ডেস্ক রিপোর্ট: বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার আবুল কালাম ডিগ্রি কলেজের ইংরেজি বিষয়ের প্রভাষক অমল দাস। ২০১০ সালে তিনি চাকরিতে যোগদান করেন। যোগদানের চার বছরের মাথায় ২০১৪ সাল থেকে তিনি ইংরেজি প্রথম পত্রের পরীক্ষক হন। এ বছরও তিনি পরীক্ষক ছিলেন। চলতি বছরের এইচএসসি পরীক্ষায় উচ্চতর গণিতে যে ১৮ পরীক্ষার্থী উত্তরপত্র জালিয়াতি করেছে বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে তারা অন্যান্য ১২ বিষয়েও জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছে। ওইসব পরীক্ষার্থীর ইংরেজি প্রথমপত্রের পরীক্ষক ছিলেন অমল দাস। শুধু তাই নয়, ১৮ পরীক্ষার্থীর মধ্যে একজন আবুল কালাম কলেজেরই পরীক্ষার্থী। অর্থাৎ যেই কলেজের পরীক্ষার্থী সেই কলেজের শিক্ষকই ছিলেন ইংরেজি বিষয়ের পরীক্ষক! এখানেই শেষ নয়, বরিশাল বিভাগের অন্যান্য পরীক্ষকরা যেখানে খাতা পেয়েছেন ২৫০টি থেকে সর্বোচ্চ ৫০০টি, সেখানে অমল দাসকে খাতা দেয়া হয়েছে ১১ শ’। আবার অনেক পরীক্ষক পেয়েছেন ১৫ শ’ খাতা। একজন পরীক্ষক এত খাতা কিভাবে পান, কিভাবে মূল্যায়ন করেন এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
একাধিক পরীক্ষক বলেছেন, তারা ২০০ থেকে ২৫০ খাতা দেখতে গেলেই হাঁফিয়ে ওঠেন। সেখানে এতগুলো খাতা একজন পরীক্ষক কী মূল্যায়ন করেছেন সেই প্রশ্ন সামনে এসেছে। কোন উদ্দেশ্যে, কার স্বার্থে পরীক্ষকদের এত পরিমাণ খাতা দেয়া হয়েছে এ নিয়ে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে অভিভাবক, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে। তারা বলছেন পরীক্ষকরা শত শত খাতা দেখার কারণেই পরীক্ষার্থীরা সঠিক মূল্যায়ন পায়নি। এতগুলো খাতা কিভাবে পেলেন, কিভাবে এত খাতা মূল্যায়ন করা যায় এমন প্রশ্নের জবাবে পরীক্ষক অমল দাস বলেন, অনেকে ইংরেজি খাতা দেখতে চায় না। খাতা বণ্টনের সময় শিক্ষা বোর্ডে কনফারেন্স হয়। সেখানে সঞ্চালনার দায়িত্বে থাকেন উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অরুণ কুমার গাইন। দেখা যায় অনেক পরীক্ষকই খাতা নিতে আসেন না। তখন অরুণ স্যার আমাদের বলেন, ‘কেউ খাতা বেশি নিতে চাইলে আসবেন দিয়ে দেবো।’ আমরা প্রাইভেট পড়াই না। তাই খাতা দেখা এক রকম আয়ের উৎস্য। তা ছাড়া এপ্রিল ও মে মাসে কলেজ বন্ধ থাকে। ফলে আমি ১১ শ’ খাতা নিয়েছি। আমার চেয়ে সিনিয়র অনেক শিক্ষক পেয়েছেন ১৫ শ’ খাতা। এ বছর আমি যে খাতা দেখেছি তার মধ্যে একটা-দুইটা খাতায় এক শ’ নম্বরের মধ্যে ৯০ পর্যন্ত পেয়েছে। যে ১৮ শিক্ষক জালিয়াতি করে ধরা খেয়েছে তাদের একজন আপনার কলেজের পরীক্ষার্থী। তাহলে আপনার কলেজের পরীক্ষার্থীর খাতা আপনি পেলেন কিভাবে? এমন প্রশ্নর জবাবে অমল দাস বলেন, ‘এটা আমি কী করে বলব।’
একই কলেজের শিক্ষক অনুপম রায় ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষক এবং প্রধান পরীক্ষক। তিনি খাতা পেয়েছেন ১৫ শ’ ১টি। তার অধীনে চারজন পরীক্ষক ছিলেন। তারা প্রত্যেকে ৭০০ করে খাতা পেয়েছেন। তার মানে চারজনে পেয়েছেন ২৮ শ’ খাতা। মোট ৪ হাজার ৩০১টি খাতা তাকে ১৫ দিনের মধ্যে মূল্যায়ন করতে হয়েছে। অনেকে বলছেন এতগুলো খাতায় প্রাপ্ত নম্বর গণনা করতেইতো ১৫ দিন লাগার কথা। এত কম সময়ে এত পরিমাণ খাতা কিভাবে মূল্যায়ন করেছেন পরীক্ষকরা। হয় তারা গণহারে নম্বর দিয়েছেন নয়তো অত্মীয়স্বজনদের দিয়ে খাতা দেখিয়েছেন। যার ফলে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীও ইংজেরিতে ফেল করেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন পরীক্ষক বলেন, দৈনিক বড়জোর ২০-২৫টি খাতা দেখা যায়। এর বেশি দেখতে গেলে মাথা ঘুরায়। সেখানে ১৫ শ’ খাতা কোনো মানুষের পক্ষে দেখা সম্ভব নয় যান্ত্রিক মেশিনের মাধ্যমে সম্ভব। প্রশ্ন হলো- যারা ১৫ শ’ খাতা দেখেছেন তারা মানুষ না মেশিন!
জানতে চাইলে পরীক্ষক অনুপম রায় বলেন, এইচএসসির সময়টায় চাপও কম থাকে, আয়েরও একটা উৎস। তাই আমরা খাতা বেশি নিয়েছি। তা ছাড়া ইংরেজি দ্বিতীয়পত্র একটু কঠিন। অনেকেই পরীক্ষক হতে চান না। খাতা বণ্টনের দিন অনেক পরীক্ষকই উপস্থিত হয়নি। এসব কারণে আমাকে খাতা বেশি দেয়া হয়েছে।
বরিশাল শিক্ষা বোর্ডের অধীনে যে ১৮ জন পরীক্ষার্থী জালিয়াতি করে এবার ধরা পড়েছে তাদের রসায়ন দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষক ছিলেন উজিরপুর শহীদ স্মরণিকা কলেজের প্রভাষক সদানন্দ বিশ্বাস। জালিয়াতিকারীদের মধ্যে তার কলেজের একজন পরীক্ষার্থী রয়েছে। অর্থাৎ তিনিও নিজ কলেজের পরীক্ষার্থীদের খাতা পেয়েছেন। তিনি মোট খাতা পেয়েছিলেন ৫০২টি। জানতে চাইলে তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, গত তিন বছর ধরে আমি রসায়ন দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষক। আমার কলেজের এক ছাত্রের ফলাফল স্থগিত রয়েছে। নিজ কলেজের পরীক্ষার্থীদের খাতা পাওয়ার ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘এইডাতো আমি জানি না।’ আমার কলেজে রসায়ন দ্বিতীয় পত্রে সবাই পাস করেছে। বিএম কলেজের ইংরেজি বিভাগের প্রফেসর শুক্লা রানী ইংরেজি বিষয়ে পরীক্ষক ছিলেন। তিনিও প্রায় ১৫ শ’ খাতা পেয়েছেন। এভাবে শুধু অমল, অনুপম, শুক্লাই নন, বরিশাল শিক্ষা বোর্ডের উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অরুণ কুমার গাইনের ঘনিষ্ঠজনরা সবাই এক থেকে দেড় হাজার খাতা মূল্যায়ন করেছেন। এর ফলে বরিশাল বোর্ডে এইচএসসিতে সবচেয়ে বেশি পরীক্ষার্থী ইংরেজিতে ফেল করেছে। আবার অনেকে প্রত্যাশিত নম্বর না পেয়ে হতাশ হয়েছেন। শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা বলছেন সঠিকভাবে খাতা মূল্যায়ন হয়নি।
এ প্রসঙ্গে বরিশাল শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যান প্রফেসর মোহাম্মদ ইউনুস বলেন, অতিরিক্ত খাতা পাওয়ার বিষয়টি কেবল ইংরেজি বিষয়ের ক্ষেত্রে হয়েছে। কারণ ইংরেজির বেশির ভাগ শিক্ষক প্রাইভেট বাণিজ্যের সাথে জড়িত থাকার কারণে তারা পরীক্ষক হতে চান না। খাতা বণ্টনের সময় অনেক পরীক্ষকই অনুপস্থিত থাকেন। ফলে বাধ্য হয়ে একজন পরীক্ষককে বেশি খাতা দিতে হয়। পরীক্ষার্থী যেই কলেজের পরীক্ষক সেই কলেজের হলেন কিভাবে এমন প্রশ্নের জবাবে প্রফেসর ইউনুস বলেন, ‘আগামী বছর থেকে আর এ সমস্যা থাকবে না।’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেক পরীক্ষক বলেন, ‘এ ধরনের বক্তব্য দিয়ে বোর্ড কর্তৃপক্ষ তাদের দায় এড়ানোর চেষ্টা করছেন। অনেক পরীক্ষক ৫০ থেকে ১০০ খাতা বেশি পাওয়ার জন্য আবেদন করলেও তা গ্রহণ করা হয় না।
N/D/N