বিডি নীয়ালা নিউজ(২৭জানুয়ারি১৬)- কৃষি প্রতিবেদনঃ মাইমোসা বা লজ্জাবতী অনেকটা লতা জাতীয় উদ্ভিদ। আমাদের দেশে অম্লভাবাপন্ন (এসিড সয়েল) মাটিতে এক জাতের কাটাযুক্ত লজ্জাবতী অহরহ লক্ষ্য করা যায়। এগুলো আকারে অনেটা ছোট। লজ্জাবতী অতি স্পর্শ কাতর। কোন ভাবে নাড়া দিলে ছড়ানো পাতা একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। এর প্রভাবে অনেক সময় মশা বা ক্ষুদ্র আকৃতির পোকা-মাকড় পাতা বন্ধ হয়ে যাওয়ার চাপে মারা যায়। অন্যান্য ডাল জাতীয় ফসলের মতো লজ্জাবতীর শিকড়ে ‘নডিউল’ গঠন হয়। ফলে মাটিতে প্রাকৃতিক ভাবে নাইট্রোজেন ও জৈব পদার্থ সরবরাহ করায় মাটির উর্বরতা বাড়ে। মাইমোসা বা লজ্জাবতীর লতাপাতা ও ফুলফল পুষ্টিতে অতি সমৃদ্ধ। এতে রয়েছে যথেষ্ট পরিমাণ প্রোটিনসহ সব ধরণের খাদ্য উপাদান। বিশেষ করে ইহা ভিটামিন-এ, ক্যালসিয়াম, আয়রন,পটাশিয়াম ও নিয়েসিনে ভরপুর। থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ায় সালাদ, সবজী ও নানা প্রকার সুপ হিসাবে ‘মাইমোসা’ আহারের প্রচলন খুব জনপ্রিয়। আফ্রিকার অনেক অধিবাসী চা ও কফির বিকল্প হিসাবে মাইমোসার লতা-পাতা, ফুল ও কচি ফলের নির্যাস পান করে থাকে। ইন্দোনেশিয়ায় ‘জায়েন্ট মাইমোসা (কাঁটাবিহীন)’ মহিষের ফডার হিসাবে ব্যবহার প্রচলন আছে। ‘ওয়াটার মাইমোসা’র শিকড় ও কচি পাতা – শিং, মাগুর, কৈ, তেলাপিয়া ও অনুরুপ মাছের প্রিয় খাবার। অনেক দেশে মাইমোসার যথেষ্ট চাহিদা আছে। চট্রগ্রামের কয়েকজন ব্যবসায়ী আমাদের দেশের লজ্জাবতীর লতা-পাতা সংগ্রহ করে তা শুকিয়ে জাপানে রপ্তানি করে থাকে। ঔষুধি গুনাগুণঃ লজ্জাবতীর ঔষুধি গুনাগুণ অত্যন্ত বেশী। নানা রোগের চিকিৎসায় হারবাল মেডিসিন তৈরীতে এর ব্যবহার যুগযুগ ধরে চলে আসছে। নাক, কান, দাঁত ও ক্ষুদ্রনালীর ঘাঁ সারাতে লজ্জাবতীর শিকড় লতা-পাতার ব্যবহার দেশে বিদেশে বহুল প্রচলিত। জন্ডিস, এ্যাজমা, টিউমার, হুপিংকফ, চর্মরোগ, ডায়াবেটিক্সসহ, হার্ট, লিভারের নানা রোগ সারাতে মাইমোসার ঔষধি গুনাগুণ খুব বেশী। মাইমোসার উৎপত্তি স্থানঃ অনেকে মনে করেন মেক্সিকো লজ্জাবতীর উৎপত্তি স্থান। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া, আমেরিকার উত্তর-দক্ষিণ কোষ্টাল বেল্টে আফ্রিকার অনেক দেশে ও অষ্ট্রেলিয়ায় প্রচুর লজ্জাবতী দেখা যায়। ট্রপিক ও সাব-ট্রপিকের আওতাধীন সব দেশে লজ্জাবতী ভাল জন্মে। ভারতের রাজস্থানে বিভিন্ন বাগানে কভার ফসল হিসাবে ও গ্রীন ম্যানুয়ারিং ফসল হিসাবে চাষ প্রচলন আছে। জাতঃ পৃথিবীতে অনেক রকম জাতের লজ্জাবতী দেখা যায়। তবে জায়েন্ট মাইমোসা (কাঁটাবিহীন লজ্জাবতী) ডাঙ্গায় এবং ওয়াটার মাইমোসা অগভীর পানিতে চাষের প্রচলন বেশী দেখা যায়। বিশেষ প্রয়োজনে এ দু’টি জাতের চাষাবাদে চাষীদের আগ্রহ প্রতিনিয়তই বাড়ছে। তবে অষ্ট্রেলিয়ার কোন কোন এলাকায় প্রাকৃতিকভাবে তা অত্যাধিক বৃদ্ধি পাওয়ায় তা ক্ষতিকারক ঘাস হিসাবে চিহ্নিত। বংশ বিস্তারঃ প্রধানত: দু’ভাবে, বীজ থেকে অথবা পুষ্ট লতা কেটে তা রোপনের মাধ্যমে চাষাবাদ করা যায়। আগষ্ট মাস হতে লতায় ফুল ধরা আরম্ভ করে এবং ক্রমান্বয়ে সেপ্টেম্বর হতে ফেব্রুয়ারী মাস পর্যন্ত ফল পাকা আরম্ভ করে। এসময় পাকা ফল থেকে বীজ সংগ্রহ করা যায়। বীজের জীবনী শক্তি খুব বেশী। সংরক্ষিত বীজে ৫০ বছর পর্যন্ত অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা বজায় থাকে। মাইমোসার বীজ খুব ছোট। প্রতি ১০০০ টা বীজের ওজন প্রায় ৬ গ্রাম। ওয়াটার মাইমোসাঃ ইহা অগভীর পানিতে ভাল জন্মে। খাল-বিল, নালা-নর্দমা ও পুকুরে সহজেই ওয়াটার মাইমোসার চাষ করা যায়। পুকুর পাড়ের পানির উপরিভাগে ২ থেকে ৩ ফুট দূরত্বে চারা বা কাটিং লাগালে তা দ্রুত কলমির মত ছড়িয়ে পড়ে। এ গাছের লতা সাধারণত: ১০ থেকে ২০ ফুট পর্যন্ত ছাড়াতে দেখা যায়। এছাড়াও লতার শাখা প্রশাখা দু’ধারে বাড়তে থাকে। লতার প্রতি গিটে যে পাতা মঞ্জুরী বের হয় তার প্রতিটির উভয় পাশে জোড়ায় জোড়ায় ২০-৪০টা ক্ষুদ্র পাতা গজায় এবং পানির উপরিভাগে বৃদ্ধি পেয়ে ভেসে থাকে। লতার প্রতি গিট থেকে প্রচুর গুচ্ছমূল গজায়। চাষ সম্প্রসারণঃ যে সব এলাকায় বিশেষ করে উত্তর অঞ্চলের বরেন্দ্র এলাকার অগভীর পুকুরের পানি প্রখর রোদে গরম হয়ে যায়। এর প্রভাবে মাছ ও জলজ প্রাণীর কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এসব পুকুর পাড়ে ওয়াটার মাইমোসা চাষের মাধ্যমে এ প্রতিকুলতা দূর করা যায়, পানিকে ঠান্ডা রাখা সহজ হয়। ওয়াটার মাইমোসার গুচ্ছ শিকড়ের ভিতর কৈ, তেলাপিয়া মাছে ডিম পাড়ে এবং তা ছোট মাছের আশ্রয় স্থান হিসাবে কাজে লাগে। মাগুর, শিং, কৈ, তেলাপিয়া জাতীয় পুকুরের সকল মাছ মাইমোসার শিকড়, কচি লতা-পাতা ও ফুল খেয়ে দ্রুত বৃদ্ধি পায়। উত্তরাঞ্চলের খরা প্রধান এলাকায় ও দক্ষিণাঞ্চলের উপকূল এলাকায় এ জাতের মাইমোসা পুকুর ও নালায় চাষ ব্যবস্থা নিয়ে এর সুফল আহরণ করা প্রয়োজন। বীজ বপন/ চারা রোপণঃ চারা তৈরী করে নিয়ে অথবা লতার কাটিং এপ্রিল/মে মাসে লাগানোর উপযোগী। পুকুর পাড়ে পানির স্তরের ৮-১০ ইঞ্চি উপরে রসালো মাটিতে ২-৩ ফুট দূরত্বে চারা/কাটিং রোপন করতে হয়। লাগানোর অল্প সময়ের মধ্যে তা বাড়তে থাকে। পরিচর্যাঃ ওয়াটার মাইমোসা এপ্রিল/মে মাসে হতে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত দ্রুত বাড়ে। এ সময় চাহিদা মত লতা-পাতা রেখে কিছু ছেঁটে দিয়ে মাছ ধরা ও মাছের অবাধ চলাচল সুবিধা নিন্ডিু করা প্রয়োজন। অক্টোবর- নভেম্বর মাসে লতায় ফল ধরে এবং শীতে বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় পুরাতন লতা কমিয়ে দিয়ে সেগুলো জ্বালানী বা জৈবসার হিসাবে ব্যবহার করা যায়। পুকুরে অতিরিক্ত ছড়ানো ওয়াটার মাইমোসা, চাষকৃত মাছের অবাধ চলাচলে প্রতিবন্ধকতা, আলো বাতাস ও সরবরাহকৃত খাদ্য গ্রহনে মাছের জন্য যেন অন্তরায় না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা অত্যাবশক। বাড়ন্ত মৌসুমে কলমীর মত ওয়াটার মাইমোসার কচি লতা-পাতা, ফুল-ফল সবজী হিসাবে আহারের প্রচলন করার ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। তাতে সাধারণ জনগন এ পুষ্টিকর সবজী আহার সুবিধা পাবে এবং পুকুরে এ মাইমোসা অত্যাধিক ছড়ানো রোধ হবে। জায়ান্ট মাইমোসা : দ্রুত বর্ধনশীল কাঁটাবিহীন এ জাতটি বাংলাদেশে সম্প্রসারণে উজ্জল সম্ভাবনা বহন করে। ভারতের রাজস্থানে ও কেরালায় খরা প্রবন এলাকায় বাগানের ভিতরে কভার ক্রপ হিসাবে জায়ান্ট মাইমোসার চাষ প্রচলন খুব বেশী। দক্ষিণাঞ্চলের বৃহত্তর বরিশাল ও খুলনার উপকূলবর্তী এলাকায় বিশেষ করে বাগানে এ জাতের মাইমোসার চাষ সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেয়া দরকার। এ দেশের উত্তরাঞ্চলের খরাপ্রবণ এলাকার ফল বাগানে জায়ান্ট মাইমোসা চাষ সম্প্রসারণ যথেষ্ট সুযোগ আছে। রাস্তা ও বাঁধের ধারে, রেল লাইনের পাশে, নদীর পাড়ে এবং বাগানে ( আম, কাঁঠাল, লিচু, নারিকেল) জায়ান্ট মাইমোসা চাষের জন্য উপযোগী। চারা/ কাটিং রোপনঃ চারা উৎপাদন ও কাটিং তৈরী পদ্ধতি ওয়াটার মাইমোসার অনুরুপ। মার্চ/ এপ্রিল মাসে ২- ৩ ফুট দূরত্বে চারা কাটিং রোপণ করতে হয়। গ্রীন ম্যানুয়ারিং করার ক্ষেত্রে এক ফুট দূরুত্বে অনেকটা ঘন করে চারা / কাটিং রোপণ করতে হয়। রোপণের পর হতে আগষ্ট মাস পর্যন্ত বহু বর্ষজীবী এ গাছ ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়ে মাটিকে ঢেকে ফেলে। চাষ সম্প্রসারণ ও ব্যবহারঃ বরেন্দ্র এলাকায় যে ভাবে আম বাগান নতুন ভাবে সম্প্রসারিত হচ্ছে সে গুলোর মাঝে এ জাতের মাইমোসা চাষ ব্যবস্থা নেয়া দরকার। এ ব্যবস্থায় বাগানের আগাছা দমন, মাটির রস সংরক্ষণ ও জৈবসার সরবরাহ নিন্ডিু হবে। মাটির ক্ষয়রোধ ও তা ধরে রাখার জন্য বাঁধের ও উঁচু রাস্তার ধারে জায়ান্ট মাইমোসা সম্প্রসারণ ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। এ জাতের মাইমোসা মার্চ/এপ্রিল মাস হতে অক্টোবর মাস পর্যন্ত খুব বাড়ে, চারিদিকে প্রচুর লতা-পাতা ছড়ায়। সেপ্টেম্বর মাস থেকে ফল পাকা আরম্ভ হলে গাছের বৃদ্ধি কমে যায়। এজন্য এপ্রিল / মে মাসে লাগানো চারা জুন/জুলাই মাসে সবুজ সার তৈরী করে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধির সুযোগ হয়। শীতের শুরুতে গাছের গোড়া বরাবর কেটে তা জ্বালানী হিসাবে এবং ঝরে পড়া পাতা গুলো ফল গাছের গোড়ায় মালচিং হিসাবে ব্যবহার করা যায়। মহিষের খাদ্য হিসাবে জায়ান্ট মাইমোসার ব্যবহার মালায়শিয়ায় প্রচলিত আছে। তাই এ দেশেও তা মহিষের ফডার হিসাবে চাষের ব্যবস্থা নেয়া যায়। এছাড়াও অন্য খাবারের সাথে মিশিয়ে গো খাদ্য হিসাবে ব্যবহার উপযোগীতা পরীক্ষান্তে অনুকূল ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়ায় ও কিছু আফ্রিকান দেশে সবজী হিসাবে মাইমোসা ব্যবহার প্রচলন অত্যধিক। আমাদের দেশেও মাইমোসা শাক-সবজী হিসাবে আহারের ব্যবস্থা জনপ্রিয় করার উদ্যেগ নেয়া যায়। তাতে দ্রুত বর্ধনশীল অতি পুষ্টিকর এ মাইমোসা বেশী আহার করে দরিদ্র গ্রামীণ জনগোষ্ঠি সস্তায় পুষ্টিহীনতা দূরীকরণ সুযোগ পাবে। মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি, আগাছা দমন, ভূমিক্ষয় রোধ, ঔষধী ও সবজী হিসাবে ব্যবহার, সুফল আহরণের লক্ষ্যে, অতি সম্ভাবনাময়ী এ ফসলটির সম্প্রসারণ ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট সকলেরই প্রচেষ্টা নেয়া অত্যাবশ্যক।
লেখক: এম. এনামুল হক
প্রাক্তন ডিজি, ডিএই
সূত্রঃ কৃষিবার্তা