ডেস্ক রিপোর্টঃ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক সংকট মেটাতে এবার বিনা বেতনে ও বিনা সম্মানিতে কাজ করতে ইচ্ছুক এমন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক খুঁজছে সরকার। অবসরপ্রাপ্ত আগ্রহী শিক্ষকদের তালিকা চেয়ে জেলা শিক্ষা অফিসারদের কাছে চিঠিও পাঠিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর।
অধিদপ্তর সূত্র জানিয়েছে, সারা দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া চলমান থাকার পরও শিক্ষকের অনেক পদ শূন্য রয়েছে। ফলে ওই সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠদান বিঘ্নিত হচ্ছে। মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নেও সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। এছাড়া আদালতের রায়ের আলোকে পুলভুক্ত শিক্ষকদের নিয়োগ না দিয়ে নতুন করে শিক্ষক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশ করা যাচ্ছে না। এ কারণে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের দিয়ে প্রতি উপজেলায় ১০ জনের একটি শিক্ষক রিসোর্স পুল গঠন করা হবে।
মাঠ পর্যায়ে পাঠানো চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ‘এ কার্যক্রম সম্পূর্ণ বিনা বেতনে এবং বিনা সম্মানিতে এবং সমাজ কল্যাণমূলক কার্যক্রম হিসাবে বিবেচিত হবে। এ কাজের স্বীকৃতি হিসাবে সনদপত্র দেওয়া যেতে পারে।’
এর আগেও উপজেলা পর্যায় থেকে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের তালিকা সংগ্রহ করা হয়েছে। সেখানে বিনা বেতনে, বিনা সম্মানিতে কথাটি উল্লেখ ছিল না। তবে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর বলছে, ‘অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের তালিকা চেয়ে পাঠানো আগের চিঠিটি বাতিল করা হয়েছে, যেখানে বিনা বেতনে শব্দটি উল্লেখ ছিল না’।
একটি সূত্র জানিয়েছে, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের নিয়োগ দেয়া হবে এমন বিষয়টি প্রকাশ পাবার পর বিভিন্ন মহল থেতে তদ্বির শুরু হয়। এছাড়া পুল শিক্ষক এবং প্যানেল শিক্ষক নিয়ে মন্ত্রণালয়ের তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে। যে শিক্ষকদের নিয়োগ দেয়া হবে তাদের বেতন ভাতা সংক্রান্ত জটিলতা ছাড়াও আইনি সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। এ কারণে আগের চিঠি বাতিল করে বিনা বেতনে, বিনা সম্মানিতে কথাটি সংযুক্ত করে দেওয়া হয়েছে।
গতকাল নওগাঁ থেকে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক আনোয়ার হোসেন এসে জানতে চান, ‘তালিকায় আমার নাম পাঠানো হয়েছে। কবে নিয়োগ পাব। বেতন দেয়া হবে।’ তখন অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা তাকে জানান, স্বেচ্ছায় বিনাবেতনে কাজ করতে হবে। একথা শোনার পর অবসরপ্রাপ্ত ওই শিক্ষক বলেন, এটা কেমন কথা। এই বয়সে এসেও বিনাবেতনে কাজ করব। তিনি বলেন, ‘আমি সরকারের এই শর্তে রাজি নই। তালিকা থেকে আমার নাম বাদ দিন। ’
যার স্বাক্ষরে এই চিঠি জেলা পর্যায়ে পৌঁছেছে তিনি হলেন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক আনোয়ারুল হক। গতকাল সোমবার তিনি শেষ দিনের অফিস করেছেন। এর আগের দিন তিনি অবসরের জন্য আনুষ্ঠানিক বিদায় নেন অধিদপ্তর থেকে। এই কর্মকর্তা ইত্তেফাক প্রতিনিধিকে জানান, ‘অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের কাছ থেকে মতামত, পরামর্শ নেয়া হবে। বিনা সম্মানিতে এদের কাজ করতে হবে। এর আগে যে তালিকা নেয়া হয়েছে তা বাতিল করা হয়েছে’।
একাধিক জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আগের তালিকা থেকে বাছাই শেষে শিক্ষকদের নির্ধারিত সম্মানি দিয়ে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেবে সরকার আমরা এমনই ধারণা করেছি। এমনভাবে বিষয়টি প্রকাশের কারণে অসংখ্য অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক আবেদন করেছেন, যারা আবারো এ পেশায় অর্থের বিনিময়ে শ্রম দিতে চান। মন্ত্রণালয় থেকে চিঠিতে সুনির্দিষ্ট কোনো বেতন বা নিয়োগের কথা ছিল না। তবে আমরা খবর নিয়ে জেনেছি তাদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেবে, বেতন ভাতাও দেয়া হবে।
ঝালকাঠির জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নির্মল চন্দ্র হালদার জানিয়েছেন, এর আগে সম্মানি দেয়া হবে এ কারণে শিক্ষকরা আবেদন করেছেন। এমন ৭০ শিক্ষকের তালিকা অধিদপ্তরে পাঠানো হয়েছে। তবে এবার বিনা বেতনে বলার কারণে আর শিক্ষকরা আগ্রহী হচ্ছেন না। রাজাপুর থেকে তিনজন শিক্ষক আবেদন করেছেন যারা স্বেচ্ছাশ্রমে শিক্ষকতায় রাজি। তিনি বলেন, তেমন সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। যতগুলো আবেদন পাওয়া যায় তা নভেম্বরের মধ্যেই অধিদপ্তরে পাঠানো হবে। এ সংক্রান্ত আগের চিঠিও বহাল বলে তিনি জানেন।
টাঙ্গাইলের জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আতাউর রহমান বলেন, বিনা বেতনে কাজ করতে রাজি নন কেউ। এছাড়া কোনো সম্মানি বা বেতন ছাড়া একজন শিক্ষককে কিভাবে শিক্ষকতার প্রস্তাব দেব এটা নিয়েও দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছি। তবু মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত মেনেই কাজ করতে হবে।
প্রাথমিক শিক্ষা সমিতির সভাপতি আবদুর রহমান অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের নিয়োগের বিষয়টি ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছেন বলে জানান। টাঙ্গাইলের একটি স্কুলের সহকারি শিক্ষক রফিকুল ইসলাম বলেন, সরকারের উদ্যোগটি ভালো। তবে অবশ্যই সম্মানিত ভিত্তিতে নিয়োগ দিতে হবে।
চাকরি প্রার্থীরা একমত নন
তবে সরকারের এই উদ্যোগের সাথে একমত নন চাকরিপ্রার্থীরা। তাদের বক্তব্য, সরকার নিয়োগ দিয়েই শিক্ষক সংকট মেটাতে পারে। কিন্তু দীর্ঘদিন চাকরির পর আবার কেন তাদের নিয়োগ দেয়া হবে। নিয়োগ দিতে না পারার ব্যর্থতা মন্ত্রণালয়ের। সরকারের এই সিদ্ধান্তে দেশে বেকারের সংখ্যা আরো বাড়বে।
রাজধানীর মিরপুর কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রিধারী আমিনুল ইসলাম বলেন, চাহিদা অনুযায়ী কর্মসংস্থান না থাকায় প্রাথমিক শিক্ষায় এখন উচ্চতর ডিগ্রিধারীরাও যাচ্ছেন। কিন্তু সরকার যদি উচ্চতর ডিগ্রিধারীদের নিয়োগ না দিয়ে অবসরপ্রাপ্তদের খুঁজে খুঁজে আবার নিয়োগ দেয় তাহলে আমরা কোথায় যাব।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৬৩ হাজার
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ৬৩ হাজার ৬০১টি। নতুন জাতীয়করণ করা হয়েছে প্রায় ২৬ হাজার স্কুল। এসব বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৩ লাখ। বর্তমানে ৩০ হাজার শিক্ষকের সংকট রয়েছে।
মহাপরিচালকের বক্তব্য
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো: আলমগীর বলেন, অবসরপ্রাপ্ত ভালো শিক্ষক যাতে হারিয়ে না যান সে কারণে এ উদ্যোগ। অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকরা শিক্ষা সংক্রান্ত বিভিন্ন পরামর্শ দেবেন। অন্য শিক্ষকরা মতামত নেবেন। সভায় তাকে ডাকবেন। এই সব শিক্ষককে ক্লাস নিতে হবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ওই শিক্ষক যদি মনে করেন ক্লাস নেয়া দরকার তাহলে ক্লাস নেবেন। আর কোনো সভায় যদি সম্মানি থাকে তবে অন্যান্যদের মতো তিনিও পাবেন। ট্রেনিংয়ে বক্তা হিসাবে আনা হবে। সম্মানি থাকলে অন্যান্যদের মতো তিনিও পাবেন। তিনি জানান, এখন শিক্ষক সংকট কমে গেছে। ১২ হাজারের মতো শিক্ষক পদ শূন্য আছে।
আই/এন