………………………………….মোঃ আবদুল মান্নান
মাদকাসক্তি একটি মনোসামাজিক ও জনস্বাস্থ্য সমস্যা। আসক্ত হওয়ার পর আসক্ত ব্যক্তি মাদক ব্যবহার না করলে অসহনীয় শারীরিক ও মানসিক সমস্যা মাদকসেবিকে আক্রান্ত করে ফেলে। আর এ কারণেই মাদকসেবি দুষ্টচক্রের খপ্পরে পড়ে যায়। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলেও সহজেই তা সম্ভব হয়ে উঠে না। যে পথে যেতে মানা, সে পথ আগে খোঁজে তরুনেরা। অনেকটা অদ্ভূত ধরণের ব্যতিক্রম সে আনন্দ।
শুধু ভুক্তভোগী ছাড়া এ আনন্দ অন্য কারো পক্ষে উপলব্ধি করা সম্ভব নয় বলে মাদক সেবিদের সাথে কথা বলে জানা যায়। বাস্তবতা ছাড়া এ অবস্থা কেউ বুঝতে পারে না। যে পথে যেতে যত বাঁধা আসবে, ততবেশি জেদ চাপে সে কাজ করতে এবং সে পথেই বেশি পাঁ বাড়াতে আগ্রহ আসে তরুন মনে। তারা তখন মাদকের মারাত্মক ক্ষতির কথা ভাবে না। বিপদের কথা না ভেবে পরম সুস্বাদু কোরমা পোলাও ভেবে সেবন করতে থাকে মাদক। যা পটাশিয়াম সায়োনাইট পান করার সামিল, যার পরিণাম নির্ঘাত মৃত্যু। মাদক সেবনের আগে এ পরিণামের কথা বুঝলে কখনই কেহ এ মরণঘাতি মাদক সেবন করত না।
তরুনেরা নিজের অজান্তেই এক সময় মাদক সেবনে জড়িয়ে পড়ে। কিন্তু মাদকই যখন তাদেরকে জড়িয়ে ফেলে তখন তাদের পক্ষে সেখান থেকে ফেরার পথ একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। ফেরার কোন পথই তারা আর খুঁজে পায় না।
মাদক সেবনকে মরণব্যাধি হিসেবে বলা যায়। আমাদের সমাজে মাদকের প্রভাব এখন প্রকটভাবে দেখা দিয়েছে। কেউ নিজে মাদক সেবন করছে আবার কেউ মাদক সেবনে অন্যকে অভ্যস্ত করে তুলছে। মাদক সেবন করা একটি অনৈতিক কাজ, আর অন্য কাউকে মাদক সেবনে অভ্যস্ত করা কিংবা আহবান করাও সামাজিক ও ধর্মীয় অপরাধ।
বর্তমানে মাদক সেবন এবং ক্রয়-বিক্রয় রাষ্ট্রীয়ভাবে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিতসহ আইনও পাশ করা হয়েছে। তারপরও মাদকাসক্ত ব্যক্তি ও মাদক ব্যবসায়ীদের নৈতিক মূল্যবোধ, বিবেক, বিচার বুদ্ধি ও হিতাহিত জ্ঞান নেই,তাদের হিংসা, লোভ-লালসা এবং লাম্পট্য থেকে কেহই রেহাই পাচ্ছে না। মাদক সেবনের ফলে তাদের মনে অনৈতিক কাজ ও সামাজিক অপরাধ সমুহকে আর অপরাধ হিসেবে মনেই হয় না। এমনকি মাদকাসক্ত তরুনদের নিকট তাদের অভিভাবকগণ পর্যন্ত রেহাই পাচ্ছে না।
তাদের নেশার টাকা যোগাতেই পরিবারের অভিভাবকগণকে সর্বশান্ত হতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। সে সাথে ভুলূন্ঠিত হচ্ছে পরিবারের মান মর্যাদাও। মাদক সেবিদের প্রভাবে পরিবারে এবং সমাজে নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটছে। চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, হত্যা ধর্ষন, দেহ ব্যবসাসহ নানান ঘটনা সমাজে প্রকটভাবে দেখা দিচ্ছে। সমাজের পরতে পরতে মাদকের প্রভাব বিস্তার করছে মারাত্মক ভাবে। চারদিকে তাকালেই মাদকের ভয়ালরূপ এখন সকলের চোখে পড়ে।
অনেকে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে হিরোইজমের মোহে পড়ে। বন্ধুরা মাদক গ্রহণ করছে, তারা না করলে কেমন হয়? মাদক সেবিদের অনেকেই বলে, ‘মন চাইলেই যে কোন সময়েই মাদক ছেড়ে দিতে পারি।’ এমন চ্যালেঞ্জ থেকেও অনেকেই মাদকসেবী হয়ে পড়ে। কিন্তু পরবর্তীতে সে আর কখনও এ পথ থেকে ফিরে আসতে পারে না। মাদকের বিষবাষ্পে আক্রান্ত হচ্ছে মূলত: তরুনেরা। বিভিন্নভাবে মাদক সেবন করে ও এর ব্যবহারের মোহজালে আটকা পড়ে সর্বশান্ত হচ্ছে এ সব তরুণ। বিশেষভাবে ধনী ও সামর্থবান পরিবারের সন্তানেরা বেশি বেশি আক্রান্ত হচ্ছে মাদকের জালে। অশালিন পত্র-পত্রিকা, পর্ণ-সিনেমা যা আধুনিক প্রযুক্তির সুবিধায় মোবাইল ফোনে ধারণ করে এবং তা দেখে মানসিকতায় পচন ধরাচ্ছে তারা। তারা ভূলে যাচ্ছে সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ, তারা ছুটছে পশ্চিমা অপ-সংস্কৃতির মরীচিকার পিছনে।
মাদকাসক্ত হওয়ার পিছনে সমাজ বিজ্ঞানীসহ অনেক চিকিৎসক বিভিন্ন কারণও উলে¬খ করেছেন। এগুলোর মধ্যে দারিদ্রতা, মা-বাবার উদাসীনতা, মা-বাবার সাথে বিভিন্ন কারণে সন্তানের দূরত্ব, সঙ্গদোষ এবং সন্তানের হাতে অতিরিক্ত টাকা-পয়সা থাকার কথাও বলা হয়েছে। এমন কিছু পরিবার আছে যাদের উলে¬খিত কোন কারণ না থাকার পরও তাদের সন্তান মাদকসেবী হয়েছে। বাবা-মা কিংবা অভিভাককে দোষারোপ করা যাবে না কিংবা দায়ী করা যাবে না এমন পরিবারের সন্তানকেও মাদক সেবন করতে দেখা যায়। মাদকাসক্ত সন্তানের কথা আত্মীয় স্বজনের কাছে কোন বাবা-মা বলতে চায়না। ছেলে মাদকাসক্ত হওয়ার কথা বলে সামান্য সান্তনাই পেতে চায়না এ সব মাদকাসক্ত ছেলের বাবা মা।
মাদকের এ সব ঘটনা বুঝে চুপচাপ বসে থাকলে চলবে না। আমাদের সন্তান, সমাজ ও দেশকে মাদকের এ করাল গ্রাস থেকে মুক্ত করতে হবে। আমরা বাবা-মা কোথায় যাব? একটি তরুন সন্তানকে তার মত মুক্ত পরিবেশে আনন্দ মা, পরিবেশে বড় করার সুযোগ আমরা কোথায় পাব? সন্তানের মন মত বড় হওয়ার সুযোগ তো আমরা দিতে পারছি না। সুস্থ্য বিনোদনের কোন ব্যবস্থা এখন নেই বললেই চলে। এখন আমাদের সমাজে নেশার দ্বারই অবারিত। হাত বাড়ালেই পাওয়া যায় সব ধরনের নেশার দ্রব্য। তাই, এ অবস্থার থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হলে প্রয়োজন সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা।
যেখানে, যে ভাবেই পারা যায় মাদক ব্যবসায়ী, মাদক সেবীকে প্রতিহত করতে হবে। কোথাও মাদক ব্যবসায়ী কিংবা মাদকসেবী দেখলেই আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে জানাতে হবে। সমাজে কেউ না কেউ জানেন কোথায় মাদকের ব্যবসা চলে, কারা মাদকসেবী, কখন কিভাবে মাদক হাতবদল হয়। এ সব খবর সাথে সাথেই স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনকে জানাতে হবে এবং তা বাস্তবায়নে পুলিশকে সহায়তা করতে হবে। মাদক ব্যবসায়ী ও মাদকসেবী কে চিহ্নিত করতে হবে এবং আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে জানাতে হবে। প্রত্যেককে নিজ নিজ এলাকাকে মাদক মুক্ত করার দীপ্ত শপথ নিতে হবে। নিজ নিজ সন্তানদের প্রতি নজরদারী বাড়াতে হবে।
প্রতিনিয়ত খোঁজখবর রাখতে হবে তাদের গতিবিধির উপর। নৈতিক শিক্ষা ও ধর্মীয় মূল্যবোধ সম্পর্কে তাদেরকে শিক্ষা দিতে হবে এবং মাদকের ক্ষতি সম্পর্কে জানাতে হবে। তা-হলে হয়ত একদিন সমাজ তথা দেশ মাদকের করাল গ্রাস থেকে মুক্ত হবে। এ ছাড়াও মাদকের এ মরণ ছোবল থেকে দেশকে রক্ষা করতে হলে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে যারা আছেন এবং আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সকল বিভাগকে যৌথভাবে মাদক মুক্ত করার জন্য একত্রে কাজ করতে হবে। কিন্তু হতাশায় ও ভয়ে আতঙ্কিত হতে হয়, যখন পত্রিকা খুললেই চোখে পড়ে প্রভাবশালীর সন্তানদের মাদক ব্যবসায় জড়িত থাকার কথা।
তারা মাদক তৈরির কারখানা দেশে স্থাপন করে জমজমাট ব্যবসা চালাচ্ছে। ঢাকাসহ সারা দেশে মরণঘাতি নেশাজাত দ্রব্য বাজার জাতের বিশাল নেটওয়ার্ক গড়ে তুলছে। এখানে ক্ষমতাধর অতিলোভী ব্যক্তি এবং আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কতিপয় অসাধু সদস্যের সমন্বয়ে গঠন করা হচ্ছে প্রভাবশালী ইয়াবা চক্র। ক্ষমতার দাপট আর মাদকের অর্থে পরিচালিত এ ইয়াবা চক্রের প্রতাপ নাকি আকাশ ছোঁয়া এবং তাদের বিরুদ্ধে টু শব্দটি করারও উপায় নেই। এর নেপথ্যে থাকা এ সব হোতা ব্যক্তিরা ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে।
এ সংবাদগুলো দৈনন্দিন বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে। এ সব ইয়াবা ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের হোতারা বরাবরই মিয়ানমার থেকে লাখ-লাখ পিস ইয়াবা আমদানী করছে। কিন্তু এখন তারা খোদ ঢাকা শহরেই ইয়াবা কারখানা স্থাপন করেছে এবং সেখান থেকে উৎপাদিত লাখ লাখ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করছে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা নাকি ছুঁতেও পারেনি ইয়াবা উৎপাদনকারী হোতােেদর। অধিক লাভ থাকার কারণে সাধারণ লোকও ইয়াবা কেনা-বেচার কাজে জড়িয়ে পড়ছে।
বিভিন্ন তথ্য থেকে আরও জানা যায়, ধুমপানে প্রতিদিন বহুলোক অকালে প্রাণ হারায়। তথ্যমতে, ধুমপায়ীদের ছোড়া ধোঁয়ায়, ধুমপায়ীর চেয়ে অধুমপায়ীই ৩০% বেশি ক্ষতির সম্মূখীন হয়। ভালমন্দ মিলিয়ে দুনিয়া। কিছু মানুষ আছে যারা কিছু না কিছু নেশা জাতীয় দ্রব্য গ্রহণ করবেই, এটাই হল বাস্তবতা। নেশা বা মাদক যারা গ্রহণ করে তাদেরকে ফেরানো অনেক কঠিন, কারণ খারাপ হওয়ার আনন্দ অনেক বেশি। কিন্তু মাদক গ্রহণের ফলে সর্বনাশ যে আরও বেশি এটা যখন মাদকসেবী বুঝতে পারে তখন সে সর্বশান্ত হয়ে গেছে বলেই ধরে নেয়া হয় এবং এ কারণে সে আর স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে পারে না। আমাদের দেশের তরুনদের এখন হিরোইন ও ইয়াবার ভয়ংকর নেশা। এ নেশাবাজদের সামনে এখন মৃত্যু ছাড়া আর কোন দুয়ার খোলা নেই অথচ দেশে এখন এ সর্বনাশা মাদকের ছড়াছড়ি।
এ সব দেখে মনে হয় মাদক সমস্যা সমাধান তো দুরের কথা চোখ তুলে দেখারও কেউ আছে বলে মনে হয় না। মাদকের বিষাক্ত ফণা যেন আমাদের ধাওয়া করছে। বিগত ২/১ বছর হতে দেখা যাচ্ছে প্রশাসন কর্তৃক কিছু সভা, র্যালী ও সেমিনারের মাধ্যমে মাদক বিরোধী লিফলেট বিতরণ করে ও ফেস্টুন বিভিন্ন স্থানে টাংগিয়ে মাদক নিয়ন্ত্রনের জন্য প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। তাদের এ কর্মকান্ডের ফলে, সমাজে এর সুফল কতটুকু তা আমার জানা নেই। তবে মাদকের হাত থেকে বাঁচার জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া অত্যন্ত জরুরী, আর আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনকে সেটাই বুঝতে হবে।
তা না হলে মাদকের বিস্তার দেশের যুবশক্তিকে কর্মহীন করে দিলে আমাদের উন্নত দেশ গড়া স্বপ্ন, স্বপ্নই থেকে যাবে, বাস্তবে রুপ দেয়া কঠিন হবে। এখন দেশের আনাচে কানাচে যে পরিমাণ মাদক পুলিশ বা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে তা নাকি অতি সামান্য। মাদক ব্যবসায়ীরা পুলিশের চেয়ে অধিক ক্ষমতাবান। তারা দিন দিন ক্ষমতার দিক থেকে অনেক পরাক্রমশালী হয়ে উঠছে। তারা হয়ে উঠছে অপ্রতিরোধ্য। জেল, হাজত কোন কিছুতেই তাদের আটকানো সম্ভব হচ্ছে না। তাদেরকে জেল হাজতে ১ মাসও থাকতে হয় না।
অতি দ্রুত জামিন পেয়ে তারা সবার সামনে হাসিমুখেই ফিরে আসে। এ ক্ষেত্রে আইনি প্রক্রিয়ায় আরো সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ প্রয়োজন, যাতে মাদক ব্যবসায়ীরা দ্রুত পার না পায়। এ নিয়ে সংশি¬ষ্ট সকলকে নুতন করে কৌশল বের করার চিন্তা করতে হবে। দেশে মাদকের বিস্তাররোধে প্রচলিত সব কৌশলই ব্যর্থ হচ্ছে বলে মনে হয়। এতে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী কিংবা প্রশাসনেরও কোন সন্দেহ থাকার কথা নয়। মাদক সমস্যা সমাধানে এখন যুগোপযোগী সমাধান খুঁজে বের করাও সময়ের দাবী যদিও সরকার মাদক নিয়ন্ত্রণে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহন করেছে।
তবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সমস্যা সমাধানে আরও নতুন কৌশল খুঁজে বের করে তা-বাস্তবায়ন করা অতীব জরুরী যা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনের বাইরে যাওয়ার আগেই কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহন করবেন এটাই জনমনে প্রত্যাশা। কেননা মাদক নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা ভবিষ্যতে দেশ ও জাতির জন্য ভয়ঙ্কর অভিশাপ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
লেখক ও সাংবাদিক।