কাওছার হামিদ,কিশোরগঞ্জ (নীলফামারী) : নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার গাড়াগ্রাম ইউনিয়নের শরিফাবাদ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সদ্য বিদায়ী প্রধান শিক্ষক আইয়ুব আলী।
তিনি ২১ এপ্রিল ১৯৮৭ সালে নীলফামারীর ডোমার উপজেলার খাঠুরিয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসাবে প্রথম যোগদান করে শিক্ষকতা পেশা শুরু করেন।
সেখানে সুনামের সাথে পেশাগত দায়িত্ব পালন শেষে নিজ উপজেলা কিশোরগঞ্জের উত্তর গাড়াগ্রাম সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২৭ জুলাই ১৯৮৯ সালে যোগদান করেন।
সেখানে প্রায় ২ বছরের বেশী সময় শিক্ষকতা করে শিক্ষক স্বল্পতার কারণে ভাল এবং দক্ষ শিক্ষক হিসাবে তাকে পাড়ের হাট সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলী করে দেয়া হয়।
পাড়ের হাট সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে থাকাকালীন সময়ে তিনি প্রধান শিক্ষকের অনুপস্থিতে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসাবে দায়িত্ব পালন করতেন। সেখানে বেশীদিন থাকতে হয়নি তাকে।
সে সময় রাজনৈতিক জটিলতার কিছু কারণে তিনি শিক্ষা অফিস থেকে আবেদন করে গাড়াগ্রাম সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১৯৯৯ সালের শেষের দিকে যোগদান করেন।
গাড়াগ্রাম সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রায় ৫ বছর অতিবাহিত হওয়ার পর তার ভাগ্য খুলে যায়। সেখান থেকে পদোন্নতি পেয়ে আবার উত্তর গাড়াগ্রাম সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন। গাড়াগ্রাম সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে থাকাকালীন সময় ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আমূল পরিবর্তন চলে আসে। ভাল ফলাফলের জন্য উপজেলা পর্যায়ে স্থান দখল করেন ওই স্কুল।
২০০৫ সালে তিনি সর্বশেষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসাবে শরীফাবাদ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়কে বেঁচে নেন তিনি।
দীর্ঘ ১৯ বছরের শিক্ষকতা জীবনের নানান অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে নিজের সময়, শ্রম, মেধা, প্রজ্ঞা ও ভালবাসা দিয়ে শরীফাবাদ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়কে ঢেলে সাজিয়ে তোলেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিনত হয় শিক্ষার বাগানে। উপজেলা পর্যায়ে প্রশাসনের দৃষ্টি চলে আসে ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দিকে।
২০০৬ সালের দিকে শরীফাবাদ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা উপজেলায় যে কোন বিষয়ে অংশ নিয়ে সফলতার সিঁড়িতে উঠতে থাকে।
স্কুলের প্রধান শিক্ষক আইয়ুব আলী আরো অনুপ্রানিত হয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দিকে নজর দিতে থাকেন। উপজেলা পর্যায়ে কয়েকবার ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান উপজেলার শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জায়গা দখল করে নেন। ২০০৮ সালে চ্যানেল নাইন,এনটিভি ও চ্যানেল আইতে ওই স্কুলের শিক্ষার্থীদের ক্ষুদে ডাক্তার কার্যক্রম ও বিভিন্ন শিক্ষামূলক কার্যক্রম প্রচার করা হয়।
সরকারী ভাবে ঊর্ধতন কর্মকর্তারা সেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনে আসেন। ওই স্কুলের এক শিক্ষার্থী জান্নাতুল মাওয়া (ময়না) গাড়াগ্রাম উত্তর পাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কবি ও সাহিত্যিক আজহারুল ইসলাম আল আজাদের লেখা “ মেঘের কোলে রোদ হেসেছে” নাটকে অভিনয় করে বিভাগীয় পর্যায়ে স্থান করে নেন।
ধিরে ধিরে ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আলো ছড়িয়ে পড়ে পার্শ্ববর্তী প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে। শিক্ষক আইয়ুব আলী শিক্ষার্থীদেরকে সব বিষয়ে পারদর্শী করে তোলার জন্য সরকারী ভাবে প্রথম সঙ্গীতের জন্য উন্নতমানের সঙ্গীতের যন্ত্র পায়। শিক্ষার্থীরা গানের জন্য ও নাচের জন্য স্কুলে আসেন।
তার উদ্যোগে স্কুলে সকালে শারিরীক কসরতের জন্য সুন্দর পরিচ্ছন্ন পোশাকে হতো নিয়মিত সমাবেশ। সুন্দর সুস্থ্য মন নিয়ে শিক্ষার্থীদের পাঠে মনযোগ আকর্ষনের জন্য নিয়মিত ডিজিটাল মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরের মাধ্যমে শিক্ষা মূলক কার্টুন প্রদর্শন করা হতো।
স্কুলের অন্যান্য শিক্ষকদেরকে কাজের বিষয়ে আন্তরিক হওয়ার জন্য খুব কষ্টের কাজ দিতেন তিনি। যাকে কাজ দিতেন তার অনুপস্থিতিতে অন্যান্য শিক্ষকদেরকে তার কাজে সহযোগীতা করার জন্য নির্দেশনা দিতেন। ফলে সেই স্কুলের প্রত্যেকজন শিক্ষক দক্ষ শিক্ষক হিসাবে উপজেলা পর্যায়ে নিজেকে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন। এখন ওই স্কুলের কোন শিক্ষককে কাজের ব্যাপারে নির্দেশনা দিতে হয় না। তারা তাদের নিজ দায়িত্বে তার কাজ সম্পন্ন করেন।
প্রধান শিক্ষক আইয়ুব আলী স্কুলের সময় শেষ হলে পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদেরকে বিনামূল্যে কোচিং ও প্রাইভেট পড়িয়ে মেধাবী করে তুলতেন। এটা ছিল তার নিত্যদিনের একটা কাজ। আজ তার অনেক ছাত্র দেশের স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যায়নরত ও বিভিন্ন উচ্চ পর্যায়ে কর্মরত।
শিক্ষক আইয়ুব আলী ছিলেন,সৎ,দক্ষ,নিষ্টাবান,পরিশ্রমকারী একজন দায়িত্বশীল শিক্ষক। স্কুলের পাশাপাশি ওই এলাকার মানুষের ছোট ছোট সমস্যা সমাধানে তার ভূমিকা ছিল অনন্য।
তার কর্মজীবন শেষে বিদায় মূহুর্তে ওই এলাকায় নেমে আসে শোকের ছায়া। তার বিদায় কেউ মেনে নিতে পারছে না।
তার স্কুলের সহকারী শিক্ষকরা তার বিদায়কে মেনে নিতে পারছে না। প্রত্যেক ক্লাশের শিক্ষার্থীরা অঝোর ধারায় কাঁন্না করেন তার বিদায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে।
তবে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে ওই স্কুলের শিক্ষার্থীরা কোরআন তেলাওয়াত করে মুগ্ধ করেছেন । কোন স্ক্রিপ্ট ছাড়াই বক্তব্য দিয়েছেন তার প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন শিক্ষার্থী।
চতুর্থ শ্রেণীর শিক্ষার্থী গীতা পাঠ করেছেন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের মত। সবমিলিয়ে প্রধান শিক্ষক আইয়ুব আলীকে বিদায় দিয়ে উপজেলা শিক্ষা পরিবারে এক শূন্যতায় পড়েছে। অন্যান্য স্কুলের প্রধান শিক্ষকরাও ভেঙ্গে পড়েছে তার বিদায়ের পর।
গত ২৫ জানুয়ারী শরীফাবাদ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক আইয়ুব আলীর বিদায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এ সময় প্রধান অতিথি হিসাবে বক্তব্য রাখেন রংপুর জেলা শিক্ষা অফিসার এনায়েত হোসেন।
বিশেষ অতিথি হিসাবে বক্তব্য রাখেন উপজেলা সহকারী শিক্ষা অফিসার আতাউর রহমান, গাড়াগ্রাম ইউপি চেয়ারম্যান জোনাব আলী,উপজেলা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মাহমুদ শরীফ, শিক্ষক নেতা রবিউল ইসলাম ও উপজেলা শিক্ষা কমিটির সদস্য কবি ও সাহিত্যিক গাড়াগ্রাম উত্তর পাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আজহারুল ইসলাম আল আজাদ, কেশবা মডেল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শফিকুল ইসলাম,শরীফাবাদ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোতমাইন্না বেগম মুন্নী,মঞ্জুরুল হক এনাম। মানপত্র পাঠ করেন সহকারী শিক্ষক রুজিনা আকতার।