মাদক ব্যবসা আড়াঁল করতে মোছা: শিরিন আক্তার (৩৪) নামে এক নারীকে আটকে রেখে মধ্যযুগীয় কায়দায় খুটির সঙ্গে বেঁধে নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে। ঘটনাটি ঘটেছে ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার দক্ষিণ বিয়ারা গ্রামে। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও সচেতন মহলে মিশ্রপ্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে।
তবে নির্যাতনের ঘটনাটি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে নির্যাতিত নারীকে বেধরক মারধর করে ৭ মিনিট ১৭ সেকেন্ডের একটি ‘মেকিং’ ভিডিও ধারণ করা হয়। পরে ওই ভিডিও ‘শিশু অপরণ নাটক’ সাজিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল করারও অভিযোগ করেছেন নির্যাতিত নারীর বাবা আ: সালাম ও মা রমিজা খাতুন।
এ ঘটনায় বুধবার (২১ ডিসেম্বর) জেলার সিনিয়র জুডিশিযাল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা দায়ের করা হয়েছে বলে জানান আ: সালাম।
তবে মামলাটি আমলে নিলেও বিজ্ঞ বিচারক এ সংক্রান্ত মেডিকেল রির্পোট খতিয়ে দেখে আদেশ দিবেন বলে জানিয়েছেন জেলা জজ আদালতের আইনজীবী অ্যাডভোকেট খন্দকার লুৎফর রহমান নীলু।
এর আগে গত ১৫ ডিসেম্বর উপজেলার বালিপাড়া ইউনিয়নের দক্ষিণ বিয়ারা গ্রামের একাধিক মাদক মামলার আসামি মো: শফিকুল ইসলাম ওরফে পাতলা খানের বাড়িতে এই লোমহর্ষক নির্যাতনের ঘটনা ঘটে।
এ সময় নির্যাতিত নারীর অসহায় বাবা-মা কোন উপায় না পেয়ে জাতীয় জুরুরী সেবা ৯৯৯ নাম্বারে কল করে ঘটনাটি পুলিশকে জানায়। এরপর ত্রিশাল থানার উপ-পরিদর্শক (এস.আই) ঈসমাইল হোসেন ঘটনাস্থল থেকে মারাত্মক আহত অবস্থায় শিরিনকে উদ্ধার করে বলে নিশ্চিত করেন খোদ এই পুলিশ কর্মকর্তা।
তবে এবিষয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মঈন উদ্দিনের অনুমতি ছাড়া কোন ধরনের বক্তব্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন এস.আই ঈসমাইল হোসেন।
নির্যাতিত নারীর বাবা আ: সালাম জানান, এ ঘটনার পর আমার মেয়েকে উপজেলা হাসপাতালে ভর্তি করে থানায় মামলা করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু থানা পুলিশ মামলা নেয়নি।
ভাইরাল ভিডিওতে দেখা যায়, পাতলা খানের স্ত্রী হোছনে আরার কাছে বার বার পানি খেতে চাইছেন নির্যাতিত শিরিন। কিন্তু হোছনে আরা তাকে পানি না দিয়ে বলানোর চেষ্টা করছে- বল, তুই কত টাকার জন্য আমার শিশু ছেলেকে অপহরণের চেষ্টা করছিস। তখন শিরিন তাদের শেখানো মতে বলছে- হ আমি অপরহণ করছি, দুই হাজার টাকার জন্য। আমাকে মাফ কর। আমাকে পুলিশে দেও।
কিন্তু শিরিনের কোন কথা না শুনেই এভাবেই টানা ৭মিনিট ১৭ সেকেন্ড মেকিং ভিডিও করে হোছনে আরা ও তার সাথে থাকা লোকজন। এই ভিডিও শেষ পর্যায়ে হোছনে আরা আরও বলেন, বল- তুই হেইদিন (সেদিন) কেন লোক (ডিবি পুলিশ) আনছিল আমাদের ধরানোর জন্য। এখন বল, তরে কি আমাদের কেউ মারছে ? না, তুই নিজেই নিজের শরীলে মারছস ? তখন শিরিন বলতে থাকে- হ, আমি মারছি আমার শরীলে, আমারে কেউ মারছে না।
এভাবেই বলিয়ে বলিয়ে শিরিনের ভিডিও ধারণ করে স্বীকারোক্তি নেয় হোছনে আরা ও তার লোকজন।
স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, শফিকুল ইসলাম ওরফে পাতলা খানের বাবা মৃত আ: মন্নাছ ছিলেন হতদরিদ্র ছাতা মেরামত কারিগর। গ্রামে গ্রামে ঘুরে তিনি ছাতা মেরামতের কাজ করে সংসার চালাতেন। বাবা মারা যাবার পর ছেলেও শফিকুল চা দোকান করত। তবে গত ৭ থেকে ৮ বছর আগে সে ঢাকায় গিয়ে ফলের ব্যবসার আড়াঁলে মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে সে কোটি টাকার মালিক। গড়েছেন বিলাসবহুল বাড়ি, গাড়ী ও বিত্তবৈভব। বাড়ির চারপাশে লাগিয়েছেন সিসি ক্যামেরা।
তবে মাদক ব্যবসার কারণে একাধিকবার সে পুলিশের হাতে ধরা খেয়ে জেল খেটে ফেঁসেছেন বেশ কয়েকটি মাদক মামলায়।
জানা যায়, প্রায় মাসখানেক আগে শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসার অভিযোগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বরাবরে ডাকযোগে একটি অভিযোগ প্রেরণ হয়। এ ঘটনার খবর প্রকাশ হবার পর বালিপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বাদল গত গত ৪ ডিসেম্বর শিরিন আক্তারকে সন্দেহ করে তাকে ফোন করে ইউনিয়ন পরিষদে ডেকে নিয়ে শালিস বসায়। সেখানে একটি সাদা কাগজে শিরিনের স্বাক্ষর নিয়ে একটি অঙ্গীকারনামা নেয়।
তাতে লেখা হয়- শালিসে উত্থাপিত অভিযোগের কর্মকান্ড আমি আর কোনদিন করব না। করিলে আমার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহন মেনে নিতে বাধ্য থাকিব। ওই অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষী হিসেবে স্বাক্ষর করেন মো: ঈসমাঈল হোসেন, আ: বাতেন রতন ও দেলোয়ার নামের এক ব্যক্তি।
এবিষয়ে জানতে চাইলে বালিপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বাদল ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, শিরিন মিথ্যা অভিযোগে মানুষকে হয়রানি করার প্রমাণ শালিসে মিলেছে। তাই তার অঙ্গিকারনামায় স্বাক্ষর নিয়েছি।
এ সময় শফিকুল ইসলামের মাদক ব্যবসা সর্ম্পকে জানতে চাইলে চেয়ারম্যান বলেন, আগে মাদক ব্যবসা করলেও এখন শফিকুল ভালো হয়ে গেছে। এক সময় শফিকুল বাদাম বিক্রি করেছে, চা দোকান করেছে- আমি দেখিছি। কিন্তু এখন সে অনেক টাকার মালিক। তবে কিভাবে সে এত টাকার মালিক হয়েছে, তা বলতে পারব না।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ত্রিশাল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মঈন উদ্দিন বলেন এ ঘটনায় থানায় মামলা করতে কেউ এখনো পর্যন্ত আসেননি বলেও জানান ওসি মঈন উদ্দিন।