ডেস্ক রিপোর্টঃ পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ি। ইচ্ছে লেখাপড়া শিখে বড় হব। কিন্তু অভিভাবকরা ভাবছেন আমার বিয়ে দেওয়ার কথা। বিয়ের সম্বন্ধ আসতে শুরু করল একাধিক। বই এবং বিভিন্ন কাগজে পড়ে বাল্যবিয়ের কুফল কিছুটা জেনেছি। কিন্তু অভিভাকদের সেটা বোঝানোর মতো সামর্থ হয়নি। এজন্য লেখাপড়ার চিন্তার চেয়ে বেশী দুঃশ্চিন্তা ছিল আমার বিয়ে নিয়ে। হঠাৎ একদিন পাত্র পক্ষের পছন্দে বিয়ের দিন তারিখও ঠিক করে ফেললো অভিভাবকরা। ভাবতে শুরু করলাম এ বিয়ে ঠেকানোর মতো শক্তি পাবো কোথায় ? আমার সে ভাবনার সাথী হলো সহপাঠিরা। তারা এগিয়ে এলো আমার সে বাল্যবিয়ে বন্ধে। সহপাঠিদের চেষ্টা এবং আমার প্রবল ইচ্ছায় বাবা মাকে বুঝিয়ে রেহাই পেলাম সেই বাল্যবিয়ে থেকে। এখন আমি উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে আরো উচ্চ শিক্ষা অর্জনের চেষ্টা করছি। পাশাপাশি কাজ করছি এলাকায় বাল্যবিয়ে রোধে।
শিক্ষা জীবনের পাশাপাশি নিজ এলাকায় ৫৫টি বাল্যবিয়ে থামিয়ে দিয়েছেন নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার আরাজি শিমুলবাড়ি গ্রামের শিরিন আক্তার। তার প্রচেষ্টায় রক্ষা পাওয়া এসব মেয়ে নিজের ভাগ্য গড়ার স্বপ্নে চালিয়ে যাচ্ছে লেখাপড়া। পাশাপাশি তারা শিরিনের সাথে যোগ দিয়েছে এলাকার বাল্যবিয়ে রোধে। সকলে কাজ করছে লেখাপড়া থেকে ঝড়ে পড়া শিশুদের বিদ্যালয়ে পাঠানো ও শিশু অধিকার রক্ষায় জনসচেতনতা সৃষ্টিতে। এলাকায় তাদের নামডাক ছড়িয়ে পড়েছে শিশু অধিকার রক্ষা কর্মী হিসেবে। আর এসব কাজে নেতৃত্ব দেন শিরিন আক্তার। সে ওই গ্রামের ক্ষুদ্র কৃষক মনিরুল ইসলাম ও বুলবুলি বেগম দম্পতির মেয়ে। চার বোন তিন ভাইয়ের মধ্যে দ্বিতীয়।
শিরিন জানায়, নিজেকে রক্ষার পর ২০০৯ সাল থেকে নিজ এলাকায় বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ, ঝরে পড়া শিশুদের স্কুলমুখী করা, জন্ম নিবন্ধনসহ শিশু অধিকারের বিভিন্ন কর্মকা- জড়িয়ে পড়েছে সে। এরপর নির্বাচিত হয় এলাকার শিশুদের নিয়ে গঠিত সংগঠন ‘শিশু ফোরামের’ সভাপতি। একাজে তাকে সহযোগিতা করছে প্লান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ ও উদয়াঙ্কুর নামে বেসরকারী সংস্থা। সে বর্তমানে উপজেলা শিশু কল্যাণ বোর্ডেরও সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
এমন কাজের স্বীকৃতিতে ২০১৪ সালে স্পেনে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক গার্লস টেকওভার কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করে সে। স্পেনের রাজধানী মদ্রিদে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী, পার্লামেন্ট মেম্বার ও সুশীল সমাজের অংশগ্রহণে র‌্যালি, আলোচনা সভা, বিতর্কসহ নানা আয়োজনে অংশগ্রহণ করে। এসব অনুষ্ঠানে শিরিন তার এলাকার শিশু অধিকার পরিস্থিতি, জন্মনিবন্ধন ও বাল্যবিয়ে বন্ধে তার শিশু দলের ভূমিকা তুলে ধরেন। ২০১৪ সালের ৬ থেকে ১২ অক্টোবর পর্যন্ত এ সব কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়। প্লান ইন্টারন্যাশনাল স্পেনের আমন্ত্রণে শিরিন এসব কর্মসূচিতে অংশ নেয়। সব শেষে গত ৩ অক্টোবর শিরিন দিনব্যাপী উদয়াঙ্কুর সেবা সংস্থার নির্বাহী পরিচালকের প্রতিকী দায়িত্ব পালন করেন।
শিরিন বলেন, ‘লেখাপড়ার পাশাপাশি এসব কাজ করতে পেরে আমি আনন্দিত। কাজের মধ্য দিয়ে নিজেকে গড়ে তোলার সুযোগ পাচ্ছি।’
এলাকায় বাল্যবিয়ে বন্ধের কৌশলে শিরিন বলেন, ‘বাল্যবিয়ের খবরে আমরা ছুটে যাই সেখানে। এরপর কুফল সম্পর্কে অভিভাবককে ধারণা প্রদানের পর তারা অনেকেই উদ্যোগী হয়ে বিয়ে বন্ধ করেন। এমন বিয়ে বন্ধে জনপ্রতিনিধি ও সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ ও প্রশাসনের সহযোগিতা পাচ্ছি।’
বাল্য বিয়ের হাত থেকে পাওয়া দিপ্তী রানী রায় (১৬) বলেন, শিরিন আপুর সহযোগিতায় আমি বাল্যবিয়ে থেকে রক্ষা পেয়েছি। এখন একাদশ শ্রেণীতে শিমুল বাড়ি বঙ্গবন্ধু ডিগ্রি কলেজে পড়াশুনা করছি। আমি লেখাপড়া করে প্রতিষ্ঠিত হতে চাই এবং নারী ও শিশুদের উন্নয়নে আমিও শিরিন আপুর মতো সমাজে অবদান রাখতে চাই ।
২ বছর পূর্বে লেখাপড়া বাদ দিয়ে কৃষি কাজের সাথে যুক্ত হয়েছিল শিশু সুমন মিয়া (১৫) শিরিনের সহযোগিতায় সে পুনরায় ভর্তি হয়েছে নবম শ্রেণীতে। সুমন বলেন, ‘শিরিন আপুর সহযোগিতায় নতুন করে স্কুল জীবন ফিরে পেয়েছি ।’
প্লান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ রংপুর বিভাগের ব্যবস্থাপক মো. আব্দুল কুদ্দুছ জানান, ২০১৬ সাল থেকে প্লান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ গালর্স টেকওভার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। কর্মসূচির মাধ্যমে একজন কিশোরীর নেতৃত্ব বিকাশে সহায়তা করা হচ্ছে। যাতে তার মধ্যে বড় হওয়ার, ভাল কিছুকরার স্বপ্ন তৈরি হয়, আত্মবিশ্বাস বাড়ে। এ কর্মসুচির আওতায় রংপুর বিভাগের দিনাজপুর, নীলফামারী, লালমনিরহাট ও রংপুর জেলায় বিভিন্ন সরকারী বেসরকারী কর্মকর্তা, বিভিন্ন উপজেলার ইউএনও, ইউপি চেয়ারম্যান ও বেসরকারী সংস্থার প্রধানের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা হচ্ছে শিরিনের মতো আরো ১৩ জনকে।
উদায়াঙ্কুর সেবা সংস্থার নির্বাহী পরিচালক আলাউদ্দিন আলী বলেন, ‘শিরিন শিশু অধিকার রক্ষায় সফল ভূমিকা পালন করছে। এসব কাজের মধ্য দিয়ে তার বড় হওয়ার আত্মবিশ্বাস বেড়েছে। এলাকায় শিশু অধিকার রক্ষায় কাজ করছে শিরিনের মতো আমরা অনেককে সহযোগিতা প্রদান করছি।’

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে