ডেস্ক রিপোর্টঃ ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে গঙ্গা নদীর পানি ভাগাভাগির বিষয়ে যে চুক্তি হয়েছিল,তার কুড়ি বছর পূর্ণ হলো আজ সোমবার।
১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের তখনকার প্রধানমন্ত্রী এইচ ডি দেবেগৌড়া ত্রিশ বছর মেয়াদী এই চুক্তি সই করেন।
ভারত পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে ফারাক্কা বাঁধ নির্মানের কারণে ভাটিরদেশ বাংলাদেশ প্রয়োজনীয় পানি না পাওয়ায় যে সংকট তৈরি হচ্ছিল, তা থেকে মুক্তির জন্যই এই চুক্তিটি হয়েছিল।
কথা ছিল দুই দেশ ন্যায্যভাবে পানি ভাগ করে নেবে।
কিন্তু প্রায়ই এই অভিযোগ করা হয় যে চুক্তি অনুযায়ী পানি পায়নি বাংলাদেশ। কুড়ি বছর পরে এসে এই চুক্তির বিষয়ে পদ্মা নদী এলাকার মানুষেরা কী বলছেন?
আর পানির ভাগ পাওয়ার যে কথা ছিল তা কতটা মিলছে?
হারিয়ে গেছে নদী–কেন্দ্রীক পেশা
রাজশাহীর কাজলাঘাট এলাকায় এক সময় অনেক জেলে পরিবার বাস করতো। নদীর মাছ ধরে বাজারে বিক্রী করাই ছিল যাদের পেশা।
কিন্তু এখন নদীতে মাছ ধরা ছেড়ে অনেকেই বেছে নিচ্ছেন অন্য নানা পেশা।
এমনই একজন মোঃ মহসিন মিয়া। বাবা-দাদার পেশা ছিল মাছ ধরা।
শুরুতে মাছই ধরতেন। তবে এখন চা-পান-বিড়ি-চিপস ইত্যাদি নিয়ে দোকানদারি করছেন।
কাজলা ঘাটে ঢোকার মুখেই তার দোকানে কথা হচ্ছিল মহসিন মিয়ার সাথে।
তিনি বলেন, “বাপ-দাদা মাছ ধরতো। আমিও ১৫ বছর মাছ ধইরছি। কিন্তু নদীটা শুকায়ে গেল। মাছ আর হয় না। বাধ্য হইয়া যে কোন কর্ম করতে লাগলাম। বাধ্য হইয়া দোকান দিলাম। ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে দিল আর নদীটা শুকাতে লাগলো।”
রাজশাহী, পাবনা কিংবা ঈশ্বরদীতে পঞ্চাশোর্ধ জেলেদের অনেকের সাথেই কথা হয়।
তারা জানান গত ২০/২৫ ব্ছর ধরে নদীর পানি কমতে থাকায় তারা পিতৃপুরুষের পেশা মৎস শিকার ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন।।
‘আগের নদীর গর্জন নেই‘
নদী বিষয়ে কথা শুরু করতেই স্মতিচারণ শুরু করে দেন এক সময় নদীকে কেন্দ্র করে জীবিকা চালানো মানুষেরা।
আগে জেলে পেশায় ছিলেন এমন একজন বলেন, “আগে তিন মাইল দূর থেকে ডাক শোনা যেত নদীর। ছাকনা দিয়ে ইলিশ ধরা হতো। অনেক সময় উপরেও উঠে যেত”।
আরেকজন বলেন, “আগে নদীতে বিভিন্ন ধরনের মাছ পাওয়া যেত। সব ধরনের মাছই ছিল। রাজশাহী থেকে নবাবগঞ্জ, খোলাবুনা, বাবলাবুনা, ক্যাডেট কলেজ এইসব এলাকায় মাছ ধরতাম”।
‘বাংলাদেশের ক্ষতির পরিমাণ বেশি’
রাজশাহী শহরের গায়ের সাথে জড়িয়ে আছে পদ্মা। কিন্তু নদীর তীর ধরে চলতে থাকলে চোখে পড়ে বিশাল এলাকাজুড়ে চর ।
‘টি বাঁধ’ নামে পরিচিত একটি শহররক্ষা বাঁধ থেকে ট্রলারে করে চরে পৌঁছে দেখা যায় বহু লোক সেখানে বৈকালিক ভ্রমণে এসেছেন।
চরে দাড়িয়ে কথা হচ্ছিল নদী গবেষক এবং লেখক মাহবুব সিদ্দিকীর সাথে।
তিনি বলেন, “এই চুক্তির ফলে বাংলাদেশের উপকার যা হয়েছে, ক্ষতি হয়েছে বেশি। নদীকে ঘিরে পেশা ছিল এমন মানুষেরা গ্রামকে গ্রাম থেকে উচ্ছেদ হয়ে গেছেন, ইকোসিস্টেম নষ্ট হয়ে গেছে। অনেকে দেশ ছেড়ে গেছে”।
নদীর বুকে চাষ
ঈশ্বরদী রেল স্টেশনের সাথে হার্ডিঞ্জ ব্রীজের নিচে দেখা গেল অনেকটা এলাকাজুড়ে নদীর বুকে আঁখ, গাজর আর ফুলকপির চাষ হচ্ছে।
পাবনার রূপপুর গ্রামের মজিবুর রহমান জানান, “নদীর পানি কমে যাওয়ায় বছরের প্রায় দুই মাস বাদ দিয়ে বাকিটা সময় অনেকেই নানা ধরনের সবজির চাষাবাদ করেন”।
গঙ্গা নদী যেটি বাংলাদেশে পদ্মা নামেই সুপরিচিত, সেই নদীর পানি বাংলাদেশ ও ভারত প্রতিবেশী দু’টো দেশই যেন ভাগ করে নিতে পারে সেজন্যই ঠিক কুড়ি বছর আগে দুই দেশের সরকার পানি ভাগাভাগির চুক্তিটি করেছিল।
কারণ কলকাতা বন্দরের নাব্যতা রক্ষার কথা বলে ভারত পশ্চিমবঙ্গের ফারাক্কায় গঙ্গার ওপর বাঁধ দেয়, যা চালু করা হয় ১৯৭৫ সালে
এর ফলে শুকনো মৌসুমে বাংলাদেশের ভেতরে পদ্মায় পানি কমে আসে আবার বর্ষা মৌসুমে দেখা যায় উল্টো চিত্র ।
তখন ভারতের উজান থেকে আসা অতিরিক্ত পানি বাংলাদেশে ঢুকে তৈরি হয় বন্যা।
গঙ্গা চুক্তির উদ্দেশ্য ছিল শুষ্ক মৌসুমে প্রতি বছর ১লা জানুয়ারি থেকে ৩১শে মে পর্যন্ত ১০ দিনের চক্র করে দুই দেশ পানি ন্যায্যভাবে ভাগ করে নেবে।
কিন্তু চুক্তির কুড়ি বছর পরে এসেও পানি নিয়ে কেন এই হাহাকার?
‘পার হয়ে যায় গরু পার হয় গাড়ি’
হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে নিয়মিতভাবে পানির প্রবাহ পরিমাপ করা হয়।
রোববার পর্যন্ত প্রবাহ পরিমাপ করা হয়েছে ১লাখ ২৪ হাজার কিউসেক।
তার আগের দিন অর্থাৎ শনিবার তা ছিল প্রায় ১লাখ২৬ হাজার কিউসেক।
এমনটাই জানিয়েছে পাবনার পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা।
ভারত থেকে বন্যার কারণে পানি ছাড়ায় গতবারের চেয়ে প্রবাহ এবার অনেক বেশি বলে তারা স্বীকার করেন।
এমন প্রেক্ষাপটে পানি ধরে রাখতে গঙ্গা ব্যারেজ নির্মাণের প্রয়োজনীয়তার কথাবার্তা বিভিন্ন মহলে বলা হলেও, পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক কর্মকর্তা মি. সিদ্দিকী বলছেন, এই অঞ্চলের জন্য সেটি হবে উচ্চাভিলাষী প্রকল্প।
কিন্তু পানির অভাবে সেচ কাজ চালাতে না পেরে বিপন্ন হয়ে পড়েছেন পদ্মা তীরের বহু এলাকার মানুষ।
তাদের সহায়তা দেয়ার জন্য একসময় চালু করো হয় গঙ্গা-কপোতাক্ষ প্রকল্প।
সেই প্রকল্পের একজন কর্মকর্তা ওবায়দুল্লাহ সিদ্দিকী বলেন, প্রকল্পটি বেশ গতি নিয়ে শুরু হলেও পানির অভাবে তাও মুখ থুবড়ে পড়ে।
তিনি বলেন, “চুক্তি অনুযায়ী পানি পায়নি বাংলাদেশ।
চুক্তি করার কারণে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও বিষয়টি তুলে ধরতে পারছে না বাংলাদেশ, বলেন তিনি।
এক সময় পদ্মার নদীপথে অসংখ্য ছোটবড় জাহাজ এবং মাছধরার নৌকা দিনরাত চলতো ।
কিন্তু এখন শুষ্ক মৌসুমে প্রায় সাড়ে তিনশো’ কিলোমিটারের বেশি নৌপথ বন্ধ রাখতে হয়।
রাজশাহী ছাড়াও কুষ্টিয়া, পাবনা, ঈশ্বরদী, রাজবাড়ী, ফরিদপুরসহ বিভিন্ন দিকে বিভিন্ন নামে প্রবাহিত হয়েছে পদ্মা নদীর শাখা-প্রশাখা ও উপনদী।
কিন্তু বিভিন্ন শাখানদী এরই মধ্যে রয়েছে হুমকিতে। কুষ্টিয়ায় গড়াই নদী তেমনই একটি নদী।
মিস্টার সিদ্দিকী বলেন, পদ্মায় প্রয়োজনীয় প্রবাহ না থাকার কারণে তার প্রভাবে ছড়িয়ে পড়ছে লবণাক্ততাও।
এলাকাটিতে সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেল, এখানকার লোকজনের মধ্যে যারা কিছুটা হলেও খোঁজখবর রাখেন তারা মনে করেন, পানির দাবি আদায় করতে রাজনৈতিক ভাবে ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ।
গঙ্গা চুক্তির বাদবাকি ১০ বছরে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী পানি বাংলাদেশের কর্তাব্যক্তিরা বন্ধুপ্রতীম দেশের কাছ থেকে কতটা আদায় করতে পারবেন, সেদিকেই তাকিয়ে আছেন পদ্মা তীরের মানুষেরা।
বি/বি/সি/এন