ডেস্ক রির্পোটঃ মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া অধিকাংশ রোহিঙ্গাই রাখাইনে পরিস্থিতির উন্নতি হলে নিজেদের বাড়িঘরে ফিরে যেতে চায়। তবে মিয়ানমার সেনাসদস্যের নিপীড়ন এতটাই নির্মম ছিল যে কিছুসংখ্যক রোহিঙ্গা আর ফিরেই যেতে চায় না। অভিবাসনবিষয়ক আন্তর্জাতিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান এক্সচেঞ্জের জরিপ থেকে এ তথ্য উঠে এসেছে। গত রোববার প্রতিষ্ঠানটি নিজেদের ওয়েবসাইটে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
কক্সবাজারে গত সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১ হাজার ৩৬০ জন রোহিঙ্গার মধ্যে জরিপটি পরিচালনা করা হয়। এ সময় ৭৮ শতাংশ রোহিঙ্গা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে পরিস্থিতির উন্নতি হলে সেখানে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে। সেনাদের নির্যাতন-নিপীড়নের বিভীষিকা কিছু রোহিঙ্গাকে এতটাই গ্রাস করেছে যে তারা আর ফিরেই যেতে চায় না। এমন রোহিঙ্গা ১৬ শতাংশ। আর নিঃশর্তভাবে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে ৬ শতাংশ রোহিঙ্গা।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক সি আর আবরার বলেন, মর্যাদা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করাই হলো রোহিঙ্গাদের রাখাইনে তাদের বাসস্থানে ফেরত পাঠানোর পূর্ব শর্ত। রোহিঙ্গা পরিস্থিতিকে অন্যান্য শরণার্থী পরিস্থিতির সঙ্গে এক করে দেখার সুযোগ নেই। রাখাইনে যে তাদের বিরুদ্ধে জাতিগত হত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ হয়েছে, সেটা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সাক্ষ্য-প্রমাণ দিয়েই বলেছে। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি হয়েছে। তারা যতক্ষণ স্বেচ্ছায় ফিরে যেতে না চাইবে, ততক্ষণ তাদের ফেরত পাঠানো যাবে না। এ প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক নজরদারি নিশ্চিত করতে হবে। শরণার্থী প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইনের বাইরে গিয়ে কোনো কিছু করা বাংলাদেশের জন্য ঠিক হবে না।
অনুসন্ধান ও উদ্ধারবিষয়ক বিশেষায়িত আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) দ্য মাইগ্র্যান্ট অফশোর এইড স্টেশনের অর্থায়নে ওই গবেষণা প্রকল্পটি পরিচালিত হয়। এক্সচেঞ্জ ডট ওআরজি একটি অভিবাসনবিষয়ক গবেষণা, তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণধর্মী পোর্টাল। লিবিয়া ত্যাগ করা অভিবাসীদের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ ও ভ্রমণপথ নিয়ে অনুসন্ধানের লক্ষ্যে ২০১৭ সালের গোড়ার দিকে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়।
গত ২৫ আগস্ট রাখাইনে বেশ কয়েকটি পুলিশ ফাঁড়িতে হামলার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় নিরাপত্তা বাহিনীর ১১ সদস্য নিহত হয়। এরপর সন্ত্রাস দমনের নামে রাখাইনে অভিযান শুরু করে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী। প্রাণ বাঁচাতে ৬ লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে চলে আসে। কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে তোলা ছবি বিশ্লেষণ করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানিয়েছে, রাখাইনে ১০০ কিলোমিটার এলাকা আগুনে পুড়ে শেষ হয়ে গেছে।
গবেষণাপ্রতিষ্ঠান এক্সচেঞ্জের দুটি দল কুতুপালং, বালুখালী ও পালংখালী এবং নয়াপাড়া, লেদা ও জাদি মুরাহ শিবিরে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের সাক্ষাৎকার নেয়। এ ছাড়া এ দুই দলের একটি শামলাপুর গ্রামেও গিয়েছিল। জরিপে অংশ নেওয়া রোহিঙ্গাদের ৬১ শতাংশ পুরুষ আর ৩৯ শতাংশ নারী। গোপনীয়তার স্বার্থে গবেষণা প্রতিবেদনে তাঁদের সবারই ছদ্মনাম ব্যবহার করা হয়েছে। তাঁরা জানিয়েছেন, অধিকাংশ রোহিঙ্গাকেই নাফ নদী পার হতে হয়েছে মানব পাচারকারীদের নৌকায় চেপে। জরিপে অংশ নেওয়া ৮৫ শতাংশ শরণার্থী মানব পাচারকারীর হাত ধরে বাংলাদেশে এসেছে। ৯২ শতাংশ রোহিঙ্গাই বলেছে, সেনা অভিযানের সময় তারা চরম নিপীড়নের শিকার হয়েছে অথবা অন্যকে নিপীড়িত হতে দেখেছে।
রাচিডং থেকে আসা ১৯ বছর বয়সী এক নারী বলেন, ‘একদিন সেনারা আমার গ্রামে এসেই গুলি চালাতে শুরু করে। ওরা আমার স্বামীসহ ৫৩ জনকে ধরে নিয়ে গেল। একটা নদীর ধারে নিয়ে ওরা আমার স্বামীকে গুলি করে হত্যা করে। সেনা আর স্থানীয় রাখাইন সম্প্রদায়ের লোকজন আমার পুরো গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে। প্রাণ বাঁচাতে আমার ছোট্ট সন্তানকে নিয়ে আমি বাংলাদেশে চলে এসেছি।’
এক সকালে মংডুর একটি গ্রামে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা ঢুকে ১০ জনের বেশি কিশোরীকে হত্যা করে। এর আগে তাদের যৌন নিপীড়ন করা হয়। ওই গ্রামের এক নারী বলেন, রাখাইনরাও ছিল সেনাদের সঙ্গে। অনেককেই মেরে ফেলে ওরা। এরপর পুরো গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়। মংডুর আরেক নারী জানান, তাঁর সন্তানেরা বাড়ির কাছেই একটা মাদ্রাসায় একদিন পড়তে গিয়েছিল। সেনারা ওই মাদ্রাসায় আগুন ধরিয়ে দেয়। তাঁর সন্তানেরা সেখানেই জীবন্ত পুড়ে ছাই হয়েছে।
বুচিডংয়ের এক নারী বলেন, ‘সেনারা আমাদের গ্রামে এসেই গুলি শুরু করে। জোর করে ঘরে ঢুকে আমাকে ধর্ষণ করে। আমার স্বামীর পেটে ছুরি চালায়। ছোট্ট সন্তানটাকে আগুনে ছুড়ে ফেলে দেয়। আমি কাঁদছিলাম।’
সেনা আর চরমপন্থী রাখাইনরা মংডুর এক গ্রাম থেকে বহু কিশোরীকে ধরে নিয়ে যায় বলে জানান এক নারী। তাঁকে দু-তিন দিন ধরে ধর্ষণের পর আবার গ্রামে ফেরত পাঠিয়েছে তারা। একই এলাকার আরেক রোহিঙ্গা বলেছেন, তাঁর গ্রামে ৩২ কিশোরীকে ধর্ষণ করা হয়েছে। হত্যা করা হয়েছে ২৩ জনকে।
হত্যা, ধর্ষণ আর অগ্নিসংযোগ ছাড়াও রাখাইনের রোহিঙ্গা গ্রামগুলোয় অভিযানের সময় ডাকাতি ও লুটতরাজের ঘটনাও ঘটেছে বলে অভিযোগ করেছেন জরিপে অংশ নেওয়া রোহিঙ্গারা। এ ছাড়া গ্রেপ্তার আর ধরপাকড় তো নিয়মিত ঘটনা ছিল। কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই পুলিশ আর সেনারা যাকে খুশি তাকে ধরে নিয়ে যেত। এভাবে নিখোঁজ হওয়া অনেকেই এখনো পরিবারের কাছে ফিরে আসেনি বলে জানায় রোহিঙ্গারা। এসব ছাড়াও কারফিউ এবং চলাচলে কঠোর নিয়ন্ত্রণ তো ছিলই।
Pr/A/N.