সাহিত্যগুণসমৃদ্ধ ছড়া ও কবিতা। শুধু দেশেই নয়,দেশের বাহিরেও অনেক মানবতাবাদী লেখক ও বঙ্গবন্ধু প্রেমী কবি লিখেছিলেন ছড়া ও কবিতা ১৫ই আগস্ট ১৯৭৫ এর নৃশংস হত্যাকান্ডের ওপর। ঐ দূর্দিনে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যারা ছড়া-কবিতা ও প্রবন্ধ রচনায় অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন তাঁরা আজ স্মরনীয় হয়ে আছেন দেশবাসীর নিকট। ইতিহাসের পাতায় তাঁদের প্রতিবাদী এসব লেখা ও নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। তাঁরাই সেই সময় শত ভয়ভীতি ও প্রাণনাশের হুমকী উপেক্ষা করে কলমকে “অসি” হিসেবে ধারণ করেছিলেন এ স্বল্প পরিসরে তাদের নাম লেখা সম্ভব হলোনা।

১৯৭৫ এর নৃশংস হত্যাকান্ডের পর বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ছড়া-কবিতায় কবি-সাহিত্যিকগণ যেমন ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন তাঁদের লেখনির মাধ্যমে,প্রতিবাদ জানিয়ে তেমনি বিনম্র ভাষায় প্রকাশ করেছিলেন তাঁদের হৃদয়ের আর্তি। এদের মধ্যে অনেকের রচনায় ফুঁটে উঠেছিল বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের কথা। বঙ্গবন্ধুকে স্ব-পরিবারে হত্যার পর ঘাতকরা বাংলার বুকে বাঙ্গালী জাতিকে পথভ্রষ্ট করে গোপনে পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে বাঙ্গালী জাতির চেতনাকে অতি অল্প সময়েই ধ্বংস করতে মেতে ওঠেছিল। তারা বঙ্গবন্ধুসহ জাতীয় চার নেতাকে চিরতরে বাংলার বুক থেকে বিদায় করে দেয়। বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা চিরতরে বাংলার বুক থেকে হারিয়ে যান, শত ইচ্ছে থাকলেও তাদেরকে আর কোনদিন ফিরিয়ে পাওয়া সম্ভব নয়।
১৫ আগষ্টের ঐ দিনে দেশে কোন দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ হয় নি এরূপ অপ-প্রচার করা হয়েছিল। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা ছিল, ঐ দিন দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক বাংলা, ডেইলী অবজারভার, দি-টাইমস যথারীতি প্রকাশ হয়েছিল। ঐ দিনে ঘাতকরা দেশে কারফিউ জারী করায় এবং সরকারী নিষেধাজ্ঞার কারণে সাধারণ পাঠক পত্রিকা সংগ্রহ করতে পারে নি, তবে বঙ্গবন্ধুপ্রেমী কয়েকজন সাংবাদিক ও পত্রিকা অফিসের কিছু কর্মী ১৫ আগষ্ট ১৯৭৫ এ প্রকাশিত পত্রিকার কিছু কপি গোপনে সরিয়ে নিয়ে সংরক্ষণ করেছিল, যদিও ঐ দিনে প্রকাশিত পত্রিকাগুলোর সমস্ত কপি ক্ষমতাসীনরা বাজেয়াপ্ত করেছিল। কিন্তু সংরক্ষিত পত্রিকার কপিগুলো থেকে পরবর্তিতে ১৫ই আগষ্টের সংঘটিত ঘটনার প্রকাশিত খবরের বিস্তারিত জানা সম্ভব হয়েছিল।
সত্যি বলতে কি, যে মানুষটি সারা জীবন অমানসিক নির্যাতন ও জুলুম সহ্য করে বাঙ্গালী জাতিকে পরাধীনতার শিকল থেকে মুক্ত করে একটি স্বাধীন দেশ উপহার দিলেন, বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন দেশের জায়গা করে দিলেন সেই মহান মানুষটিকেই স্ব-পরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করলেন পাকিস্তানী সেই পরাজিত শক্তির প্রেতাত্মারা। যারা এরপর ধ্বংস করেছিল এ জাতির কৃষ্টি-কালচার, এ জাতির পরিচিতি। তারা শুধু বঙ্গবন্ধুকে হত্যাই করেনি তারা যেন হত্যা করেছিল সমগ্র বাঙ্গালী জাতিকে, যা বাঙ্গালী জাতি কখনও ভুলতে পারবে না।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভালবাসতেন এ দেশের কবি-সাহিত্যিক ,সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীদেরকে। তাইতো তিনি স্বাধীন দেশের প্রথম বাংলা-সাহিত্য সম্মেলনে তাঁর প্রথম ভাষণে বলেছিলেন, “সুধী বন্ধুরা আমার, আমি জানি, আমাদের মুক্তির আন্দোলনের প্রতিটি ক্ষেত্রে রাজনৈতিককর্মী, মেহনতি মানুষ, কৃষক-শ্রমিক, ছাত্র-জনতা, তরুণ ও এর পাশাপাশি দেশের শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক কর্মীরাও সক্রিয়ভাবে যোগ দিয়েছিলেন। সাংবাদিক ভাইয়েরা জীবনের ঝুঁকী নিয়ে হানাদারদের দ্বারা এ দেশের নির্যাতিত মানুষের নির্যাতনের খবর প্রকাশ করেছিলেন। এসব করতে অনেকে প্রাণও দিয়েছেন। বিশ্বের স্বাধীন জাতিগুলোর মধ্যে আমরা এদিক থেকে গর্ব করে বলতে পারি যে,আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগ্রামে হাতে হাত ধরে অগ্রসর হয়েছিল। এখন যারা সাহিত্য সাধনা করছেন, শিল্পের চর্চা করছেন, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সেবা করছেন, তাদের সাথে দেশের জনগণের যোগসূত্র রয়েছে। তাদেরকে দেশের জনগণের সাথে যোগসূত্র রক্ষা করে অগ্রসর হতে হবে। দেশের জনগণের চিন্তা-ভাবনা, আনন্দ-বেদনা ও সামগ্রীক অর্থে তাদের জীবন প্রবাহ আমাদের সাহিত্যে ও শিল্পে অবশ্যই ফুঁটিয়ে তুলতে হবে। ফুঁটিয়ে তুলতে হবে এ দেশের দূঃখী মানুষের আনন্দ-বেদনার কথা, সাহিত্য শিল্পকে কাজে লাগাতে হবে তাদের কল্যাণে। আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে দূর্নীতির শাখা-প্রশাখা বিস্তার লাভ করছে তা আপনাদের লিখনীর মাধ্যমে তুলে ধরতে হবে এবং দূর্নীতির মুলোচ্ছেদ করতে সরকারকে সাহায্য করতে হবে। তিনি আরও বলেন, আমি সাহিত্যিক নই, শিল্পীও নই, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, জনগণই সকল শিল্প-সাহিত্যের উৎস। জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কোন মহৎ সাহিত্য ও উন্নত শিল্পকর্ম হতে পারে না। আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতি যেন শুধু শহরের পাকা দালানে আবদ্ধ না থাকে, বাংলাদেশের গ্রাম থেকে গ্রামান্তরের কোটি কোটি মানুষের প্রানের স্পন্দন যেন তাতে প্রতিফলিত হয়।“ বঙ্গবন্ধু কতৃক কবি –সাহিত্যিকদের প্রতি এ ভাষণই যেন ১৯৭৫ এর ১৫ই আগষ্টের নৃশংস হত্যাকান্ডের প্রতিবাদী হতে কবি-সাহিত্যিক, শিল্পী, সাংস্কৃতিক কর্মী ও সাংবাদিকদেরকে অনুপ্রাণিত করেছিল। তাই, তারা লেখনীর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুসহ স্ব-পরিবারের হত্যাকান্ডের ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন অন্তর নিংড়িয়ে। বঙ্গবন্ধুর প্রতি কবি-সাহিত্যিকদের ভালবাসাই তাদেরকে ঐ ক্রান্তিলগ্নে এ সাহস যুগিয়েছিলেন।
ইতিহাস সত্যিই নির্মম। খুনিদের কেউই রক্ষা করতে পারে না। বঙ্গবন্ধুর খুনিরাও রক্ষা পায় নি। মুক্তিযুদ্ধের বিভ্রম বানানো ইতিহাস দূর হয়েছে। সংবিধান পূণঃস্থাপিত হয়েছে। সত্যের জ্যোতি সূর্যের আলোর চেয়েও প্রখর। সত্যকে ধামা চাপা দিয়ে রাখা যায় না। তাই বলা হয়, বঙ্গবন্ধু বাংলার আকাশে চিরকাল সত্যবান জ্যোতি হিসেবে বিরাজ করবে আর আমরা বাঙ্গালী জাতি হবো জ্যোতির্ময়। শোকের মাসে তাই কবির ভাষায় স্মরণ করি-

পল্লীকবি জসীমউদ্দীন তাই তাঁর লেখা কবিতায় বলেছেনঃ-
মুজিবুর রহমান,
ওই নাম যেন বিসুভিয়াসের অগ্নীউগারীবান,
বঙ্গদেশের প্রান্ত হতে সকল প্রান্ত ছেঁয়ে,
জ্বালায় জ্বলিয়ে মহাকালানল মহা অশিনী বেঁয়ে,
বিগত দিনের যত অন্যায়-অবিচার ভরা যার,
হৃদয়ে-হৃদয়ে সঞ্চিত হয়ে সহ্যের অঙ্গার,
দিনে দিনে হয় বর্দ্ধিত,স্ফীত,শত মজলুম বুকে,
দগ্ধিত হয়ে শত লেলিহান দিন প্রকাশের মুখে,
তাহাই যেন বা প্রসূত হয়ে জ্বলন্ত শিখা ধরি,
ওই নামে আজ অশিনী দাপটে ফিরিছে ধরনী–ভরি।

লেখক- কলাম লেখক ও সাংবাদিক

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে