বিডি নীয়ালা নিউজ(২০ই ফেব্রুয়ারী১৬)-কৃষি প্রতিবেদনঃ রবি মৌসুমের শুরুতে সারাদেশ থেকে সার সংকটের খবর এসেছে। বরিশাল, খুলনাসহ দক্ষিণাঞ্চলে কৃষকরা দোকানে সার পায়নি ডিসেম্বর মাসে। পত্রিকান্তরে খবর এসেছে গোডাউনে সার নেই। সার মজুদের তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এবার রবি মৌসুমে সার সঙ্কট হতে পারে। সার ছাড়া ফসল হয় না। বিশেষ করে বোরো ধান সার ছাড়া হয়ই না। দেশের মোট ধান উৎপাদনের প্রায় ৬০ ভাগই বোরো ধান। সারের অভাবে বোরো ধানের ফলন কম হলে দেশ বিরাট খাদ্য ঘাটতিতে পড়বে। এমনিতে গতবছর খাদ্য ঘাটতি পূরণের জন্য ৩৩ লাখ ২০ হাজার টন শুধু গমই আমদানি করেছিল। এবার ৯ লাখ টন চাল ও সাড়ে ৮ লাখ টন গম আমদানি প্রক্রিয়া চলছে। সারের চাহিদা পূরণ করে ফলন বাড়াতে হবে। সার সঙ্কট হলে সারের অপচয় রোধের জন্য অথবা সার সাশ্রয়ের জন্য বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক কলাকৌশল অবলম্বন করা প্রয়োজন।
ফসল উৎপাদনের জন্য সারা বছরের মোট চাহিদার প্রায় অর্ধেক সার জানুয়ারি-ফেব্রচ্ছারি মাসে লাগে। দেশের ধান উৎপাদনে শতকরা ৮২ ভাগ সার ব্যবহার হয় বোরো ধানে। সার ব্যবহারের ভরা মওসুম রবি। চলতি বছর সরকার সারের চাহিদা নির্ধারণ করেছে ইউরিয়া ২৮ লাখ ৫১ হাজার মেট্রিক টন, টিএসপি ৫ লাখ ৭০ হাজার মেট্রিক টন, এমওপি ৪ লাখ ৩০ হাজার ২০৩ মেট্রিক টন এবং ডিএপি ২ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন। শুধু বোরো মওসুমে সরকার চাহিদা নির্ধারণ করেছেÑ ইউরিয়া ১৬ লাখ ৫০ হাজার ৯১৮ মেট্রিক টন; টিএসপি ২ লাখ ৯০ হাজার ৭৩৫ মে.টন, এমওপি ২ লাখ ৩৪ হাজার ২০৩ মে.টন এবং ডিএপি ১ লাখ ৭৯ হাজার ১৫৮ মে.টন। বর্তমানে সরকারের কাছে ইউরিয়া মজুদ আছেÑ মাত্র সাড়ে ৪ লাখ টন। শুধু বোরোতেই ঘাটতি হচ্ছে ১২ লাখ টন।
বাংলাদেশ কেমিকেল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন (বিসিআইসি) সূত্রে জানা গেছে, সরকারি প্রতিষ্ঠান বিসিআইসি ১১ লাখ ৫০ হাজার টন ইউরিয়া উৎপাদন করতে পারবে। ঘাটতি থাকবে ১৬ লাখ ৮১ হাজার টন। এর মধ্যে কাফকো বাংলাদেশ থেকে ৬ লাখ টন, কাতার থেকে ৩ লাখ টন, সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ৬ লাখ টন এবং দরপত্রের মাধ্যমে ৪ লাখ ৮১ হাজার টন সার সংগ্রহের পরিকল্পনা করেছে শিল্প মন্ত্রণালয়। গ্যাস সঙ্কটের জন্য বিসিআইসির নিয়ন্ত্রণাধীন ৪টি সার কারখানা গত বছরের এপ্রিল থেকে বন্ধ ছিল। অক্টোবর ২০১০এ চালু হলেও গ্যাসের চাপ কম থাকাতে ইউরিয়ার উৎপাদন দৈনিক লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেক হচ্ছে। অপর দিকে আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম বাড়ায় ৭৫ হাজার টন ইউরিয়া সরবরাহের চুক্তি করেও মেসার্স আরকে এন্টারপ্রাইজ এবং মেসার্স এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিয়াল সার সরবরাহ করতে পারে নি। গত এক মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে ইউরিয়া ও নন ইউরিয়া সারের দাম টন প্রতি ১শ’ থেকে দেড়শ’ টাকা বেড়েছে যদিও সরকার ভর্তুকি দিয়ে সারের দাম তৃতীয় দফা কমিয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক চাপে গ্রীণহাউজ গ্যাস কমাতে চীন, বেলারুশ, তিউনেশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কাতারের অনেক সার কারখানা বন্ধ করে দিয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয় এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে গণমাধ্যমকে বলেছে বোরো মৌসুমে সার সঙ্কটের কোন আশঙ্কা নেই। বিদেশ থেকে প্রতিমাসে ইউরিয়া আমদানি অব্যাহত আছে। বিসিআইসির ৬টি ইউরিয়া সার কারখানার মধ্যে ৫টিতে উৎপাদন অব্যাহত আছে।
সার সঙ্কট হোক আর না হোকÑ ফসলের উৎপাদন খরচ কমানো, কৃষকের খরচ কমানো, পরিবেশ ভালো রাখা, গ্যাস সাশ্রয়, জমি সুস্থ রাখাসহ বিভিন্ন কারণেই রাসায়নিক সার কম ব্যবহার করা উচিত। তাই কম সার দিয়ে বেশি সারের কাজ করাণোর কৌশল আমাদের জানা থাকা উচিত।
সার সাশ্রয়ের সহজ উপায়ঃ
ফসল উৎপাদনের জন্য গাছের খাদ্য পুষ্টি প্রয়োজন। মাটিতে গাছের খাদ্যপুষ্টি ঘাটতি থাকায় এবং ফসলের ফলন ও গুণগতমান বৃদ্ধির জন্য সার প্রয়োগ করা প্রয়োজন কিন্তু সার প্রয়োগের পর থেকে বিভিন্ন কারণে সারের প্রচুর অপচয় হয়। ফলে প্রয়োজনের অতিরিক্ত সার প্রয়োগ করতে হয়। এতে ফসলের উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়, কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রাসায়নিক সারের মধ্যে ইউরিয়া সারের অপচয় সবচেয়ে বেশি হয়। জমিতে প্রয়োগকৃত ইউরিয়া সারের শতকরা ৪০ ভাগ গাছ গ্রহণ করতে পারে। বাকি শতকরা ২০ ভাগ বাস্পীভূত হয় এবং ৪০ ভাগ জমিতে নষ্ট হয়। যদি একটি ধানের জমিতে হেক্টর প্রতি ২০০ কেজি ইউরিয়া অনুমোদিত মাত্রা হয়। শতকরা ৫০ ভাগ অপচয় হলে তাই আরো ১০০ কেজি অর্থাৎ মোট ৩০০ কেজি সার দিতে হবে। অর্থাৎ ১০০ কেজি ইউরিয়ার টাকা অতিরিক্ত লাগবে। ফসফেট সার (টিএসপি) অপচয় হয় না। পটাশজাতীয় সার (এমপি) ও গোবরসার কিছু অপচয় হয়। তবে সঠিক পদ্ধতিতে সার প্রয়োগ করলে সারের অপচয় কমানো যায়। এতে কৃষক লাভবান হবে, দেশে সারের চাহিদা মেটানো যাবে, মাটির স্বাস্থ্য ভালো থাকবে এবং পরিবেশ ভালো থাকবে। নিচে সার প্রয়োগের সঠিক নিয়ম উল্লেখ করা হলো। এ নিয়মগুলো যথাযথভাবে মেনে জমিতে সার প্রয়োগ করলে সারের সাশ্রয় হবে, উৎপাদন খরচও কম হবে।
মাটিতে সার মিশিয়ে দেয়াঃ ইউরিয়া, পটাশ ও গোবরসার জমিতে প্রয়োগ করে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া উচিত। হাত বা নিড়ানি যন্ত্র দিয়ে এ সার মেশানো যায়। এতে সার বাষ্পীভূত অথবা অন্য কোনো উপায়ে নষ্ট হয় না।v
জমির পানি সরিয়ে সার প্রয়োগ করাঃ জমিতে পানি থাকা অবস্থায় ইউরিয়া সার প্রয়োগ করলে পানির সাথে দ্রবীভূত হয়ে প্রায় সম্পূর্ণসার অ্যামোনিয়াম গ্যাসরূপে বাস্পীভূত হয়। গাছ কোন সার গ্রহণ করার সুযোগ পায় না। এজন্য জমির পানি সরিয়ে ইউরিয়া সার প্রয়োগ করা উচিত।v
আগাছা দমনের পর সার প্রয়োগঃ সব সারই জমির আগাছা দমন করার পর প্রয়োগ করা উচিত। অন্যথায় আগাছা সব সার গ্রহণ করবে।v
জাতের ভিত্তিতে সার প্রয়োগঃ উচ্চফলনশীল ও হাইব্রিড জাতের ফসল দেশী ফসলের চেয়ে সার বেশি গ্রহণ করে। তাই দেশী ফসলে সার বেশি দিলে গাছের দৈহিক বৃদ্ধি বেশি হয় এবং ফলন কম হয়।v
সঠিক সময়ে সার প্রয়োগ করাঃ জমি তৈরির শেষ পর্যায়ে ইউরিয়া সার দিলে গাছের কোনো কাজে লাগে না। কারণ নতুন লাগানো চারা অথবা বপনকৃত বীজ থেকে চারা গজিয়ে নতুন কুশি বের হওয়ার সময় সারের প্রয়োজন হয়। ইউরিয়া তিন কিস্তিতে দেয়া প্রয়োজন। ১ম উপরি প্রয়োগ দিতে হয় প্রাথমিক কুশি অবস্থায়, ২য় উপরিপ্রয়োগ সর্বোচ্ছ কুশি অবস্থায় ও ৩য় উপরিপ্রয়োগ কাইচ থোড় আসার কয়েকদিন আগে। উল্লেখ্য, ইউরিয়া সার জমিতে প্রয়োগের পর ৪-৫ দিন এর প্রভাব থাকে। এর মধ্যে গাছ ইউরিয়া সার যতটুকু গ্রহণ করতে পারে ততটুকুই কাজে লাগে বাকিটুকু নষ্ট হয়। চারা বেশি দাবিয়ে জমিতে রোপণ করলে চারা সহজে সার গ্রহণ করতে পারে না। ফলে সারের অপচয় হয়।v
য় শুকনা মাটিতে সার দেয়া যাবে নাঃ রসবিহীন মাটি থেকে গাছ সার গ্রহণ করতে পারে না। ফলে সারের অপচয় হয়। মাটিতে রস থাকা অবস্থায় সার দিতে হবে।v
সঠিক পদ্ধতিতে সার প্রয়োগঃ ছিটানো পদ্ধতিতে সার বেশি লাগে এবং অপচয় হয়। ফসলের সারিতে গাছের গোড়ায়, গুটি ইউরিয়া গাছের শিকড়ের কাছে লাঙল দিয়ে মাটির নিচে, গাছের চারপাশে মাটির গর্তে, ব্যান্ড পদ্ধতি, মাডবল পদ্ধতি ইত্যাদি পদ্ধতিতে সার দিলে সারের পরিমাণ কম লাগে। তবে সার যেন গাছের শিকড়ে না লাগে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ইউরিয়া সার গাছের শিকড়ে লাগলে গাছ মারা যাবে।v
য়বৃষ্টির আগে ও পরে সার প্রয়োগ করা যাবে নাঃ বৃষ্টির আগে ও পরে সার প্রয়োগ করলে বৃষ্টির পানির সাথে সার ধুয়ে চলে যাবে। বৃষ্টিতে সার ছিটালে গাছে পাতা পোড়া রোগ হতে পারে।
গাছের ভিজা পাতায় সার দেয়া যাবে নাঃ গাছের ভেজা অবস্থায় সার ছিটালে গাছের পাতা পুড়ে যায়।v
গাছের চাহিদা বিবেচনা করে সার প্রয়োগঃ ফসলের শিকড় বিস্তারের সময় গাছের দ্রুত বৃদ্ধির সময়, শিষ বের হওয়ার সময়, শাখা-প্রশাখা বিস্তারের সময়, ফুল ধরার সময় সারের চাহিদা বেড়ে যায়। এ সময়গুলোতে সার দিলে গাছ দ্র”ত সার গ্রহণ করে। ফলে সারের অপচয় হয় না।v
ফসল বিলম্বের বপন বা রোপন করলে সারের পরিমাণ কম লাগে। এজন্য তখন নির্দিষ্ট মাত্রার চেয়ে সার কম দিতে হয়।v
সমান দূরত্বের চারা লাগালে এবং চারা পাতলা করার সময় সঠিক দূরত্ব বজায় রাখলে সারের কার্যকারিতা বাড়ে এবং সারের অপচয় কম হয়।v
মাটিতে সার না থাকলে অথবা অন্য কোনো কারণে সার মাটিতে না দিয়ে তরল করে পাতায় ¯েপ্র করলে সার কম লাগে। একটি পরীক্ষা থেকে জানা যায়, ৪ কেজি জিংক সালফেট পাতায় ¯েপ্র করলে ৫০ কেজি একই সার মাটিতে প্রয়োগের সমান কাজ করে।v
সালফর আবৃত ইউরিয়া সার বা কাদা মাটির সাথে ইউরিয়া মিশিয়ে ছোট বল তৈরি করে ব্যবহার করলে সারের অপচয় কম হয়।v
পটাশ জাতীয় সার সম্পূর্ণ একবারে না দিয়ে ২-৩ কিস্তিতে দিলে গাছ সব সার গ্রহণ করতে পারে।v
গোবর সার রোদের তাপ, আর্দ্রতার অভাব, বৃষ্টিপাত ও চুয়ানির ফলে গোবরের প্রায় অর্ধেক অপচয় হয়। এজন্য গর্ত করে গোবর সংরক্ষণ করে কমপক্ষে ১৫দিন রেখে পরে জমিতে প্রয়োগ করতে হয়। গোবর সার মাটির সাথে ভালোভাবে হাত দিয়ে মিশিয়ে দিতে হয়। উক্ত পদ্ধতিগুলোতে সার প্রয়োগ করলে অনুমোদিত মাত্রার চেয়ে সার কম লাগবে। এতে দেশের সার সঙ্কট কমবে কৃষকও উপকৃত হবে।v
গুটি ইউরিয়া প্রয়োগ করলে ৩০-৪০ ভাগ কম সার লাগে। ধানের চার গোছার মাঝে একবার একটি গুটি মাটির ভেতর দেয়া হয়। এতে সারের বাস্পীভবনজনিত অপচয় হয় না। ফলন ২০-৩০ ভাগ বৃদ্ধি পায়। কার্যকরিতা শতকরা ৭০ ভাগ বেশি। একগবেষণায় দেখা গেছে, গুটি ইউরিয়ায় বিঘাপ্রতি ধানের ফলন জমি ভেদে ১৬৫ কেজি পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। সার কম লাগে বলে পরিবেশ ভালো থাকে।v
বোরো ধানে এজোলা, কুটিপানা, এনাবিনা, নষ্টক এগুলো ব্যবহার করলে ইউরিয়া সার লাগে না। এগুলো ধানেেত জন্মানোর পর মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হয়।v
লিফ কালার র্চাট ব্যবহার করলে ইউরিয়া কম লাগে। লিফ কালার চার্টের মাধ্যমে গাছের চাহিদার সময়ে উপযুক্ত পরিমাণে সার প্রয়োগ করা যায়। এতে সার কম লাগে এবং কার্যকারিতাও বেশি হয়।v
ডাল ও শিম জাতীয় ফসলে ইউরিয়ার পরিবর্তে জীবাণুসার ব্যবহার করলে খরচ কম হয়, উৎপাদন বেশি হয় ও পরিবেশ ভালো থাকে।v
সার সংকট হোক আর না হোক সবসময়েই সার সাশ্রয়ের কলাকৌশল প্রয়োগ করা উচিত। এতে সার কম লাগবে, কৃষকের খরচ কম হবে, উৎপাদন খরচ কমবে ও পরিবেশ ভালো থাকবে। সারের দাম বর্তমান সরকার তিন দফায় কমিয়েছে। সারের দাম কম বলেই সার বেশি দেয়া ঠিক নয়। কারণ সার বেশি দিলে খরচ বেশি হয়, ফলন কম হয়, মাটির উর্বরতা নষ্ট হয় ও পরিবেশ খারাপ হয়। সারের অপচয় রোধ করতে পারলে দেশের গ্যাস ও বিদ্যুতেরও সাশ্রয় হবে। এজন্য সরকারসহ সবাইকে সার সাশ্রয়ে এগিয়ে আসা প্রয়োজন।
লেখকঃ কৃষিবিদ ফরহাদ আহাম্মেদ (কৃষি প্রাবন্ধিক)
সূত্রঃ কৃষিবার্তা