সুস্থ-সবল মানুষের জন্য মাংস খাওয়াতে নেই মানা। তবে যারা খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন বা শারীরিক সমস্যার কারণে মাংস খাওয়া বাদ দিয়েছেন তারা অল্প মাংস খেতেই পারেন। কারণ প্রোটিনের একটি ভালো উৎস মাংস।
মাংসের পুষ্টিগুণ সম্পর্কে জানান বাংলাদেশ গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের খাদ্য ও পুষ্টি বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান ফারাহ মাসুদা।
মাংসে ভালো পরিমাণে খনিজ লবণ থাকে বিশেষ করে পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, সোডিয়াম। এছাড়াও ক্লোরাইড, বাইকার্বোনেট এবং অ্যাসিড ফসফেট থাকে। এসব লবণ থাকে মাংসের চর্বিহীন পেশিতে। তাপে মাংস যখন সঙ্কুচিত হয় তখন এর থেকে পানি মিশ্রিত নির্যাস বের হয় যার বেশিরভাগে সোডিয়াম থাকে।
প্রতি ১০০ গ্রাম গরুর মাংসে ৬৭ শতাংশ পানি, ১৮০ ক্যালরি, ২১ গ্রাম প্রোটিন, ১৪ গ্রাম চর্বি, ৬ মি.গ্রা ক্যালসিয়াম, ২.৩ মি.গ্রা লৌহ, ০.০৮ মি.গ্রা ভিটামিন বি-১, .০২৬ মি.গ্রা বি-২ ও ৮.২ মি.গ্রা নায়াসিন থাকে।
প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের দৈনিক প্রোটিনের চাহিদা ৫৭ গ্রাম। আর অনায়াসে মাংস থেকে ৩০/৪০ গ্রাম প্রোটিন নিয়মিত গ্রহণ করা যেতে পারে। এর জন্য মাঝারি মাপের দুতিন টুকরা গরুর মাংস প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা যায়। তাই কোরবানির মাংস খেতে খুব একটা দ্বিধাগ্রস্ত না হলেও চলবে।
যাদের নানাধরনের শারীরিক সমস্যা রয়েছে তারা চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে খাদ্যতালিকা তৈরি করতে পারেন।
গরুর মাংস খাওয়া প্রসঙ্গে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য-কমপ্লেক্সের মেডিসিন বিভাগের পরামর্শদাতা ডা. কামরুল হাসান (বিসিএস স্বাস্থ্য) বলেন, “ভরপেট খাওয়া কখনই স্বাস্থ্যসম্মত নয়, সুস্থ সবল মানুষদেরও পরিমিত পরিমাণে গরুর মাংস খাওয়া উচিত। যাদের হৃদরোগ আছে, হার্টে ব্লক আছে, রক্ত চাপ বেশি, রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমাণ বেশি বা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে নেই তাদের জন্য গরুর মাংস খাওয়াটা বেশ ক্ষতিকর। সেক্ষেত্রে দুতিন টুকরা বা সর্বোচ্চ চার টুকরা মাংস খেতে পারেন। এর বেশি না খাওয়াই ভালো।”
“গরুর মাংস গুরুপাক খাবার। এর সঙ্গে ভারী খাবার যেমন পোলাও, কোরমা ইত্যাদি খাওয়া হলে তা আরও বেশি গুরুতর হয়। তাই গরুর মাংস খাওয়ার পাশাপাশি আঁশযুক্ত খাবার যেমন- সবজি, সালাদ ও তাজা ফল ইত্যাদি খাওয়া প্রয়োজন।”
“যাদের আলসার বা পিত্তথলিতে পাথরজনিত সমস্যা আছে তাদের গরুর মাংস খেলে খানিকটা অসুবিধা হতে পারে। যেমন- পেটব্যথা, বুকজ্বালা করা ইত্যাদি। সেক্ষেত্রে একটু বেছে খাওয়া উচিত।”
“অনেকের গরুর মাংসে অ্যালার্জি থাকে। ফলে শরীর ও চোখ লাল হয়ে যায়, চোখ চুলকায়, শরীরে র্যাশ দেখা দেয়। এই ধরনের সমস্যা থাকলে যতটা সম্ভব গরুর মাংস এড়িয়ে যাওয়া উচিত।” পরামর্শ দিলেন এই চিকিৎসক।
তারপরও রসনায় লাগাম টানতে ইচ্ছে হয় না! বিশেষ করে কোরবানির ঈদের দিন থেকে পরবর্তী বেশ কটাদিন মাংস দিয়ে এত্তসব মজাদার পদের সামনে কীভাবেই বা নিজেকে সামলে রাখা যায়!
সামলাতে না পারলে বরং জেনে নিন মাংস খাওয়ার কিছু নিয়ম। পরামর্শ দিয়েছেন জনস্বাস্থ্য পুষ্টিবিদ আসফিয়া আজিম।
* পুষ্টিবিদদের মতে দিনে তিন আউন্সের বেশি মাংস খাওয়া উচিত না। এই তিন আউন্সের হিসেব কষতে ‘মেজারিং টুল’ জোগাড় করার দরকার নেই। একটা তাসের কার্ডের ক্ষেত্রফলের সমান মাংসের মাপ হল ৩ আউন্স। এই পরিমাণ মাংস খেলে স্বাস্থ্যের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা কম।
* বিরিয়ানি, রেজালা, কাবাব— এ ধরনের গুরুপাক খাবারের পর প্রচুর পানি পান করুন। কারণ প্রোটিন হজমের সময় বিভিন্ন এনজাইম নিঃসরণ হয় প্রোটিনকে শোষনের জন্য। তবে এই এনজাইম নিঃসরণের সময়ে অ্যামোনিয়া-জাতীয় এক ধরনের বিষাক্ত পদার্থ শরীরে তৈরি হয়। দেহ থেকে এই বিষাক্ত পদার্থ বের করে দিতে অতিরিক্ত পানি পান প্রয়োজন।
* মাংস মোটেও সহজপাচ্য খাবার নয়। তাই খাওয়ার সময় ভালোমতো চিবিয়ে খান। মাংস ভালোমতো চিবালে পাকস্থলী থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ গ্যাস্ট্রিক জুস বের হবে যা পরিপাকে সাহায্য করবে।
* মাংস খাওয়ার পর ডেজার্টে কি খাবেন, জানেন? এক ফালি পেঁপে। এটা মাংস হজমে ম্যাজিকের মতো সাহায্য করে।
* পোলাও, মাংসের সঙ্গে শসা-টমেটোর সালাদ দুর্দান্ত। তবে মাংসকে সহজপাচ্য করতে চাইলে, তাড়াতাড়ি হজম করতে চাইলে শসা-টমেটোর বদলে আনারসের সালাদ খান। আনারসে ব্রোমেলিন নামে এক ধরনের এনজাইম আছে যা মাংসের মতো গুরুপাক প্রোটিনকে ভেঙে হজমের উপযোগী করে।
* এছাড়া ‘লিন মিট’ বা চর্বি ছাড়া মাংস খেলে তা তুলনামূলক কম সময়ে হজম হয়। মাংসে চর্বি বেশি থাকলে তা হজম করতে শরীরকে অনেক বেশি পরিমাণ এনজাইম ক্ষরণ করতে হয়। যা শরীরের জন্য সবসময় ভালো নাও হতে পারে।
* আমাদের দেশের রান্নায় অনেক ধরনের মসলা ব্যবহার করা হয়। ফলে মসলাও মাংস হজমে সাহায্য করে। তবে অতিরিক্ত মসলাদার খাবার আবার উল্টোভাবে হজম শক্তিকে দুর্বলও করে দেয়।
* যেসব রেসিপিগুলোতে মাংস অনেক্ষণ মেরিনেইট করে রাখার প্রয়োজন হয় অথবা ভিনিগারে বা দইয়ের ব্যবহার আছে এমন ধরনের রান্না ঈদের মেন্যুতে রাখুন। অনেকক্ষণ মেরিনেইট করার ফলে কিংবা ভিনিগার বা দইয়ে ভিজিয়ে রাখলে মাংস আপনা থেকেই সহজপাচ্য হয়ে যায়।
* ছোট টুকরা করে মাংস রান্না করুন। এভাবে রান্না করলে মাংস হজম করা সহজ। টিকিয়ার কাবাবে যেহেতু মাংসের কিমা ব্যবহার করা হয় তাই হজম সহজ হয়।
* উৎসবের আনন্দে, আড্ডায় খাওয়া-দাওয়া করতে অনেক সময়েই রাত হয়ে যায়। মাংস হজম হতে যেহেতু সময় বেশি লাগে তাই রাতের খাবার ৮টার মধ্যে খেয়ে ফেলাই উচিত। না হলে পরদিন হয়ত পেট ব্যথায় কষ্ট পেতে পারেন।
* একদিনে অনেক ধরনের প্রোটিন না খাওয়াই ভালো। উৎসবে প্রায় প্রতিদিনই খাসির রেজালা, গরুর ভুনা, মুরগির রোস্ট, কোফতা, কাবাব চলতেই থাকে। একটু সামলে বুঝেশুনে শরীরকে সইয়ে খান। আপনি শরীরের দিকে নজর দিলে শরীরও আপনাকে বিপদে ফেলবে না।
B/D/N