দেশি ব্র্যান্ডের দুধের দাম মোটামুটি একই থাকে। আমদানি করা শিশুখাদ্যের দামে নিয়ন্ত্রণ নেই। গত বছরের এপ্রিলে করোনাভাইরাসের প্রেক্ষাপটে চাকরি চলে যায় আরাফাত ইসলামের। তাঁর দুই মেয়ে। একজনের বয়স ৪ বছর, আরেকজনের ২। কর্মহীন হয়ে নিউমার্কেটের এই দোকানি পড়েন বিপাকে। কারণ, তাঁর দুই মেয়ে প্যাকেটজাত দুধ খায়। মেয়েদের খাবার জোগাড় করতে তাঁকে হাত পাততে হয়।
করোনা সংক্রমণের শুরুতে বেড়ে গিয়েছিল গুঁড়া দুধসহ শিশুখাদ্যের দাম। সে দাম এখনো ঊর্ধ্বমুখী। এসব শিশুখাদ্যের দাম সীমিত আয়ের ও নিম্ন আয়ের মানুষের নাগালের বাইরে। মার্চে রোজার আগে বেড়েছে তরল দুধের দামও। কামরাঙ্গীরচরের বাসিন্দা আরাফাত প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার মেয়েরা মায়ের বুকের দুধ পায় না। আবার বাজারে ভালো মানের দুধ কিনে খাওয়ানোর সামর্থ্য আমার নেই। করোনার সময়ে এত বিপদে পড়ি যে হাত পাততে হয় সবার কাছে। এখন মেয়েদের বাজার থেকে তরল দুধ কিনে খাওয়াই।’
বাজারে দেশে উৎপাদিত গুঁড়া দুধের চেয়ে অবশ্য আমদানি করা গুঁড়া দুধের বিক্রি বেশি। আমদানি করা শিশুখাদ্যের দাম আরও লাগামহীন। কারণ, এর দাম নির্ধারিত হয় ব্যবসায়ীদের মর্জিমাফিক। এর বাইরে বাজারে পাওয়া যায় প্রস্তুত করা প্যাকেটজাত শিশুখাদ্য।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, আমদানি করা শিশুখাদ্য ও গুঁড়া দুধের দাম নির্ভর করে পাইকারি ব্যবসায়ীদের ওপর। আর পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, আমদানিকারকেরা দাম বাড়িয়ে দিলে তাঁদের কিছু করার থাকে না। আমদানিকারকেরা বলছেন, প্যাকেটজাত গুঁড়া দুধের তুলনায় বিদেশে টিনজাত গুঁড়া দুধের দাম তুলনামূলক অধিক হারে বাড়ে। দামের এই ওঠানামা অবশ্য নির্ভর করে দুধের সরবরাহের ওপর। সরবরাহে একটু টান পড়লেই পাইকারি বাজার হয়ে তার প্রভাব পড়ে খুচরা বাজারে।
পুরান ঢাকার মৌলভীবাজারের এক আমদানিকারক নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, বন্দরে চালান ঠিকমতো খালাস হলেই বাজারে সরবরাহ থাকে। তখন বিদেশি দুধের দাম বাড়ে না। তবে সরবরাহে একটু ঘাটতি দেখা দিলেই বেড়ে যায় দাম। ব্যবসায়ীরাও সুযোগ বুঝে দাম বাড়িয়ে নেন অনেক সময়।
ব্যবসায়ীদের এই দামের চক্রে অবশ্য কোনো লাভ হয় না নিয়মিত ক্রেতাদের। বরং তাঁদের গুনতে হয় বাড়তি টাকা।
দুই সন্তানের বাবা বেসরকারি চাকরিজীবী নাইমুর রহমান। যাত্রাবাড়ীর এই বাসিন্দা জানালেন, সংসারের একটি বড় খরচই যায় বাচ্চাদের দুধ কিনতে গিয়ে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০১৫ সালের শুরুর দিকে ল্যাকটোজেনের ১ হাজার ৮০০ গ্রামের কৌটা ১ হাজার ৯০০ টাকায় পাওয়া যেত। গত বছরে আমার আরেক সন্তান হয়েছে। তাকেও একই গুঁড়া দুধ খাওয়াই। সেটির দাম বেড়ে এই ছয় বছরে হয়েছে ২ হাজার ৬০০ টাকা।’
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) শনিবারের সর্বশেষ বাজারদরের তালিকা অনুযায়ী, গত এক মাসে ডানো, ডিপ্লোমা, ফ্রেশ ও মার্কস ব্র্যান্ডের গুঁড়া দুধের মূল্যে ব্র্যান্ডভেদে পাঁচ থেকে দশ টাকা করে বেড়েছে। মালিবাগ বাজারে ডানো প্রতি কেজির প্যাকেট ৬৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, এক সপ্তাহ আগে তা ৬৩০ টাকা ছিল। এ ছাড়া প্রতি কেজি ডিপ্লোমা ৬৫০ টাকা, ফ্রেশ ও মার্কস ৫৪০ থেকে ৫৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
কারওয়ান বাজারে পাইকারি দোকানগুলোয় ল্যাকটোজেনের ১ হাজার ৮০০ গ্রামের কৌটা বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৪০০ থেকে ২ হাজার ৫৮০ টাকা দরে। আর নিডো আড়াই কেজির কৌটা দেশে উৎপাদিতটা বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৩৫০ থেকে ২ হাজার ৪০০ টাকায়। একই বাজারে আমদানি করা নিডোর একই মাপের কৌটা বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৯৮০ টাকায়।
মালিবাগ বাজারে অবশ্য দাম আরেকটু বেশি। এই বাজারে ল্যাকটোজেনের ১ হাজার ৮০০ গ্রামের কৌটা বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার ৬০০ টাকা দরে। আর নিডো আড়াই কেজির কৌটা দেশে উৎপাদিতটা বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৪০০ থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকায়। আর আমদানি করা নিডোর একই মাপের কৌটা বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ১০০ থেকে ৩ হাজার ২০০ টাকা।
গুলশান ডিসিসি মার্কেটের এক আমদানিকারক নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বিবেচনায় বাজারে শিশুখাদ্যের সরবরাহ আরও বাড়ানো দরকার। সরবরাহ বাড়লেই দাম একটু স্থিতিশীল থাকে। সরবরাহ একটু কম হলেই বাজারে টান পড়ে। এ সময় শঙ্কায় পড়ে মানুষও হুমড়ি খেয়ে কেনে। তখন দাম হু হু করে বেড়ে যায়।
দেশে করোনা সংক্রমণের মধ্যে গত ১১ মে শিশুখাদ্য আমদানিতে সরকার শর্ত শিথিল করে। গত বছরের মাঝামাঝি জুলাইয়ের দিকে তা আবার প্রত্যাহার করা হয়। এরপর আবার দাম বাড়ে শিশুখাদ্যের। সে দাম কমেনি। বরং দিন দিন বেড়েছে।
গত বছর করোনার প্রকোপে সাধারণ ছুটির পরপরই বাজারে প্যাকেটজাত গুঁড়া দুধের ঘাটতি দেখা যায়। সে সময় আড়াই কেজির কৌটার দুধের দাম ২ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার ৮০০ টাকা, সেটির দাম ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত ওঠে। সে সময় দুই বছর বয়সী মেয়ের জন্য দুধ কিনতে বিপাকে পড়েন ধলপুরের বাসিন্দা মাহমুদুর রহমান। তিনি বলেন, ‘এত টাকা খরচ করে মেয়েকে দুধ খাওয়াতে পারিনি। প্রতি মাসে দুধের খরচই যেত প্রায় সাড়ে চার হাজার টাকা। না পেরে দেশি দুধ মেয়েকে খাওয়ানো শুরু করি। এরপর বাধ্য হয়ে ধীরে ধীরে ঘরের খাবার খাওয়াতে শুরু করি। এখন বাসায় বানানো খাবারই খাওয়াই।’
Pr/N