আন্তর্জাতিক রিপোর্ট : র্পঞ্চাশ বছর আগে প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে ইসরায়েলের যুদ্ধ শুরু হয়েছিল।সে যুদ্ধের স্থায়িত্ব ছিল মাত্র ছয়দিন।তবে তার প্রভাব এখনো আছে। ১৯৪৮ সালে ইহুদীদের জন্য যখন ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন তার প্রতিবেশ আরব দেশগুলো নতুন এ রাষ্ট্রকে ধ্বংস করার জন্য আক্রমণ চালিয়েছিল। কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়েছিল।মিশরের সেনাবাহিনী ইসরায়েলের কাছে পরাস্ত হয়েছিল। বিভিন্ন জায়গায় মিশরের সেনারা আত্নসমর্পন করলেও একটি জায়গায় আত্নসমর্পন করতে অস্বীকৃতি জানায়।তখন মিশর এবং ইসরায়েলের একদল তরুণ সামরিক কর্মকর্তা সে অচলাবস্থা নিরসনের চেষ্টা করেন।এদের মধ্যে ছিলেন ইসরায়েলের তৎকালীন তরুণ সামরিক অফিসার আইজ্যাক রবিন এবং মিশরীয় সেনাবাহিনীর মেজর গামাল আব্দুল নাসের।এর কয়েক বছর আগে হিটলারের নাৎসি বাহিনী ইউরোপে প্রায় ৬০ লাখ ইহুদিকে হত্যা করে। এর কয়েক বছরের মাথায় ইহুদিদের জন্য একটি আলাদা রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন আলোর মুখ দেখে।
১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্রের গোড়াপত্তনকে ফিলিস্তিনরা তাদের জন্য একটি ‘বিপর্যয়’ মনে করে।যে জায়গাটিতে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেখান থেকে প্রায় সাড়ে সাত লাখ ফিলিস্তিনী পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। সে জায়গায় তারা আর কখনো ফিরে আসতে পারেনি।ইহুদীদের জন্য ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা আরব দেশগুলো মেনে নিতে পারেনি।এর ফলে আরব দেশগুলোতে রাজনৈতিক উত্থান-পতন শুরু হয়। সে গামাল আব্দুল নাসেরের নেতৃত্বে সামরিক বাহিনী মিশরের রাজাকে উৎখাত করে।১৯৫৬ সালে মি: নাসের মিশরের প্রেসিডেন্ট হন। সে বছর তিনি ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং ইসরায়েলের জন্য সুয়েজ খাল বন্ধ করে দেন। এ পদক্ষেপের মাধ্যমে আরব বিশ্বে ‘নায়ক’ হয়ে উঠেন মি: নাসের।
অন্যদিকে ইসরায়েলের সামরিক কর্মকর্তা আইজ্যাক রবিন তার সামরিক জীবন চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ১৯৬৭ সালে তিনি ইসরায়েল সেনাবাহিনীর প্রধান হয়েছিলেন।১৯৪৮ সালে ইসরায়েলের কাছে পরাজয়ের গ্লানি ভুলতে পারছিল না আরব দেশগুলো।অন্যদিকে ইসরায়েলও জানতো যে তার প্রতিবেশী আরব দেশগুলো তাকে ধ্বংসের চেষ্টা করবে। উভয় পক্ষ বুঝতে পারছিল যে আরেকটি যুদ্ধ আসছে।ইসরায়েল এবং আরব দেশগুলো পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস এবং ঘৃণা দিনকে দিন বাড়ছিল। এর মধ্যে ১৯৫০ এবং ৬০’র দশকের স্নায়ুযুদ্ধ সে তিক্ততা আরো বাড়িয়ে দিচ্ছিল।তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন আধুনিক বিমান ব্যবস্থা দিয়ে মিশরকে সাহায্য করেছিল। অন্যদিকে ইসরায়েলের সাথে ভালো সম্পর্ক ছিল আমেরিকার।১৯৬০’র দশকে ফ্রান্স এবং ব্রিটেনের কাছ থেকে যুদ্ধ বিমান এবং ট্যাংক ক্রয় করে ইসরায়েল।
১৯৪৮ সালে যুদ্ধের পর ইসরায়েল তার সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করার জন্য জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। সেনাবাহিনীতে ব্যাপক লোকবল নিয়োগ করা হয়।১৯৬৭ সাল নাগাদ ইসরায়েল একটি দক্ষ সেনাবাহিনী গড়ে তোলে এবং পরমাণু শক্তি অর্জনের কাছাকাছি চলে যায়।আইজ্যাক রবিনের প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস ছিল যে তার সেনাবাহিনী যথেষ্ট শক্তি অর্জন করেছে। তারা বুঝতে পারে, প্রতিটি যুদ্ধে তাদের জিততে হবে। কোন ধরনের পরাজয়ের কথা চিন্তাও করেনি ইসরায়েল।অন্যদিকে মিশর এবং সিরিয়া সামরিক শক্তির দিকে তেমন মনোযোগী হয়নি।সুয়েজ খাল বন্ধ করার মাধ্যমে গামাল আব্দুল নাসের আরবদের কাছ থেকে গৌরব অর্জন করেছিলেন সেটি তাকে ১৯৪৮ সালের পরাজয়ের কথা ভুলিয়ে দিয়েছিল।মি: নাসের তখন প্যান-আরব জাতীয়তাবাদের নেতৃত্ব দিয়েছেন। সেনাবাহিনী গড়ে তোলার প্রতি তেমন মনোযোগ ছিলনা।
এছাড়া সিরিয়ার সেনাবাহিনীও রাজনীতির মধ্যে জড়িয়ে পড়েছিল। দেশটিতে কয়েকটি সামরিক অভ্যুত্থানও হয়েছিল।আরবরা নিজেদের মধ্যে ঐক্য এবং জাতীয়তার কথা বলতো প্রচুর। কিন্তু সেগুলো ছিল কথার কথা। বাস্তবে তার প্রতিফলন দেখা যেতো না । বরং আরবদের মধ্যে বিভক্তি ছিল স্পষ্ট।সিরিয়া এবং মিশরের সরকারগুলো মনে করতে জর্ডান এবং সৌদি আরবের চেষ্টায় তাদের দেশে অভ্যুত্থানের চেষ্টা হচ্ছে। জর্ডানের বাদশাহ হুসেইন ছিলেন ব্রিটেন এবং আমেরিকার ঘনিষ্ঠ মিত্র।মি: হুসেইনের দাদা বাদশাহ আব্দুল্লাহ’র সাথে ইহুদি গোয়েন্দা সংস্থার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল।আরব এবং ইসরায়েলের মধ্যে ক্রমাগত তিক্ততা এবং সীমান্তে ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র সংঘাতের প্রেক্ষাপটে ১৯৬৭ সালের যুদ্ধ শুরু হয়।
ইসরায়েল-মিশর সীমান্ত তুলনামূলক শান্ত ছিল। সবচেয়ে বড় সংঘাতটি হয়েছিল সিরিয়ার সাথে ইসরায়েলের।পশ্চিমা বিশ্ব জানত কোন পক্ষ বেশি শক্তিশালী। আমেরিকা জানতো যে আরব দেশগুলো যদি ইসরায়েলকে সম্মিলিতভাবে আক্রমণ করে তাহলেও তারা জিততে পারবে না।মিশরের বিমান বাহিনী শক্তিশালী থাকলেও তাদের সেনাবাহিনী ছিল দুর্বল।১৯৬৭ সালের জুন মাসের ২ তারিখে ইসরায়েলের সামরিক কর্মকর্তারা যুদ্ধের জন্য তৈরি হয়ে যায়।তারা রাজনীতিবিদদের বুঝিয়েছিলেন যে ইসরায়েল মিশরকে পরাস্ত করতে পারবে।তার কিছুদিন আগে ইসরায়েলের গুপ্তচর সংস্থা মোসাদের প্রধান গোপনে ওয়াশিংটন সফর করেন।তিনি আমেরিকার নেতৃত্বকে জানিয়েছিলেন যে ইসরায়েল যুদ্ধ করতে চায়। ইসরায়েলকে যুদ্ধে যাবার জন্য সবুজ সংকেত দেয় আমেরিকা।অন্যদিকে মিশরের প্রেসিডেন্ট গামাল আবদুল নাসের ধারণা করছিলেন যে ইসরায়েল হয়তো জুন মাসের ৪ অথবা ৫ তারিখে হামলা করতে পারে।১৯৬৭ সালের জুন মাসের ৫ তারিখ সকাল সাতটা চল্লিশ মিনিটে বিমান আক্রমণের জন্য তৈরি হয়ে যায় ইসরায়েল।
দিন শেষে জর্ডান এবং সিরিয়ার প্রায় অধিকাংশ বিমান ঘাটি ধ্বংস করে দেয় ইসরায়েলের বিমান বাহিনী। পুরো আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা চলে যায় তাদের নিয়ন্ত্রণে।ইসরায়েল অবশ্য জর্ডানকে সতর্ক করে দিয়েছিল যাতে তারা যুদ্ধে না জড়ায়। কিন্তু জর্ডান সেটি গ্রাহ্য করেনি।
মিশরের সেনা কর্মকর্তারা বুঝতে পারছিলেন তারা প্রথম দিনেই যুদ্ধ অনেকটাই হেরে গেছে। কায়রোর সেনা সদরে তখন আতঙ্ক ভর করেছে।পাঁচদিনের যুদ্ধে মিশর, সিরিয়া এবং জর্ডানের সেনাবাহিনী ইসরায়েলের কাছে পরাস্ত হয়। ইসরায়েল গাজা উপত্যকা, মিশরের সাইনাই মরুভূমি, সিরিয়ার গোলান মালভূমি এবং জর্ডানের কাছ থেকে পশ্চিম তীর এবং পূর্ব জেরুজালেম দখল করে।এ প্রথমবারের মতো ইহুদিদের জন্য পবিত্র জেরুজালেম ইসরায়েলের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আসে। সেখান থেকে বহু ফিলিস্তিনীকে বিতাড়িত করা হয়।সে ঘটনার প্রেক্ষাপটে মিশরের ক্ষমতা থেকে পদত্যাগ করেন গামাল আব্দুল নাসের। কিন্তু তার সমর্থনে বহু মানুষ রাস্তায় নেমে আসে।ফলে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন মি: নাসের। ১৯৭০ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ক্ষমতায় ছিলেন।জর্ডানের বাদশাহ হুসেইন ক্ষমতায় টিকে ছিলেন এবং ইসরায়েলের সাথে গোপন আঁতাত চালিয়ে যান। শেষ পর্যন্ত ১৯৯৪ সালে জর্ডান ইসরায়েলের সাথে শান্তি চুক্তি করে।
অন্যদিকে সিরিয়ায় ক্ষমতা দখল করেন হাফিজ আল আসাদ, যিনি বিমান বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন।১৯৬৭ সালের পর থেকে ইসরায়েলকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখা শুরু করে আমেরিকা।ইসরায়েলের সেনাবাহিনীর প্রতি মার্কিন প্রশাসন মুগ্ধ হয়। কারণ তারা তিনি বড় আরব বাহিনীকে পরাজিত করেছে।সে যুদ্ধের পর আরবদের কাছে ইসরায়েলের পরিচিত গড়ে উঠে ‘দখলদার’ হিসেবে। নতুন ইহুদি বসতি নির্মাণ শুরু করে ইসরায়েলে।দশকের পর দশক চলতে থাকে সংঘাত এবং উভয় পক্ষের মধ্যে তিক্ততা বেড়েছে বহুগুণে।উভয় পক্ষের জন্য পবিত্র স্থান জেরুজালেম নিয়ে অস্থিরতা বেড়েছে।এ সংকট সমাধানের জন্য ৫০ বছর আগের সে যুদ্ধকে উপেক্ষা করা যাবে না। শান্তি স্থাপনের জন্য বহু চেষ্টা, আলোচনা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেটি এখনো সুদূর পরাহত।
বি/বি/সি/এন