নীলফামারী থেকেঃ সৈয়দপুরে বসবাসরত মাড়োয়ারি সম্প্রদায়ের মধ্যে নতুন পরিবার গঠনে চরম সঙ্কট বিরাজ করছে। সৈয়দপুর ছাড়া দেশের অন্যান্য এলাকায় বাস করা মাড়োয়ারি সম্প্রদায়ের মধ্যে কন্যাসন্তানের স্বল্পতা বিরাজ করছে। এ কারণে মাড়োয়ারি তরুণদের অনেকে কনের অভাবে অবিবাহিত থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। ওই সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য একান্তবর্তী পরিবারগুলোর বন্ধন দুর্বল হয়ে পড়ছে। দিনে দিনে দীর্ঘ দিনের পারিবারিক গণ্ডি হারিয়ে যেতে বসেছে তাদের। এতে চরম হতাশা বিরাজ করছে তরুণদের মধ্যে। এর প্রভাব পরিবারের অন্যদের ওপরও পড়ছে। সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে বিরাজ করছে শূন্যতা। এক সময় যেসব সামাজিক অনুষ্ঠানাদি উৎসবমুখর হয়ে উঠতো সেসব এখন নিষ্প্রাণ। বয়স হওয়ার পরেও পরিবার প্রধান হতে না পেরে লোকলজ্জায় নিজেকে আড়াল করে রাখার প্রবণতা বাড়ছে অনেক তরুণের মধ্যে।
এ কারণে অনেকে দেশ ছাড়ছেন। ধনাঢ্য পরিবার বিয়ের সম্বন্ধ গড়ছেন প্রতিবেশী দেশে। অনেক মাড়োয়ারি পরিবার ভারতে গড়ে তুলছেন তাদের সেকেন্ড হোম। সামর্থ্যবানেরা ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার নানা দেশে মেয়েদের পাত্রস্থ করাচ্ছেন। এতে দেশের মাড়োয়ারিরা কনে সঙ্কটে পড়েছেন। এসব তথ্য দিলেন সৈয়দপুরের এক মাড়োয়ারি।
তার মতে, মূলত সংখ্যা স্বল্পতায় এ দেশে মাড়োয়ারি সম্প্রদায় এককভাবে তাদের অস্তিত্ব জানান দিতে পারছে না। ধর্মীয় সংস্কার পারিবারিকভাবেই রয়ে গেছে। সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতেও এর প্রভাব রয়েছে এখনো। কিন্তু ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদিতে সনাতন হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রভাব দিনদিন বাড়ছে। এভাবে চলতে থাকলে এক সময় দেশের মাড়োয়ারি সম্প্রদায় তাদের নিজস্বতা পুরোটাই হারাবে বলে তার অভিমত।
বণিক প্রধান মাড়োয়ারি সম্প্রদায়ের উৎস উত্তর-পশ্চিম ভারতে। ভারতের রাজস্থান, গুজরাট, হরিয়ানা এবং পাকিস্তানের পূর্বাংশে মাড়োয়ারি ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর বাস। এ মাড়োয়ারি ভাষা দেবনাগরী লিপিতে লেখা হয়। ঐতিহ্যগতভাবে মাড়োয়ারি ভাষা মহাজনী লিপিতে লেখা হতো। পাকিস্তানে দুই ধরনের মাড়োয়ারি ভাষা দেখতে পাওয়া যায়। সেখানে মাড়োয়ারি ভাষা পরিমার্জিত আরবি লিপিতে লেখা হয়। পাকিস্তানি মাড়োয়ারি ভাষা এবং ভারতীয় মাড়োয়ারি ভাষার বৈসাদৃশ্য এত বেশি যে অনেকেই আলাদা ভাষা হিসেবে মন্তব্য করেন। মাড়োয়ারি ভাষার ২০টি উপভাষা আছে। প্রচলিত একটি রাজস্থানী ভাষা।
সৈয়দপুরের মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীদের বয়স্করা সাধারণত ভারতের। তাদের পূর্বপুরুষেরা বিয়ে করেছিলেন ভারতে যেসব মাড়োয়ারি সম্প্রদায় মূলত একান্নবর্তী পরিবার হিসেবে রয়ে গেছে। তবে অনেক পরিবারে বিয়েযোগ্য পুরুষ সময়মতো বিয়ে করতে না পারায় তারা চরম সামাজিক ও পারিবারিক সঙ্কটে ভুগছেন। তাদের চলাফেরা গণ্ডিবদ্ধ। সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে অনেককে এখন দাওয়াতও করা হয় না। এ জন্য অনেকে নিজেকে ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদিতে জড়িয়ে এক প্রকার একাকি জীবনযাপন করছেন।
দেশ বিভাগের আগে রাজস্থানে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে জন্মভূমি ছেড়ে সৈয়দপুরে ভাগ্যোন্নয়নে আসেন পাঁচ মাড়োয়ারি পরিবার। এসব মাড়োয়ারি এখন বাংলায় কথা বলেন। যখন নিজেদের ভাষায় কথা বলেন সচরাচর সেখানে ভিন্নভাষী কেউ একান্নবর্তী পরিবারে খাপখাইয়ে নিতে পারেন না। নিরাপত্তাজনিত কারণেও সৈয়দপুরের ধনাঢ্য মাড়োয়ারিরা একাকিত্ব থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সৈয়দপুরসহ দেশে বর্তমানে সবমিলিয়ে মাড়োয়ারি সম্প্রদায়ের হাজার-১২ শ’ পরিবার টিকে আছে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি জয়পুরহাটে ১১৭টি পরিবার রয়েছে। সূত্র জানায়, দেশের উত্তরাঞ্চলে রয়েছে সবচেয়ে বেশি মাড়োয়ারি পরিবার। কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, আলমডাঙ্গা, ভেড়ামারা, ঈশ্বরদী, সৈয়দপুর ও নাটোরে তুলনামূলক বেশি পরিবার রয়েছে।
দেশের মাড়োয়ারি সম্প্রদায় ধনাঢ্য ব্যবসায়ী সম্প্রদায় হিসেবে পরিচিত। তবে কালের বিবর্তনে বর্তমানে অনেক মাড়োয়ারি সম্প্রদায়ের আর আগের সেই অবস্থানে নেই। অনেকে ব্যবসা-বাণিজ্য ধরে রাখতে না পেরে আর্থিক দৈন্যতায় রয়েছেন। যারা তুলনামূলকভাবে সম্পদশালী তারা ছেলেমেয়েদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলছেন। এক সময়ের ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের এসব সদস্য এখন চাকরি করছেন।
হিন্দু ধর্মের সাথে নানা সাজুয্য থাকলেও মাড়োয়ারিরা মূলত হিন্দু ধর্ম থেকে স্বতন্ত্র এক সম্প্রদায়। পূজাপার্বণ ও সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে রয়েছে ভিন্নতা। সবচেয়ে ভিন্নতা সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে। মাড়োয়ারি সম্প্রদায়ের কেউ অন্য কোনো সম্প্রদায়ের কাউকে বিয়ে করলে তাকে সামাজিকভাবে মেনে নেয়া হয় না। এ কারণে একজন মাড়োয়ারি কোনো হিন্দুকেও বিয়ে করতে পারেন না। এ কারণে কনে সঙ্কট দিন দিন আরো প্রকট হচ্ছে।
মাড়োয়ারি সম্প্রদায়ের একাধিক ব্যক্তির সাথে আলাপকালে তারা জানান, বর্তমানে দেশে মাড়োয়ারি সম্প্রদায়ের মধ্যে মেয়েদের সংখ্যা আনুপাতিকভাবে কমে গেছে। পরিবারে পুরুষ সদস্য অনেক, কিন্তু মেয়ে নেই। অনেক পরিবারে মেয়ে রয়েছে। কিন্তু তাদের আর্থিক অবস্থা ভালো নয় বিধায় সামাজিকভাবে তাদের সাথে ধনাঢ্যরা সম্পর্ক করছেন না।
নাম প্রকাশে অনচ্ছিুক এক মাড়োয়ারি যুবক বলেন, তার বয়স বর্তমানে চল্লিশের কোঠায়। অভিভাবকদের বারবার বলা সত্ত্বেও তারা বিয়ের জন্য মেয়ে খুঁজে পাননি। এখন তিনি নিজেকে অনেক কিছু থেকেই গুটিয়ে নিয়েছেন।
ওই যুবকের মতে, বর্তমানে ইন্টারনেটের যুগে ২০ বছরের বেশি মেয়ে বাড়িতে রাখতে নিরাপদ বোধ করেন না অভিভাবকেরা। তাই মেয়ের বয়স ২০ আর ছেলের বয়স ৩০ পেরোনোর আগেই বিয়ে দিয়ে দেন। এতে এক দিকে কম বয়সে বিয়ের প্রবণতা বাড়ছে। অন্য দিকে যাদের বয়স হয়ে গেছে তারা বিয়ের পাত্রী পাচ্ছেন না। মেয়ের সংখ্যা কম হওয়ায় অনেকের ভাগ্যেই সংসার গড়া হয়ে ওঠে না।