সাব্বির আলম বাবু, ভোলা প্রতিনিধিঃ চলছে নভেম্বর মাস শুটকি উৎপাদন মৌসুম। ভোলা জেলায় বাণিজ্যিকভাবে শুটকি উৎপাদনের ব্যাপক সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
দক্ষিণের উপজেলা চরফ্যাসন ও মনপুরায় গড়ে উঠছে মৌসুম ভিত্তিক একাধিক শুটকির পল্লী। বছরে এসব স্থানে শত শত টন শুটকি উৎপাদন হয়।
ঢাকা, চট্রগ্রাম, কুমিল্লা, বগুড়া, ময়মনসিংহ, লক্ষীপুরসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় এসব শুটকি সরবরাহ করা হয়। মূলত এসব শুটকির মধ্যে মানুষের খাওয়ার শুটকি ও মাছের খাদ্য তৈরির শুটকি বেশি উৎপাদন করা হয়। প্রথম দিকে সীমিত আকারে শুটকি হলেও সাম্প্রতিক তা বৃদ্ধি পেয়েছে।
নভেম্বর থেকে শুরু করে মার্চ মাস পর্যন্ত এখানে ব্যাপক আকারে শুটকি হয়ে থাকে। সঠিক ব্যবস্থাপনা ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এখানে বৃহৎ আকারে শুটকি উৎপাদন সম্ভব বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা
চরফ্যাসন উপজেলার ঢালচর ইউনিয়নের পূর্ব ঢালচর, কুকরি-মুকরি ইউপির চর পাতিলা ও মনুরা, চর মানিকা ইউনিয়নের চর কচ্ছপিয়া, হাজারিগঞ্জের চর ফকিরা এবং দুলার হাট থানার আশার চরে শুটকি উৎপাদন হয়ে আসছে বেশ কয়েক বছর যাবত। নতুন করে আসলামপুর ও চরমাদ্রাজ ইউনিয়নে শুটকি তৈরি হচ্ছে। মুজিবনগর ইউনিয়নেও শুটকি উৎপাদনের পরিকল্পনা চলছে।
এছাড়া মনপুরা উপজেলার দুটি ইউনিয়নে শুটকি উৎপাদন চলছে ৮/৯ বছর ধরে। শীত মৌসুমে ইলিশের সংকট থাকায় অনেক জেলেই বেকার হয়ে পড়েন। এ সময় তাই বিকল্প কর্মসংস্থান হিসেবে শুটকি পল্লীতে কাজ বেছে নিয়েছেন অনেক জেলে। মাছ ধরার পাশাপাশি শুটকি অনেকের অর্থনৈতিক সচ্ছলতা তৈরি করছে।
চরফ্যাসন উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মারুফ হোসেন মিনার জানান, এখানে সাধারণত চেউয়া মাছের শুটকিটা বেশি হয়।
এছাড়া রুপচাঁদা, লাইট্রা, অনুফা, কাচকি মাছেরও শুটকি হয়। বিশেষ করে কুকরি-মুকরির চর পাতিলা, মনুরা, ঢালচরের পূর্ব ঢালচর শুটকি’র জন্য বিখ্যাত। এ শুটকিতে প্রটিনের পরিমাণ বেশি হওয়ায় মাছের ফিস ফিড তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। মাছ চাষের সময়টাতে এসব শুটকির ব্যাপক দাম পাওয়া যায়।
স্থানীয়ভাবে সবচে বড় বাজার হচ্ছে দুলার হাট মাছ বাজার। এ উপজেলায় কয়েক হাজার পরিবার এ খাতের সাথে সরাসরি জড়িত বলে জানান তিনি। দুলার হাট মাছ বাজারের শুটকি আড়ৎদার মো: আব্বাস মিয়া বলেন, এটি শুটকির জন্য এ অঞ্চলের সর্ব বৃহৎ একটি বাজার। এখানে প্রাণি খাদ্যের জন্য এক প্রকার শুটকি কেজি বিক্রি হয় ৪০-৪৫ টাকা ও অন্য প্রকার ৬০-৬৫ টাকা।
আর মানুষের খাওয়ার শুটকি বিক্রি হয় কেজি প্রতি ১০০-১২০ টাকা দরে। তবে এ মূল্য উঠা নামা করে। তিনি বলেন, মৌসুমের এ সময়টাতে মাসে এ বাজারে প্রায় ১৮’শ টন করে শুটকি বিক্রি হয়। সর্বনিম্ন ৪০ টাকা কেজি দরে হলেও দাম দাঁড়ায় ৭২ লাখ টাকা। সেই হিসাবে মৌসুমে কয়েক কোটি টাকার শুটকি বেঁচা-কেনা হয়। এখান থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে শুটকি পাঠান তারা। শুটকি উৎপাদনের সাথে জড়িতরা জানান, নদী ও সাগর থেকে মাছ ধরার পর ২/৩ দিন ভালোভাবে রোদে শুকিয়ে নিতে হয়।
এরপর মাঁচা তৈরী করে সেখানে আরো কিছুদিন সংরক্ষণ করতে হয়। পরে উৎকৃষ্ট মানের শুটকি প্রস্তুত সম্পন্ন হলে তা বিক্রির জন্য নেওয়া হয়। দুলার হাট থানার সাগর মোহনার আশার চরে প্রায় দেড় শতাধিক ব্যক্তি শুটকি উৎপাদনের সাথে জড়িত। তাদের এসব পল্লীতে কয়েক হাজার শ্রমিক কাজ করছে।
সেখানে দেখা যায় জেলেদের কর্ম ব্যস্ততা। কেউ রোদে শুটকি শুকাচ্ছেন, কেউ আপনমনে পরিচর্যা করছেন। কেউ আবার মাঁচার ভিতর শুটকি প্রস্তুত করছেন। কেউবা বিক্রির জন্য প্যাকেটজাত করছেন।
এখানকার ব্যবসায়ী মো: বাবুল ব্যাপরী জানান, সাগর কূলের তাদের এ চরের আবহাওয়া সম্পূর্ণ শুটকি তৈরির উপযোগী। গত ৬ দিন আগে তার চাতালের শুটকি বিক্রি করেছেন। ১৬’শ টাকা মণে প্রায় ৪’শ মণ শুটকি বিক্রি করেন। আগামী ২/৩ দিনের মধ্যে নতুন শুটকির জন্য মাছ উঠাবেন বলে জানান তিনি।
অপর ব্যবসায়ী মো: আলআমিন বলেন, বর্তমানে শুটকি উৎপাদনে অনেকেই আগ্রহ দেখাচ্ছে। এসময় মাছ কিছুটা কম থাকায় শ্রমিক হিসাবে প্রচুর জেলেদের পাওয়া যায়। আরো বৃহৎ পরিসরে শুটকি তৈরির পরিকল্পনার কথা বলেন তিনি। মনপুরা উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা ভিক্টর বাইন বলেন, সাম্প্রতি মনপুরায় শুটকির ব্যাপক সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। মনপুরার দক্ষিণ সাকুচিয়া ইউনিয়নের রহমানপুর পুরো গ্রামটাই শুটকি উৎপাদন হয়। এ গ্রামটি আর্শ গ্রাম হতে পারে শুটকি তৈরিতে। এছাড়া মনপুরা ইউনিয়নের কলাতুলি চরেও শুটকি তৈরি হয়ে আসছে। প্রত্যেক বছরই এর চাহিদা বাড়ছে। তাই উৎপাদনও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
শুটকি পল্লীর শ্রমিক নাসির মিয়া, জুলহাস আলী ও রফিক হোসেন বলেন, তারা গত চার বছর ধরে শুটকি পল্লীতে কাজ করছেন। ফলে নদীতে মাছ না থাকার সময়টাতে তারা স্বচ্ছল রয়েছেন। জেলে মো: আলাউদ্দিন সিকদার, আক্তার হোসেন ও মো: শফিকুল বেপারী জানান, শুটকি উৎপাদনের আয়ে তাদের ভালো চলছে।