শহীদ জননী জাহানারা ইমামের আজ ২৭তম মৃত্যুবার্ষিকী। এ দিনটি উপলক্ষে শনিবার (২৬ জুন) স্মারক বক্তৃতা, স্মৃতি পদক প্রদান ও আন্তর্জাতিক ওয়েবিনার আয়োজন করেছে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। এ ছাড়া তার স্মরণে সভা করবে ছাত্র ইউনিয়ন। এর আগে শুক্রবার (২৫ জুন) নির্মূল কমিটি জানিয়েছে, শহীদ জননীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে কেন্দ্রীয়ভাবে ‘জাহানারা ইমাম স্মারক বক্তৃতা’, আলোচনাসভা এবং ‘জাহানারা ইমাম স্মৃতিপদক’ প্রদানের আয়োজন করা হয়েছে। ওয়েবিনারে ‘জাহানারা ইমাম স্মারক বক্তৃতা’ প্রদান করবেন কথাশিল্পী সেলিনা হোসেন।কমিটি আরও জানায়, ধর্মনিরপেক্ষ মানবতার আন্দোলনে বিশেষ অবদানের জন্য প্রতি বছরের মতো এ বছরও বরেণ্য ব্যক্তিত্ব ও সংগঠনকে ‘জাহানারা ইমাম স্মৃতি পদক’ প্রদান করা হবে। এ বছর (২০২১) ব্যক্তি হিসেবে বঙ্গবন্ধুর সরকারের সময় মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত নারীদের পুনর্বাসন কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত সমাজকর্মী মালেকা খান এবং সংগঠন হিসেবে ‘বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ’-কে জাহানারা ইমাম স্মৃতিপদক প্রদান করা হবে। গত বছর করোনা মহামারি সংক্রমণজনিত লকডাউনের কারণে জাহানারা ইমাম স্মৃতিপদক প্রদান অনুষ্ঠান স্থগিত করা হয়েছিল তবে এ বছর সেটি প্রদান করা হবে।গত বছর (২০২০) ব্যক্তি হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট বাউল গবেষক অধ্যাপক শক্তিনাথ ঝা এবং সংগঠন হিসেবে ‘বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ’-কে জাহানারা ইমাম স্মৃতি পদক প্রদান করা হবে।এদিকে জাহানারা ইমামের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন আজ শনিবার সন্ধ্যা ৬টায় শাহবাগ প্রজন্ম চত্বরে স্মরণসভা এবং মোমবাতি প্রজ্বালন কর্মসূচি পালন করবে। কেমন ছিলেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম:একাত্তরের দিনগুলি’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম ২০ নভেম্বর ১৯৭১ তারিখে তার ডায়েরিতে লিখে গেছেন- ঈদের কোনো আয়োজন নেই আমাদের বাসায়। কারও জামাকাপড় কেনা হয়নি। দরজা-জানালার পর্দা কাচা হয়নি। ঘরের ঝুল ঝাড়া হয়নি। বাসায় ঘরের টেবিলে রাখা হয়নি আতরদান। শরীফ ও জামী ঈদের নামাজও পড়তে যায়নি। কিন্তু আমি ভোরে উঠে ঈদের সেমাই ও জর্দা রেঁধেছি। যদি রুমীর সহযোদ্ধা কেউ আজ আসে এ বাড়িতে?একাত্তরের দিনগুলি এ গ্রন্থে প্রকাশিত লেখাই বলে দেয় এ দেশের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ও পরবর্তীতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের লড়াইয়ে জড়িত প্রত্যেকের ‘আম্মা’ হয়ে ওঠেন জাহানারা ইমাম। আজ ২৬ জুন আম্মার মৃত্যুবার্ষিকী।১৯৭১ সালের ২৯ আগস্ট শাফী ইমাম রুমী ও তার বাবা শরীফ ইমামসহ বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায়। জাহানারা ইমারের বড় ছেলে রুমী নিজে সব স্বীকার করে বাকিদের প্রাণে বাঁচাতে। শরীফ ইমামকে অমানুষিক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে গুরুতর আহত অবস্থায় ছেড়ে দেয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। দেশ স্বাধীনের মাত্র তিন দিন আগে স্বামীকেও হারান জাহানারা ইমাম। এরপর সেই অত্যাচারী দালালদের শাস্তির পথ খুঁজতে রুখে দাঁড়ান জাহানারা ইমাম।৯২ সালের ২৬ মার্চ ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নজিরবিহীন গণ-আদালতে যুদ্ধাপরাধীদের শিরোমণি গোলাম আযমের প্রতীকী বিচার করা হয়। এরপর জাহানারা ইমামের আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে দেশব্যাপী। প্রতীকী বিচার হলো বটে, প্রকৃত বিচারের পথ তখনও মেলেনি।শহীদ জননী জানতেন, জনগণই সকল শক্তির উৎস। আর তাই একাত্তরের ঘাতক ও যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন’ ও ‘একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল সমন্বয় আন্দোলনের’ দায়িত্বভার তিনি বাংলাদেশের জনগণের হাতে অর্পণ করেছিলেন।আম্মা তার শেষ চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘সহযোদ্ধা দেশবাসীগণ, আপনারা গত তিন বছর ধরে একাত্তরের ঘাতক ও যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমসহ স্বাধীনতাবিরোধী সকল অপশক্তির বিরূদ্ধে লড়াই করে আসছেন। এই লড়াইয়ে আপনারা দেশবাসী অভূতপূর্ব ঐক্যবদ্ধতা ও সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। আন্দোলনের শুরুতে আমি আপনাদের সঙ্গে ছিলাম।তিনি লেখেন আমাদের অঙ্গীকার ছিল, লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত কেউ রাজপথ ছেড়ে যাব না। মরণব্যাধি ক্যানসার আমাকে শেষ কামড় দিয়েছে। আমি আমার অঙ্গীকার রেখেছি। রাজপথ ছেড়ে যাইনি। মৃত্যুর পথে বাধা দেওয়ার ক্ষমতা কারও নেই।তিনি তখনই জানতেন, সেদিনের সেই আন্দোলনকে দুস্তর পথ পাড়ি দিতে হবে। দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, মুক্তিযোদ্ধা, ছাত্র ও যুব শক্তি, নারী সমাজসহ দেশের সর্বস্তরের মানুষ এই লড়াইয়ে আছে। শেষবার তিনি অঙ্গীকার পালনের কথা আরেকবার স্মরণ করিয়ে দেন— আপনারা আপনাদের অঙ্গীকার ও ওয়াদা পূরণ করবেন। আন্দোলনের শেষ পর্যায় পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ে থাকবেন। আমি না থাকলেও আপনারা আমার সন্তান-সন্ততিরা আপনাদের উত্তরসূরিরা সোনার বাংলায় থাকবেন।তার উত্তর-প্রজন্ম সেই কথা রেখেছে। ২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চ নিয়ে এই প্রজন্ম হাজির হলেও তারা জাহানারা ইমামের আদর্শকেই সামনে রেখে এগোয়।১৯২৯ সালের ৩ মে ভারতের মুর্শিদাবাদে জন্ম জাহানারা ইমামের। বাবার চাকরি সূত্রে নানা জায়গায় থেকেছেন। শৈশব কেটেছে রংপুরে। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট বাবার সূত্রে বাড়িতে নিয়মিত আসত পত্রপত্রিকা। ক্রমে জাহানারা বইয়ের জগতে ডুবে যান। ১৯৪৮ সালের ৯ আগস্ট ময়মনসিংহে বিয়ে হয় জাহানারা ইমামের। যখন তার বিয়ে হয়, তখন তিনি বিদ্যাময়ী স্কুলের শিক্ষক। ১৯৬৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে এমএ পরীক্ষা দিয়ে পাস করেন তিনি। ১৯৬৬ সালে যোগ দেন টিচার্স ট্রেনিং কলেজে। দুই বছর সেখানে পড়ানোর পর ১৯৬৮ সালে সেই চাকরি ছেড়ে দেন তিনি। ১৯৭১ সালে জাহানারা ইমাম তখন পুরোদস্তুর গৃহিণী। স্বামী- সন্তান হারানোর পরে নেমে আসে দুর্যোগ। বিজয়ের পরে রুমীর সববন্ধুসহ সকল মুক্তিযোদ্ধা তাকে তাদের জননী হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন। জাহানারা ইমাম নিজের কাজের মধ্য দিয়ে এই সন্তানদের কাছে শ্রদ্ধায় হয়ে ওঠেন সবার জননী, প্রিয় আম্মা।জাহানারা ইমাম ১৯৯৪ সালের ২৬ জুন বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ৭টায় মিশিগানের ডেট্টয়েট নগরীর সাইনাই হাসপাতালে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে ৬৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। এরপূর্বে অসুস্থার জন্য তাকে ২ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রে চকিৎসার জন্য নেওয়া হয়। ৪ জুলাই তার মৃতদেহ বাংলাদেশে আনা হয়।
SO/N