ডেস্ক স্পোর্টসঃ অবিশ্বাস। ছোট্ট একটি শব্দ। কিন্তু প্রভাব অনেক গভীর। মুহূর্তেই চারপাশটা বিষাদে ঢাকে, বিষিয়ে তোলে। সুন্দর সম্পর্কগুলো ঝড়ের মতো লন্ডভন্ড করে দেয়, আবার কখনো উড়িয়ে নিয়ে আছড়ে ফেলে। অথচ পূর্বাভাসে সতর্ক হলে ঝড় সামাল দেওয়া কোনো বিষয়ই না।

 অহনা-আদিলের (ছদ্মনাম) কথা বলি। কলেজে পড়ার দিনগুলোতে বন্ধুত্ব থেকে ভালো লাগা-ভালোবাসার সম্পর্ক। এরপর একসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে। চমৎকার জুটি হিসেবে ক্যাম্পাসে সবার কাছে পরিচিত। অনার্সের শেষ বর্ষের শেষের দিকে তাঁদের আর একসঙ্গে দেখা যায় না। কেউ কারও ছায়া মাড়ে না। এমন কী হলো যে সম্পর্কটা হঠাৎ ভেঙে গেল?

প্রথমে অনীহা দেখালেও পরে অহনা বললেন, ‘একটা অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেওয়ার তাড়া ছিল। হুট করে আমার ল্যাপটপটা নষ্ট হয়ে গেল। আমি ওর ল্যাপটপ নিলাম। ওর ল্যাপটপে ইন্টারনেটের ব্রাউজিং হিস্ট্রি (যেসব ওয়েবসাইট দেখা হয়েছে, তার তালিকা) দেখে আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। সেখানে ঘুরেফিরে বেশ কিছু মেয়ের ফেসবুক আইডি। মনে হলো নিয়মিত তাদের সঙ্গে ওর যোগাযোগ হয়। সন্দেহ হলো। ওর কাছে জানতে চাইলাম ঘটনা কী? ও এটা-সেটা বলে বোঝানোর চেষ্টা করল। কিন্তু আমি আর তাকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। প্রতারিত বোধ করছিলাম। এ নিয়ে মান-অভিমান, কথা-কাটাকাটি, তুমুল ঝগড়াঝাটিতে চরম তিক্ততায় পৌঁছাল সম্পর্কটা। এরপর শেষ।’

এটা শুধুই অবিশ্বাস, নাকি প্রতারণা তা যাচাই করা যায়নি। তবে সঙ্গীকে সন্দেহ করার বিষয়টা এমনি এমনি আলোচনায় আসে না। প্রতি পাঁচজনে একজন সঙ্গীর সঙ্গে প্রতারণা করে বলেই হয়তো সম্পর্কে সন্দেহ-অবিশ্বাস নিয়ে এত আলোচনা হয়। এক হাজার ইউরোপীয় ও মার্কিন নাগরিকের ওপর পরিচালিত জরিপের প্রসঙ্গ টেনে রিডার্স ডাইজেস্ট এমনটা বলছে।

তাই বলে সঙ্গী প্রতারণা করছে এমন অবিশ্বাসের কারণে সম্পর্ক তিক্ত করার কোনো মানে নেই। জীবনটা তাতে হয়ে উঠতে পারে স্নেহা-শোভনের (ছদ্মনাম) মতো। স্নেহা মিশুক প্রকৃতির হাসিখুশি স্মার্ট মেয়ে। শোভনের এটা পছন্দ না। কোনো বন্ধু বা সহকর্মী স্নেহাকে ফোন করলেই সন্দেহ করেন তিনি। রাগারাগি করেন। অফিস থেকে ফিরতে দেরি হলেও একই অবস্থা। কারও সঙ্গে হেসে সুন্দর করে কথা বললেও শুনতে হয়, ‘এত রং-ঢং করে কথা বলো কেন? প্রেমে পড়েছ নাকি!’ অহেতুক অবিশ্বাস বিষিয়ে উঠেছে দাম্পত্যটা।

এই জামানায় সন্দেহবাতিক ব্যক্তিদের মধ্যে কী কী বিষয় দেখা যায়, ২০১৫ সালের জরিপের বরাত দিয়ে রিডার্স ডাইজেস্ট সেটাও উল্লেখ করেছে। বলা হয়েছে, যাদের মধ্যে সন্দেহপ্রবণতা আছে, তারা সঙ্গীর ফোনে নজরদারি, খুদে বার্তা পড়া, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কর্মকাণ্ড নজরদারিতে রাখা, ওয়েবসাইটের তালিকা দেখা, সঙ্গীর কাছের বন্ধুদের কাছে এটা-সেটা জানতে চাওয়া, গোপনে পিছু নেওয়ার মতো এক বা একাধিক কাজ করে।

সম্পর্কে অবিশ্বাস কি তবে মানুষকে অন্ধ করে দেয়? ভালোবাসা ঢেকে যায় সেই আঁধারে! কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কি এমন অবস্থার বর্ণনা করতেই লিখেছিলেন, ‘কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে, তোমারে দেখিতে দেয় না?’ কথাটার সঙ্গে মিল রেখে প্রশ্ন তোলা যায়, কেন মনের আকাশে অবিশ্বাসের আনাগোনা?

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক মেখলা সরকার বলেন, কিছু মানুষ হীনম্মন্যতায় ভোগেন। নিজের প্রতি আস্থা রাখতে পারেন না। এমন ব্যক্তিত্বের মানুষ সন্দেহপ্রবণ হন বেশি। সম্পর্কে পরস্পরের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাসের ঘাটতি এই অবিশ্বাসকে আরও উসকে দেয়। সম্পর্কের শীতলতা, মানসিক দূরত্ব, পরস্পরের প্রতি উদাসীনতা মনের গহিনে যে শূন্যতার সৃষ্টি করে; সন্দেহকে আলিঙ্গন করে মানুষ তখন স্বস্তি আর সান্ত্বনা খোঁজেন।

অথচ সচেতন হলে সম্পর্কটা হতে পারে সুপ্তি আর সুজনের (ছদ্মনাম) মতো। শান্ত স্বভাবের সুপ্তির জগৎটা চাকরি আর সংসার নিয়ে। হঠাৎ ফোনে কথা বলার মাত্রাটা বেড়ে গেল। সুজনের চোখ এড়াল না। জানতে চাইলে সুপ্তির উত্তর—অনেক দিন পর পুরোনো বন্ধুর খোঁজ মিলেছে। তাঁর সঙ্গেই জমে থাকা এত কথা! সুজনের মন মানতে চায় না। অনুচিত জেনেও গোপনে স্ত্রীর ফোন হাতড়ে কিছু না পেয়ে বোধোদয় হয় তাঁর। সিদ্ধান্ত নেন স্ত্রীর সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করার।

সুপ্তি সুজনকে বলেন, যার ফোন নিয়ে এত কিছু, তিনি তাঁর ছোটবেলার বন্ধু। তাঁদের মধ্যে শুধুই বন্ধুত্ব, আর কিছু নেই। বৈচিত্র্যহীন-একঘেয়ে জীবন নিয়ে হতাশ তিনি। পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে কথা বললে ভালো লাগে। দুজনই তখন বুঝতে পারেন, চাকরি আর টাকার পেছনে ছুটতে গিয়ে দাম্পত্যে শীতলতা এসেছে। নিজেদের ভালোবাসাটা মরেনি, তবে মলিন হয়েছে অযত্নে। সেটাকে বর্ণিল-প্রাণবন্ত করার সিদ্ধান্ত নেন তাঁরা।

মেখলা সরকারও মনে করেন, খোলামেলা আলোচনার মাধ্যমে সম্পর্কে সন্দেহের বিষয়টি সহজেই মেটানো যায়। কোনো অবহেলা, উদাসীনতা বা শীতলতা থাকলে তা সারাতে যত্নবান হতে হবে। কেউ কেউ আছেন, যাঁদের বিশ্বাস ভঙ্গের পূর্ব ইতিহাস আছে, সঙ্গীর আস্থা ও বিশ্বাস অর্জনের জন্য তাঁদের একটু বাড়তি চেষ্টা করতে হবে। তবে অহেতুক সন্দেহ মাত্রা ছাড়ালে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।

প্রতিটা মানুষই আলাদা। চলনে, বলনে, ব্যক্তিত্বে। হঠাৎ করে যদি এসবে পরিবর্তন দেখা যায়, তখন অবিশ্বাস মনে দানা বাঁধতে পারে। সেটাকে ডালপালা ছড়াতে না দিয়ে আস্থা, বিশ্বাস আর ভালোবাসা নিয়ে মুখোমুখি হোন। একসঙ্গে বেড়ানো, সিনেমা দেখা বা গান শোনার মতো ভালো লাগার কিছু করুন। ভালোবাসাময় সম্পর্ক দেখে সন্দেহ তখন জানালা দিয়ে পালাবে।

  P/A/N

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে