………………..মোঃ আব্দুল মান্নান
পৃথিবীর সকল সৃষ্টির মাঝে মানুষই একমাত্র উৎকৃষ্ট প্রাণী। মানুষ আশরাফুল মাকলুকাত বা সৃষ্টির সেরা জীব। অনেকের মতে পৃথিবীতে মানুষই হলো বুদ্ধিজীবি। বিদ্যা বুদ্ধির সাথে যাদের শ্রম জড়িত বর্তমানে তাদেরকেই বুদ্ধিজীবি হিসেবে গণ্য করা হয়।
বুদ্ধিজীবি শব্দটির জনপ্রিয়তায় আজকাল কিছুটা হলেও ভাটা পড়েছে। কোন সমাজ বা জাতিকে ক্রমশঃ উন্নতি ও প্রগতির পথে এগিয়ে নিতে বুদ্ধিজীবিগণই গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রাখেন। কেন না বুদ্ধি আর বিবেক হলো মানুষের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। এ দুটির যথাযথ বিনিয়োগের মাধ্যমে মানুষ নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয়। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিবেক মানুষের আবেগকে প্রশমিত করার মাধ্যমে মানুষকে যাচাই-বাছাই করার সু্যোগ দেয়। কিন্তু অন্যান্য প্রাণীর মাঝে বিবেক না থাকায় তারা বলগাহীনভাবে আক্রমণ করে অন্য সকল প্রাণীকে যদিও তাদের মাঝে অনুভূতি রয়েছে। আর অনুভূতি আছে বলেই অন্যান্য প্রাণী পানাহার করে, ও প্রভূ ভক্তির প্রকাশ ঘটায় এবং সন্তান বাৎসল্য প্রদর্শন করে থাকে। মানুষের মাঝে যখন বিবেক কাজ করে না তখন মানুষও প্রাণী সাদৃশ্য আচরণ করে থাকে। এ সময়ে মানুষের বিবেক নির্বাসিত হয়ে থাকে এবং সে কারণে তখন মানুষের মাঝে পশুত্ব এসে বাসা বাঁধে। অপমানিত হতে থাকে মানুষের বিবেক,বুদ্ধি। পশু আর মানুষের মাঝে তখন আর কোন পার্থক্য থাকে না, তারা এক সারিতে দাঁড়িয়ে যায়। ঠিক তখনই মানুষকে আর বুদ্ধিদীপ্ত প্রাণী বলা যায় না।
আমাদের সমাজে বুদ্ধিজীবি ও সাধারণ মানুষের মাঝে পার্থক্য নিয়ে সংশয় সবসময়ই থাকে। লেখক, শিল্পী, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, উকিল ও শিক্ষাবিদগণকে আমরা বুদ্ধিজীবি হিসেবে জানি বা বুঝি। সুনির্দিষ্ট পেশাজীবি বা বিশেষ গোষ্ঠির মানুষকে বুদ্ধিজীবি বলা যায় না। তবে স্বাভাবিক প্রকৃতির মানুষই বুদ্ধিজীবি শ্রেণীর অন্তর্গত। প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থ ও সবল মানুষই বুদ্ধিজীবি। সুশিক্ষিত ব্যক্তিরাও কিন্তু নিঃসন্দেহে বুদ্ধিজীবি হওয়ার যোগ্যতা রাখেন। তবে শুধু ডিগ্রী অর্জনই বুদ্ধিজীবি মানুষের একমাত্র পরিচয় হতে পারে না। যে শিক্ষা নৈতিক শিক্ষা প্রদানে অপারগ, যে শিক্ষা মনুষত্ববোধের উন্মেষ ঘটায় না, সে শিক্ষা নিছক অর্থহীন ডিগ্রীর শোভাবর্ধন ছাড়া আর অন্য কোন কল্যাণ সাধন করতে পারে না। যে কারণে শুধু ডিগ্রী অর্জনই বুদ্ধিজীবি মানুষের একমাত্র পরিচিতি হতে পারে না। আসল কথা হলো বুদ্ধিজীবি ব্যক্তির মধ্যে মানবীয় গুনাবলী থাকা অত্যন্ত প্রয়োজন রয়েছে। সত্যবাদী বা সত্যের সাধক হওয়া, ন্যায়পরায়ন ও নিরপেক্ষ হওয়া, উদার মনমানসিকতা সম্পন্ন হওয়া এবং আপোষহীন ও দৃঢ়চেতা হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে বুদ্ধিজীবির। এসব আচার-আচরণের মানুষ যখন উল্লেখিত বৈশিষ্টের বিকাশ ঘটাতে সক্ষম হন তখনই তাঁদের মাঝে প্রস্ফুটিত হয় প্রকৃত বুদ্ধিজীবির চরিত্রের।
বুদ্ধিজীবিগণ জাতির অমূল্য সম্পদ স্বরুপ। এ সম্পদ হিরকের চেয়েও দামী। খাঁটি দুধের সরের সাথে তাঁরা তুলনীয়। যারা জাতির নিকট এত মর্যাদাশীল, জাতির যে কোন সংকটে সেই বুদ্ধিজীবিগণের দায় দায়িত্ব নিয়ে আজকের এ লেখা। বুদ্ধিজীবিগণের প্রধান পরিচয়, তারা সমাজের বুদ্ধিবৃত্তির প্রতিনিধিত্ব করেন। সমাজের প্রগতিশীল অবকাঠামো প্রণয়নে বুদ্ধিজীবিগণ অকৃপনভাবে সতত তাঁদের মেধা ও মননকে বিনিয়োগ করে জাতি গঠনে ও রাষ্ট্র পরিচালনায় নানাবিধ নীতি-নির্দ্ধারণ ও প্রজ্ঞাময় অভিমত জাতি ও দেশবাসির সামনে তুলে ধরেন। তাঁরা শুধু কথা ও কলমেই তাঁদের দায়িত্ব শেষ করেন না, তাঁদের গৃহীত সমস্ত নীতিমালা, মুল্যবান মূল্যবোধ সমূহ প্রতিষ্ঠায় প্রয়াশীত হন। এক কথায় বুদ্ধিজীবিগণ হচ্ছেন মানুষের কল্যাণে সর্বদা নিবেদিত প্রাণ। তাঁরা সত্যের অন্বেষা ও সুন্দরের প্রতিষ্ঠায় পালন করে থাকেন মহানব্রত । এক কথায় বুদ্ধিজীবিগণই হচ্ছেন জাতির মেধা ও মননের প্রতীক। বলতেই হয়, বুদ্ধিজীবিহীন জাতি মস্তিষ্কবিহীন দেহের মতই অসাঢ় ও অকেঁজো। বুদ্ধিজীবিরা কোন দল বা গোষ্ঠীর হন না, তাঁরা সবার। তাঁদের স্বাতন্ত্র রাজনৈতিক মতাদর্শ থাকতে পারে। কিন্তু বুদ্ধিজীবিরা কোন বিশেষ রাজনৈতিক দলের তাবেদার বা আজ্ঞাবহ হন না। বুদ্ধিজীবিদের চরিত্র নির্মল ও নিরপেক্ষ হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবিদের আদর্শ ও নীতি এ ক্ষেত্রে কতটুকু বাস্তবসম্মত তা নিয়ে অবশ্য জনমনে অনেক প্রশ্ন ! বুদ্ধিজীবির বিবেচনায় দেশের সকল মানুষ হয়ে ওঠে স্বজন। বুদ্ধিজীবিদের সব চিন্তা-চেতনা আবর্তিত হয় দেশপ্রেম ও মানবপ্রেমকে ঘিরে। দেশের সার্বিক উন্নয়ন ভাবনাই হলো বুদ্ধিজীবিদের প্রধান অভিপ্রায়। সামষ্টিকস্বার্থে নিবেদিত জাতীয় কল্যাণে ও চেতনায় উন্মেষ ঘটানোর প্রচেষ্টার মাঝে সবার শ্রদ্ধা ও ভালবাসা অর্জনের মাধ্যমে বুদ্ধিজীবিরা জনম জনম ধরে স্মরণীয় ও বরনীয় হয়ে থাকেন। অন্যদিকে কেউ তাঁদের চিন্তা-চেতনায়,আচরণে বুদ্ধিজীবি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে ব্যর্থ হলে বলতে হয় এ হলো তার জন্য চরম পরাজয়। আমাদের দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে বুদ্ধিজীবিগণ এ বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখবেন,সর্ব সাধারণের এটাই প্রত্যাশা।
লেখক: কলামিস্ট ও সাংবাদিক