ডেস্ক রিপোর্ট : রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ হলে পরিবেশ বিপর্যয়ে জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশের সুন্দরবন থেকে ভারতীয় অংশে চলে যাবে রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ সকল প্রাণী। বিশ্ব ঐতিহ্যের সুন্দরবনকে হারাবে বাংলাদেশ। এটি না থাকলে ভবিষ্যতে আইলা ও সিডরের মতো ঝড়ের হাত থেকে বাঁচতে পারবে না দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ। এলাকার নদীর পানি ও প্রাণীবৈচিত্র্য নষ্ট হবে। এসিড বৃষ্টি হওয়া ছাড়াও ২৩ ধরনের ক্ষতিকর পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে সবাই। মৎস্য ও মধু সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহকারী লাখ লাখ মানুষ কর্মহীন হবে। ৫৩টি পরিবেশবাদী ও সামাজিক সংগঠন এবং সুশীল সমাজ রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের বিরুদ্ধে জোরালো অবস্থান নিয়েছে। সামাজিক মাধ্যমগুলোতে সরব প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে সচেতন নাগরিকরা। বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে সরকারে থাকা জাতীয় পার্টি ও বামদলসহ সকল রাজনৈতিক দল বিরোধিতা করেছে। তারপরেও দেশের স্বার্থকে না দেখে জনমত ও রাজনৈতিক মতের বিরুদ্ধে গিয়ে সুন্দরবনকে হুমকিতে ফেলে রামপালে বিদ্যুকেন্দ্র নির্মাণে ভারতের সঙ্গে চুক্তি করেছে সরকার। বিদ্যুৎকেন্দ্র ইস্যুতেই সর্বশেষ খুলনা সিটি মেয়র নির্বাচনে গ্রহণযোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের প্রার্থী হেরেছে। সামনে আসছে মধ্যবর্তী জাতীয় নির্বাচন। নীতিনির্ধারণী ও বিশ্লেষকরা বিশ্বাস করছেন, দেশের জনগণের বিরুদ্ধে গিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করলে জাতীয় নির্বাচনেও প্রভাব পড়বে। জনগণ দাবি করেছে আমাদের একটিই সুন্দরবন আছে। এর বিকল্প নেই, এটি নষ্ট হলে আর পাওয়া যাবে না। কিন্তু বিকল্প জায়গায় বিদ্যুৎকেন্দ্র হতে পারে।সাম্প্রতিক সময়ে গত ১ জুলাইয়ে গুলশানে আইএস নাম দিয়ে জঙ্গি হামলা ও ৭ জুলাইয়ে শোলাকিয়ায় ঈদের জামায়াতে জঙ্গি হামলার কারণে পুরো দেশ ছিলে থমথমে। নিরাপত্তা ঝুঁকিতে থাকার পরেও হঠাৎ করেই গত ১২ জুলাই সুন্দরবনের রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য অবকাঠামো নির্মাণে ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করেছে সরকার। বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ হলে পরিবেশ বিপর্যয়ে জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশের সুন্দরবন থেকে ভারতীয় অংশে চলে যাবে রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ সকল প্রাণী। পরিবেশ বিপর্যয়ের কবলে পড়বে খুলনাসহ পুরো দক্ষিণাঞ্চল। পশুর, রুপসাসহ আশপাশের নদীর নাব্যতা কমবে। নদীর মিষ্টি পানি লোনা পানিতে পরিণত হবে। এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ভারত ১৫ শতাংশ বিনিয়োগ করে অর্ধেক মুনাফার মালিক হবে। সেই মুনাফার উপর আবার কর দিবে না। দেশের অন্যান্য বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদিত বিদ্যুতের চেয়ে বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনতে হবে বাংলাদেশকে। ভারতে থাকা সুন্দরবনের কিছু অংশের কাছেই এ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে চেয়েছিল এনটিপিস। কিন্তু দেশটির পরিবেশ মন্ত্রণালয় তা করতে দেয়নি। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের আপত্তিকে মানেনি। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, বিশ্ব ঐতিহ্য ও পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন ধ্বংস হবে। এজন্য সরকারে থাকা জাতীয় পার্টি, সকল বামদল, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো, পরিবেশবাদী ও সুশীল সমাজ এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের বিপক্ষে। কিন্তু সরকারের নীতি নির্ধারকরা তা মানছেন না।রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র : বাগেরহাটের রামপালে ১৩২০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ভারতের ন্যাশনাল থারমাল পাওয়ার কোম্পানী (এনটিপিসি) এবং বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) চুক্তি স্বাক্ষর করে ২০১০ সালের এপ্রিল মাসে। সরকারি হিসাবে যা সুন্দরবন থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে। বাস্তবে যা সুন্দরবন থেকে মাত্র ৯.৫০ কি. মি. থেকে ১০ কি. মি. দূরে অবস্থিত। সরকার আইনি জটিলতা এড়াতে কারচুপি করে কাগজে- কলমে প্রকল্প এলাকর দূরত্ব দেখিয়েছে ১৪ কি.মি.। পশুর নদীর তীর ঘেঁষে এজন্য ১৮৩৪ একর জমির অধিগ্রহণ করা হয়েছে। ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত্ব বিদ্যুৎ সংস্থা এনটিপিসি এবং বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) যৌথভাবে একটি কোম্পানি গঠন করেছে। বাংলাদেশ-ভারত ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড নামের এই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান করা হয়েছে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ সচিব মনোয়ার ইসলামকে।২০১৩ সালের গত ৫ অক্টোবর তরিঘড়ি করে ভেড়ামারায় ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের সাথে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এই কেন্দ্র নির্মাণের আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন। রিমোট টিপে ভারত-বাংলাদেশ বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন উদ্বোধনের সঙ্গে সঙ্গে বাগেরহাট রামপালে মৈত্রী সুপার থারমাল পাওয়ার প্রকল্পেরও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের উদ্বোধন করেন। প্রধানমন্ত্রী কুষ্টিয়া থেকেই রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উদ্বোধনের বিষয়টি রাজনৈতিক অঙ্গনে মুখরোচক আলোচনার জন্ম দেয়। প্রকল্প এলাকা রামপালে ২২ অক্টোবর উদ্বোধন করার থাকলেও হঠাৎ করে তা বাতিল হয় এ বিষয়ে তখন প্রয়াত সাংবাদিক এবিএম মুসা এক আলোচনা সভায় বলেছিলেন, আগামী নির্বাচনও হবে রিমোট কন্ট্রোল টিপে। বাঘ চলে যাবে ভারতে : রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ হলে পরিবেশ বিপর্যয়ে জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশের সুন্দরবন থেকে ভারতীয় অংশে চলে যাবে রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ সকল প্রাণী। বিশ্ব ঐতিহ্যের সুন্দরবনকে হারাবে বাংলাদেশ। এটি না থাকলে ভবিষ্যতে আইলা ও সিডরের মতো ঝড়ের হাত থেকে বাঁচতে পারবে না দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ। ফলে পরিবেশ বিপর্যয়ে খাদ্য সঙ্কটে বাংলাদেশের রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ সকল প্রাণী ভারতের বনের দিকে ছুটবে। বাঘের কারণেই টিকে আছে সুন্দরবন। বাঘ না থাকলে সুন্দরবনও ধ্বংস হয়ে যাবে মানুষের আগ্রাসী থাবায়।ভারতে হয়নি : এনটিপিসি তার নিজ দেশ ভারতের মধ্যপ্রদেশে ১৩২০ মেগাওয়াটের একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের প্রস্তাব দিয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। কৃষি ও পরিবেশগত সমস্যা হবে, সে কারণেই ভারত সরকার এনটিপিসির প্রস্তাব বাতিল করে দেয়। ২০০৭ সালে রাজীব গান্ধী ন্যশনাল পার্ক থেকে ২০ কি.মি. দূরে ১০০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার একটি কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র করার পরিকল্পনা করে, কিন্তু জনগণের বিরোধিতার কারণে ২০০৮ সালে এই প্রকল্প বাতিল করতে বাধ্য হয় ভারত সরকার। ঐ বনাঞ্চলটি ছিল সুন্দরবন বাংলাদেশ অংশের মাত্র ১০ ভাগের ১ ভাগ। ভারতেও রামপালের বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ : ওয়াইল্ড লাইফ প্রটেকশান অ্যাক্ট ১৯৭২’ অনুযায়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রের ১৫ কি.মি. ব্যাসার্ধের মধ্যে কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ স্থাপন করা যায় না। দেশটির পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় প্রণীত পরিবেশ সমীক্ষা বা ইআইএ গাইড লাইন ম্যনুয়াল ২০১০ অনুযায়ী কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ২৫ কিমি-এর মধ্যে কোন বাঘ, হাতি সংরক্ষণ অঞ্চল, বন্য প্রাণীর অভয়ারণ্য কিংবা অন্যকোন সংরক্ষিত বনাঞ্চল থাকা চলবে না। এছাড়াও ভারতের পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের ‘তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন সংক্রান্ত গাইডলাইন ১৯৮৭’ অনুসারেও কোন সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ২৫ কি.মি.-এর মধ্যে কোনো কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ স্থাপন করা যায় না। রামপালে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে এবার রাজপথে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে ভারতের পরিবেশপ্রেমী এবং পশ্চিম বাংলার সাধারণ মানুষ। বাংলাদেশের রামপালে কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হলে ভারতের পশ্চিম বাংলায়ও সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা করছে ভারতের পরিবেশবিদরা। তাই রামপালের তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষের আন্দোলনকে ভারতের পরিবেশপ্রেমীরা সমর্থন করছে। এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পশ্চিম বাংলার মানুষকে সচেতন করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।১৫ শতাংশ বিনিয়োগে অর্ধেক মালিকানা ভারতের : রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ২০১ কোটি ডলার। এর ৭০ শতাংশ ব্যাংক ঋণ নেয়া হবে,(৭০ ভাগ ঋণের সুদ টানা এবং ঋণ পরিশোধ করার দায়িত্ব বাংলাদেশের)। ১৫ শতাংশ অর্থ দেবে পিডিবি এবং বাকি ১৫ শতাংশ দেবে ভারতের এনটিপিসি। ওই প্রকল্পের জন্য পুরো জমি, অবকাঠামোগত বিভিন্ন কিছু, সব সরবরাহ করবে বাংলাদেশ। এই কেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ কিনতে হবে পিডিবিকে। নিট লাভের অর্ধেক নিয়ে নেবে ভারত অর্থাৎ লাভ ফিফটি ফিফটি। সেই লাভের টাকায় পুরো ১০ বছর পর্যন্ত কোন কর দিবে না বাংলাদেশকে এমন চুক্তি করে নিয়েছে। এর মানে হলো ১৫ শতাংশ বিনিয়োগ ও ঋণের টাকা উসুল করার প্রক্রিয়া নিশ্চিত করে নিয়েছে ভারত। নির্মাণ কাজও করবে ভারতীয় কোম্পানি। এভাবে বাংলাদেশ থেকে রেমিটেন্স নিয়ে যাবে। যদি কোন কারণে বিদ্যুৎকেন্দ্র লাভবান না হয়, তাহলেও কোন সমস্যা নেই ভারতের। চুক্তি অনুযায়ী কয়লা আমদানির দায়িত্ব বাংলাদেশের এবং ক্ষয়ক্ষতির দায় বহন করতে হবে বাংলাদেশকে। আন্তর্জাতিক কোন প্রতিষ্ঠান অর্থ দিতে রাজি হয়নি : পরিবেশের ক্ষতি হবে বলে আন্তর্জাতিক কোন প্রতিষ্ঠান অর্থ দিতে রাজি হয়নি। এ বিদ্যুৎকেন্দ্রে অর্থ বিনিয়োগ করতে না বলেছে বিশ্ব ব্যাংক ও এডিবি। বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে শুধু ইন্ডিয়ান ব্যাংক অর্থ দিচ্ছে বাংলাদেশকে। তাও ঋণ হিসেবে।বেশি দামে কিনতে হবে বিদ্যুৎ : আমাদের দেশীয় কোম্পানি ওরিয়ন গ্রুপের সঙ্গে গত ২০ ডিসেম্বর ২০১১ পিডিবির যে ক্রয় চুক্তি হয়েছে, সে অনুযায়ী, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর মধ্যে ৫২২ মেগাওয়াটের একটি হবে মুন্সিগঞ্জের মাওয়ায়। এছাড়া খুলনার লবণচরা ও চট্টগ্রামের আনোয়ারায় ২৮৩ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন দুটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র হবে। সেখানে বলা আছে মাওয়া থেকে কিনবে ৪ টাকা প্রতি ইউনিট। আর লবনচরা ও আনোয়ারার কেন্দ্র থেকে কিনবে ৩ টাকা ৮০ পয়সা করে। কিন্তু রামপালের কেন্দ্র থেকে কিনতে হবে ৮ টাকা ৮৫ পয়সা করে। কারণ এনটিপিসি ও পিডিবি ইতোমধ্যেই প্রতি টন ১৪৫ ডলার করে কয়লা আমদানি চূড়ান্ত করে ফেলেছে। প্রথমে ঠিক করা হয়েছিল, যদি কয়লার দাম প্রতি টন ১০৫ ডলার হয় তবে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম হবে ৫ টাকা ৯০ পয়সা এবং প্রতিটন ১৪৫ ডলার হলে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ ৮ টাকা ৮৫ পয়সা। এ প্রকল্পে ২৩ ধরনের ক্ষতি হবে : বিষেশজ্ঞদের গবেষণার উঠে এসেছে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মিত হলে দৃশ্যত ২৩ ধরণের ক্ষতি হবে। ২০১১ সালের ৫ মে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. আবদুস সাত্তারের নেতৃত্বে পরিবেশবিদদের একটি দল প্রস্তাবিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের জায়গা পরিদর্শন করে। তারা নিবিড় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কারণে সুন্দরবনের ২৩ ধরণের ক্ষতির হিসাব তুলে ধরেন। সুন্দরবনের স্বাভাবিক চরিত্র বিনষ্ট হবে, তৈরি হবে অসংখ্য কয়লা ডিপো, শুরু হবে গাছ কাটা, বনে আগুন লাগানো এবং বাঘ, হরিণ ও কুমির ধরা। কয়লা পোড়া সালফার ডাই-অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড, কার্বন মনো-অক্সাইড, কার্বন ডাই-অক্সাইড, ক্লোরোফ্লোরো কার্বন প্রভৃতি সুন্দরবনের জীবমণ্ডল ও বায়ুমণ্ডলকে দূষিত করবে। সালফার ডাই-অক্সাইড ও কার্বন যৌগসমূহ থেকে সৃষ্ট গ্রিন হাউস গ্যাস বনের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর এসিড বৃষ্টি ঘটাবে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের শিক্ষক আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী ২০১১ সালের আগস্ট থেকে ২০১২ সালের জুলাই পর্যন্ত বাগেরহাটের রামপাল ও মংলা উপজেলা এবং সুন্দরবন এলাকার ওপর গবেষণা শেষে একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। প্রতিবেদনে আশঙ্কা করা হয়, রামপালে এ ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হলে ২০ বছরের মধ্যে এলাকার পানি, বাতাস ও মাটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এলাকার পানি শতভাগ, বাতাস ৯০ ভাগ এবং মাটি ৬৫ ভাগ দূষিত হয়ে পড়বে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও মাটিতে লবণাক্ততা বাড়বে। উপেক্ষিত পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় : পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় ৩০ আগষ্ট ১৯৯৯ সালে এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সুন্দরবন রিজার্ভ ফরেস্ট ও এর চতুর্দিকে ১০ কি.মি. এলাকাকে পরিবেশগত সঙ্কটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করেছে। তবে এ বিষয়ে কর্ণপাত করছে না সরকার। প্রধান বন সংরক্ষক স্বাক্ষরিত ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১১ তারিখে এক পত্রে উল্লেখ করেন, “Sundarbans Ramsar Site সুন্দরবন অংশ যার Legal Custodian বন অধিদফতর। সুন্দরবনের অভ্যন্তরে এবং Landscape zone এ কয়লাভিত্তিক পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপন করা হলে সুন্দরবনের Royal Bengal Tiger তথা জীব বৈচিত্র্য হুমকির সম্মুখীন হবে।” অর্থনৈতিক অঞ্চল সুন্দরবন : সুন্দরবন বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল। ১৯১১ সালে সুন্দরবনের মোট আয়তন ছিল প্রায় ১৭ হাজার বর্গ কি. মি. এবং বর্তমানে সুন্দরবনের আয়তন প্রায় ১০ হাজার বর্গ কি. মি.। বাংলাদেশে প্রায় ৬০১৭ বর্গ কি. মি, এবং বাকিটা ভারতে। আন্তর্জাতিক গুরুত্ব বিবেচনায় সুন্দরবনের অংশ বিশেষকে ১৯৯২ সালের ২১ মে ‘রামসার এলাকা (Ramsar Site) ঘোষণা করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৯৭ সালে UNESCO সুন্দরবনকে ‘বিশ্ব ঐতিহ্য’ (World Heritage Site) হিসাবে ঘোষণা করে। বাংলাদেশের দক্ষিণের ৫টি জেলা সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, পিরোজপুর ও বরগুনার প্রায় ১৭টি উপজেলার লাখ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষভাবে তাদের জীবন জীবিকার জন্য সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল। রামপাল-মংলায় এখন ১৬টি ইউনিয়নের মধ্যে ১৪টি ইউনিয়নে ধান চাষ তেমন হচ্ছে না। অথচ ২০০০ সালের আগে এখানে প্রতি বিঘা জমিতে ২০ থেকে ৩০ মণ ধান উৎপাদন হত। লাখ লাখ মানুষ কর্মহীন হবে। এদের উপর নির্ভরশীল ২ থেকে ৩ কোটি মানুষ জীবিকা হারাবে। ইউনেস্কো ও রামসার উদ্বেগ : সংরক্ষিত সুন্দরবনের অতি সন্নিকটে তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্তে বাংলাদেশ সরকারের কাছে লিখিত পত্রের মাধ্যমে রামসার কর্তৃপক্ষ এবং ইউনেস্কো উদ্বেগ প্রকাশ করেছে (পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়, ২০১২)। প্রস্তাবিত প্রকল্প বিষয়ে পরিবেশ অধিদফতর এ মর্মে মতামত প্রদান করে যে, “A notable portion of Sundarbans falls under the Bagerhat district. Department of Environment is concerned about the possible adverse impact on the rich biodiversities of Sundarban Ramsar Site due to implementation of this said Project.”সরকারি প্রচারনায় ফাঁকি : সরকার দূষণ কমানোর জন্য যে ‘‘আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল মেথড” ব্যবহারের কথা বলছে তাতে পরিবেশের দূষণ খুব একটা বেশি কমবে না। ড. এস. সি. সিটাল, পরিচালক, এনটিপিসির তথ্য অনুসারে, ভারত আশা করছে ২০১৭ সালে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারবে, তাতে শতকরা ১২ ভাগ পরিবেশ দূষণ কম হবে। অর্থাৎ শতকরা ৮৮ ভাগ দূষণ অব্যাহত থাকবে। গ্রামের একজন সাধারণ মানুষের ভাষায়, ‘‘নাকের উপর দুই ইঞ্চি পানি আর একহাত পানি সমান কথা”। সুতরাং Advance Ultra Supercritical Thermal Power Plant or Clean Coal কোনটিই আমাদের সুন্দরবনকে রক্ষা করতে পারবে না। এ বিষয়ে পরিবেশ তেল-গ্যাস-খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির নেতা আনু মুহাম্মদ বলেন, ভারতীয় মন্ত্রী রিমোট কন্ট্রোল উদ্বোধনের সময় বলেছেন, এখানে সুপার ক্রিটিক্যাল পদ্ধতিতে কোল বেজড পাওয়ার প্লান্ট করবেন। কিন্তু যে পদ্ধতিটি তাঁরা বাংলাদেশে করতে চাচ্ছেন সেটি তারা নিজেদের দেশেই করতে পারেননি। পরীক্ষামূলকভাবে শুরু করলেও হরিয়ানা, গুজরাট ও মধ্যপ্রদেশের স্থানীয় লোকজনের আপত্তির মুখে তা বন্ধ করে দিয়েছেন। ইন্ডিয়ান এটমিক কমিশনের চেয়ারম্যান এ ধরনের প্রকল্পকে অতি উচ্চাভিলাষী বলে মন্তব্য করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার সেটা মানছে না ভারতকে খুশি করতে গিয়ে। এই প্রকল্পের ওপর স্থিতাবস্থা চেয়ে হাইকোর্টে একটি রিটও দায়ের করা হলেও তা বাতিল করা হয়। লবণ পানি ঢুকবে মিঠা পনিতে : পিডিবি অফিসিয়াল হিসাবে এ ধরনের কয়লাভিত্তিক প্রকল্প প্রতি ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে প্রায় ২.২ বিলিয়ন গ্যালন পানির (মিষ্টি পানি) প্রয়োজন হয়। তা নেওয়া হবে পশুর নদী থেকে। পশুর নদীর পানি নোনা ও মিঠা জলের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে এবং ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের প্রয়োজন মেটাতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। এই নদীটির সাথে ওই গোটা অঞ্চলের সামগ্রিক জীববৈচিত্র্যের সংযোগ রয়েছে। এটি ওই অঞ্চলের জনবসতির ক্ষেত্রের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি নদী। কিন্তু এই প্রকল্প তৈরি করতে গিয়ে আমরা সেই নদীর অস্তিত্বকেই বিপন্ন করে ফেলব। যদিও এরই মধ্যে বিকল্প প্রস্তাবনা তৈরি করেছে। তা হলো পানি সংগ্রহ করা হবে মাটির নিচ থেকে। এক হাজার ফুট গভীর থেকে এই বিপুল পরিমাণ পানি তুললে এ অঞ্চলের ভূ-অভ্যন্তরে লবণ পানি ঢুকবে, যা মারাত্মক পরিবেশ দূষণ ডেকে আনবে।সুন্দরবনের বাফার জোন থেকে মাত্র ৪ কিমি দূরে : সুন্দরবনের পরিবেশগত সঙ্কটাপন্ন এলাকা ‘বাফার জোন’ থেকে মাত্র ০৪ কিলোমিটারের মধ্যে নির্মাণ করা হচ্ছে এ বিদ্যুৎকেন্দ্র। বাফার জোন হল পশু-পাখিদের জন্য জঙ্গলের সংরক্ষিত এলাকা। সাধারণত এই ধরনের জায়গায় যাতে নিশ্চিন্তে পশু পাখি বসবাস করতে পারে এজন্য ব্যবস্থা রাখা হয়। এই সব পশু পাখি বন ও পরিবেশের জন্য অপরিহার্য। অবস্থিত এই স্থানে কয়লা ভিত্তিক এই তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মিত হলে তা থেকে বিষাক্ত গ্যাস ও রাসায়নিক বর্জ্যে নিশ্চিতভাবেই সুন্দরবনের সকল গাছপালা, তৃণলতা-গুল্ম, পশু-পাখী, জলজ প্রাণীসহ সার্বিক ও অন্য জীব-বৈচিত্র্য ধ্বংস হবে। আলোচকদের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী : দেশ-বিদেশের বিজ্ঞানী ও পরিবেশবিদসহ সকল মহল বিজ্ঞান-ভিত্তিক যুক্তি দিয়ে বলেছেন, এ বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দু’ভাবেই সুন্দরবনের পরিবেশ, প্রতিবেশ ও বাংলাদেশের অর্থনীতির অপূরণীয় ক্ষতি করবে। বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীর আমন্ত্রণে গত ১৯ জুন ২০১৬ তারিখে বিদ্যুৎ ভবনে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের কোন যুক্তিই সরকারি পক্ষ খণ্ডন করতে পারেননি। এই সভার শেষ পর্যায়ে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ নিজেকে ‘কোন পক্ষের নয়, দুই পক্ষের মাঝখানের’ বলে অভিহিত করেন ও আরো আলোচনার আশ্বাস প্রদান করেন। অথচ তার কয়েকদিনের মধ্যেই রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র কর্তৃপক্ষ ও নির্মাণকারী কোম্পানির মধ্যে অবকাঠামো নির্মাণের চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়েছে। এর আগেও ২০১৩ সালের ১২ এপ্রিল রামপালে ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের “পরিবেশগত প্রভাব নিরুপণ” বিষয় জনমত পর্যালোচনা সভার আয়োজন করে পিডিবি। বিকাল ৩.৩০টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত এ বিষয় বিশদ আলোচনা করেন বিশেষজ্ঞগণ। এতে অংশ নেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), তেল গ্যাস বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি, বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের সভাপতি অধ্যাপক আব্দুলাহ আবু সায়ীদ, সেভ দি সুন্দরবনসহ বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিবৃন্দ। আলোচনায় সরকারের প্রতিনিধি ছাড়া সবাই এর তীব্র বিরোধিতা করেন এবং ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরেন। পরিশেষে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী মহোদয় সবাইকে এই বলে আশ্বস্থ করেছিলেন যে, আপনাদের সাথে আলোচনা না করে কিছু করা হবে না। কিন্তু সরকার কারো সাথে কোন আলোচনা না করেই ভারতের সাথে এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য ৩টি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে।কয়লাতেও চতুরামী : উচ্চমানের কয়লা ব্যবহারের কথা বলছে ভারতীয় উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান। ভারতীয় প্রতিষ্ঠান উচ্চমানের কয়লা আনবে কোন এলাকা থেকে। ভারতীয় কয়লার মান নিম্ন তা বিশ্বে প্রচারিত। আর নিম্নমানের কয়লার ঝুঁকি হলো তা পোড়ালে পরিবেশের ঝুঁকিটা আরও বেশি। এ কয়লা যে স্থানে সংরক্ষিত করা হবে সে স্থান একেবারেই অকেজো হয়ে যাবে। কয়লা থেকে এক ধরনের তরল পদার্থ চুইয়ে পড়ে। সে তরল পদার্থ নদীতে মিশবে। একই সঙ্গে ভূ-গর্ভের পানিতে মিশবে। সবকিছু সরকারের বিপক্ষে গেলেও শুধু রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও এক শ্রেণীর আমলাদের পকেট ভারীর জন্য এ প্রকল্প বাস্তবায়নের দিকে যাচ্ছে সরকার বলেই মনে করছে দেশবাসী।সুশীল সমাজ, রাজনৈতিক দল ও ৫৩টি সামাজিক সংগঠনের প্রতিবাদ : রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের বিরুদ্ধে লংমার্চসহ নিয়মিত প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছে তেল, গ্যাস, খনিজ-সম্পদ রক্ষা জাতীয় কমিটি। বাংলাদেশের ৫৩টি সামাজিক আন্দোলনের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটি। গত ১ আগস্ট সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক সুলতানা কামাল বলেছেন, সুন্দরবন ধ্বংস করে এই রামপাল প্রকল্প নির্মাণ প্রশ্নে বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের অযৌক্তিক অনমনীয় অবস্থান দুই দেশ ও সারা বিশ্বের সকল সচেতন ও যুক্তিবান মানুষের জন্যই একটি গভীর উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অতএব, হাজার হাজার বছরের পরিপূর্ণতায় যে অনন্য সুন্দরবন তৈরি হয়েছে তা সম্পদ ও পরিবেশ বিনাশী কোন কর্মকাণ্ড দ্বারা যাতে বিনষ্ট না হয় সে বিষয়টি দুই দেশের সরকার বিবেচনা করবে বলে আমরা আশা করি। এটি সময়ের দাবি, দেশবাসীর দাবি, সারা বিশ্বের দাবি। তাই জনস্বার্থ ও সুন্দরবন বিরোধী সকল সরকারি অপপ্রচার বন্ধ করে, জনদাবি মেনে নিয়ে বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনকে বাঁচানোর স্বার্থে রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পটি অবিলম্বে বাতিল বা নিদেন পক্ষে সুন্দরবন থেকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে নেয়ার জন্য। সরকারের বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীর কিছু মন্তব্যও প্রতিবাদও করেছেন তিনি। তেল গ্যাস খনিজ সম্পদ বন্দর বিদ্যুৎ রক্ষা জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক শেখ মুহাম্মদ শহিদুলাহ বলেন, বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণের ফলে কি হবে না হবে তা বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। কিন্তু সুন্দরবনের কি ক্ষতি হবে তা বিবেচনায় নেয়নি সরকার। বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের সভাপতি অধ্যাপক আব্দুলাহ আবু সায়ীদের মতে, সুন্দরবন নিয়ে দেশের মানুষ একটা স্পর্শকাতর অবস্থায় রয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি লাভবান না হওয়ার শঙ্কা : আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এই প্রকল্পের আর্থিক সমীক্ষা প্রতিবেদনও সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে, যাতে বলা হয়েছে যে, রামপাল প্রকল্পের আর্থিক উপযোগিতাও বেশ নেতিবাচক। কারণ এর প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য আর্থিক অনিয়মগুলো বিবেচনায় নিলে এই প্রকল্প কোনভাবেই লাভজনক নয়, বাংলাদেশ-ভারত উভয় দেশেরই সাধারণ মানুষের ্িবশাল অংকের অর্থের অপচয় ঘটবে যার বাস্তব দায় এই বিশাল দরিদ্র জনতাকেই দীর্ঘদিন বহন করতে হবে। সর্বোপরি আন্তর্জাতিক মূল্যায়নে প্রমাণিত হয়েছে যে, প্রকল্পটির সকল পর্যায়েই মানবাধিকার বিষয়টিকে কখনো বিবেচনায় নেয়া হয়নি, স্থানীয় নিরীহ অধিবাসীদের প্রকল্প বিষয়ে কোন মতামত গ্রহণ করা হয়নি, পরিবেশগত সমীক্ষা প্রণয়নের বহু পূর্বেই সাধারণ মানুষের জমাজমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ ও সারা বিশ্বই আজ সুন্দরবন রক্ষার স্বার্থে রামপাল কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের সম্ভাব্য ক্ষতিকর অভিঘাতের বিষয়টি নিয়ে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করে এসেছেন। খোদ বিশ্ব সংস্থা জাতিসংঘের ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কমিটি’ ও ‘রামসার সচিবালয়’ থেকে এই প্রকল্প বিষয়ে উদ্বেগ জানানো হয়েছে। ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কমিটির একটি সমীক্ষক দল ইতোমধ্যে সুন্দরবন ও রামপাল পরিদর্শন করেছেন। কিন্তু তাদের সফর সূচিতে অন্তর্ভুক্ত থাকার পরও সরকারের অসহযোগিতার কারণে বাংলাদেশের সামাজিক আন্দোলনের চারটি সংগঠনের সাথে তাদের বৈঠকগুলো শেষ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়নি। জাতিসঙ্ঘের এই সফর ভিত্তিক প্রতিবেদনটি শেষ পর্যন্ত প্রশ্নবোধক বিষয়ে পরিণত হতে পারে বলেই ধরে নিয়েছেন সবাই। বিশ্বে নেতিবাচক হিবেসে চিহ্নিত হচ্ছে দেশ : দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংগঠন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের সরকারি সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ সম্পর্কে রং সিগন্যাল দিচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগের হাত থেকে বাঁচতে বাংলাদেশ যখন শিল্পোন্নত দেশগুলোর কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি করছে, ঠিক তখন বাংলাদেশ নিজেই পরিবেশের জন্য, বিশেষ করে সুন্দরবন ধ্বংসের মতো একটি প্রকল্প হাতে নিয়ে প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।সুন্দরবন এলাকা দেখানো হয়েছে আবাসিক ও গ্রাম এলাকা হিসেবে : রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি থেকে প্রতিদিন প্রায় ১৪২ টন বিষাক্ত সালফার ডাই-অক্সাইড (বছরে ৫১ হাজার ৮৩০ টন) এবং ৮৫ টন বিষাক্ত নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড (বছরে ৩১ হাজার ২৫ টন) নির্গত হবে। এই বিশাল পরিমাণ বিষাক্ত গ্যাস বাতাসে সালফার ডাই-অক্সাইড ও নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইডের ঘনত্ব তখনকার চেয়ে অনেক গুণ বাড়িয়ে দেবে। ফলে ভয়ানক বিপর্যয়ের মুখে পড়বে সুন্দরবনের প্রাণ ও পরিবেশ। সরকারের করা পরিবেশ সমীক্ষা রিপোর্ট-ইআইএ রিপোর্টে এই জায়গাটাতে জালিয়াতির আশ্রয় নেয়া হয়েছে। নিয়মানুযায়ী সুন্দরবনের জন্য ‘পরিবেশগত স্পর্শকাতর’ মানদণ্ড উল্লেখ করার কথা। অথচ ইআইএ রিপোর্টে সুন্দরবনের জন্য ‘আবাসিক ও গ্রাম’ এলাকার মানদণ্ড ব্যবহার করা হয়েছে। সামাজিক মাধ্যমে প্রতিবাদ ও কৃতদাসের হাসি : রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে সাধারণ মানুষ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্লগ, টুইটার ও ফেসবুকে দিচ্ছে বিভিন্ন স্ট্যাটাস। এর মধ্যে নজর কেড়েছে একটি স্ট্যাটাস। সেটির শিরোনাম করা হয়েছে ‘কৃতদাসের হাসি’। পিডিবির অফিসিয়াল ফেসবুকে গত ১২ জুলাইয়ে ভারতের সঙ্গে করা চুক্তির ছবি দেওয়া হয়। ছবিতে ক্যাপশনে শুধু লেখা হয়, বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশীপ পাওয়ার কোম্পানি (প্রা.) লিমিটেড (বি আইএফপিসিএল) বাগেরহাট জেলার রামপাল উপজেলায় ১৩২০ মে. ও. মৈত্রী সুপার থারমাল পাওয়ার প্রজেক্ট বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ১২ জুলাই, ২০১৬ তারিখে ভারত হেভি ইলেকট্রিক্যালস্ লিমিটেড (বিএইচইএল)-এর সাথে ইপিসি (টার্নকী) চুক্তি স্বাক্ষর করে। কিন্তু এক ব্যক্তি কমেন্টের ঘরে লিখেছন, চুক্তির ছবিটি ঢাকায় আসা ভারতের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদলের উপস্থিতিতে সম্প্রতি চুক্তি সই হয়। এ চুক্তিতে সই করেন ‘বাংলাদেশ-ভারত ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের (বি আইএফপিসিএল)’ ব্যবস্থাপনা পরিচালক উজ্জ্বল কান্তি ভট্টাচার্য ও নির্মাণ ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ‘ভারত হেভি ইলেকট্রিক লিমিটেডের (বিএইচইএল বা ভেল) মহাব্যবস্থাপক প্রেম পাল যাদব।” (প্রথম আলো, ১৩ জুলাই ২০১৬) দুই ভারতীয় কর্মকর্তা চুক্তি স্বাক্ষর করলেন সুন্দরবন বিনাশী বাংলাদেশের একটি প্রকল্পের জন্য! পেছনে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের প্রতিনিধি বলে কথিত উপদেষ্টা, মন্ত্রীসহ উচ্চপদস্থ ব্যক্তিবর্গ করতালি দিতে থাকলেন। মুখভরা হাসি – ক্রীতদাসের হাসি!!রাজনীতিতে রামপালেরর প্রভাব : বিদ্যুৎকেন্দ্র ইস্যুতেই সর্বশেষ খুলনা সিটি মেয়র নির্বাচনে গ্রহণযোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের প্রার্থী হেরেছে। তিনি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি ছিলেন। বাংলাদেশের চলমান সঙ্কট উত্তোরণে এবছরের শেষেই মধ্যবর্তী জাতীয় নির্বাচন হতে পারে বলে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা চলছে। সে হিসাবে সামনে আসছে মধ্যবর্তী জাতীয় নির্বাচন। নীতিনির্ধারণী ও বিশ্লেষকরা বিশ্বাস করছেন, দেশের জনগণের বিরুদ্ধে গিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করলে জাতীয় নির্বাচনেও তার প্রভাব পড়বে। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যেতে পারে সকল জনমত। সুশীল সমাজের আওয়ামী বলয়ের বুদ্ধিজীবীরা পর্যন্ত এই ইস্যুতেও কোন উত্তর দিতে পারবে না জনগণকে। জনগণ দাবি করেছে আমাদের একটিই সুন্দরবন আছে। এর বিকল্প নেই, এটি নষ্ট হলে আর পাওয়া যাবে না। কিন্তু বিকল্প জায়গায় বিদ্যুৎকেন্দ্র হতে পারে।
সো/র/ব