হাসপাতালের ওয়েটিং রুমে বসে আছি। ওয়েটিং রুম টা ওয়েট করার জন্য খুবই উপযোগী। এই রকম ওয়েটিং রুমে কারন ছাড়ায় ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকা যাবে। কারন ওয়েটিং রুমের পাশেই রিসিপশন আর ঐ খানে বসে আছে নীল নয়না। নীল নয়না বলার অন্যতম কারন হচ্ছে সে নীলে পরিপূর্ন। মেয়েদের মনে হয় নীল শাড়ীতে একটু বেশিই সুন্দর লাগে।
ওয়েটিং রুমে অনেকগুলো চেয়ার। তবে বেশির ভাগ চেয়ার খালি।শহরের বখাটে ছেলেরা মনে হয় এখনও নীল নয়না কে দেখে নি,দেখলে আমি সিউর ২৪ টা ঘন্টার মধ্যে ১ সেকেন্ড্ও খালি থাকত না। বখাটে ছেলেরা আর কিছু না পারুক তারা খুব আগ্রহ নিয়ে সুন্দরী মেয়েদের দিকে ঘন্টার পর ঘন্টা তাকিয়ে থাকতে পারে। এই তাকানোতে কোন ভালোবাসা থাকে না,কোন মায়া থাকে না, শুধু লোভ থাকে।
মেয়েটি অস্বাভাবিক সুন্দর, উহু সুন্দরী। কুয়াশার স্নিগ্ধতাও লজ্জা পাবে মেয়েটির কাছে। মেয়েটি একনাগারে কি-বোর্ডে আঙ্গুল চালাচ্ছে আর মাঝে মধ্যে উকি দিয়ে ওয়েটিং রুমে কে কে আছে তা দেখছে। মেয়েটি মনে হয় কারও অপেক্ষায় আছে!
মেয়েটি এবার সরার্সরি আমার দিকে তাকালো,আমি চোখ টিপ দিলাম। মেয়েটি মুচকি হাসি দিলো। আমি অবাক হয়ে গেলাম। সুন্দরী মেয়েরা গিফট পেলে হাসে চোখ টিপ পেলে হাসে না।
মেয়েটি ভিতরে কোথাও গেল।
আমি আগ্রহ নিয়ে লিফটের উঠা নামা দেখছি। লিফটের ভিতর ডুকলে নিজেকে দামী দামী মনে হয়,উপর তলার মানুষ মনে হয় নিজেকে। আমি মাঝে মধ্যে সুযোগ পেলেই লিফটে উঠে পরি। তারপর একনাগারে কয়েকবার উঠি নামি। আজ লিফটে উঠতে ইচ্ছে হচ্ছে না। আজ বরং লিফটের উঠা নামা দেখতেই ভালো লাগছে।
লিফট থেকে একজন মধ্যবয়স্ক মানুষ নেমে এসে আমার পাশে বসলেন। উনি রোগীর সাথের কেউ। সম্ভবত উনার স্ত্রী রোগী! উনার হাতে একটা ফাইল আর ফাইলে জবেদা বেগম, স্বামী- আজমত আলী লিখা।
ধরে নেয়া যাক উনিই আজমত আলী। আজমত আলী চোখ বন্ধ করে চেয়ারে হেলান দিয়ে মুরগির মত ঝিমাচ্ছেন। বিষন্ন মুখগুলোর দিকে আমার তাকাতে ভালো লাগে না। আমি আজমত আলীর দিকে তাকাচ্ছি না। আজমত আলী সাহেব ঝিমাতে থাকুক..
আজমত আলী বয়স্ক মানুষ। উনাকে চাচা বলে ডাকা যেতেই পারে।
-বাজান,কয়টা বাজে?
-৮ টা ৫১ বাজে আজমত চাচা।
-আপনি আমার নাম জানলেন কিভাবে?
আমি উত্তরে রহস্যময় হাসি টা দিলাম,উনি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।
আজমত চাচা কে বল্লা,-চাচীর অবস্থা কি খুব বেশি খারাপ চাচা?
আজমত চাচা আরও অবাক হয়ে গেলেন। অবাকের উপর অবাক।
উনি সম্ভবত ভয় পেতে শুরু করেছেন। অন্য কেউ হলে ভয় টা বাড়িয়ে দেয়া যেত কিন্তু আজমত চাচার ভয় টা বাড়াতে ইচ্ছা করছে না।
আমি হাসি মুখে বললাম চাচা অবাক হবেন না ,আমি আপনার অপরিচিত আর আপনার নামটা আপনার ফাইলে লিখা আছে তা দেখেই বলেছি।
আজমত চাচার সাথে কথা বলে জানা গেল উনার বৌ কে বাঁচাতে হলে আজ রাত ২ টার আগেই ৩ ব্যাগ বি নেগেটিব রক্ত লাগবে। উনার শহরে পরিচিত কেউ নাই,পর্যাপ্ত পরিমান টাকাও নাই যে উনি রক্ত কিনবেন। উনি বাড়ীও যেতে পারছেন না। উনার স্ত্রীর সাথে উনি একা এসেছেন। বাড়ীতে ফোন ও করা যাচ্ছে না কারন উনার ছেলে উনাকে একটা নাম্বার কাগজে লিখে দিয়েছিলেন উনি সেই কাগজটাও হারিয়ে ফেলেছেন।
কেউ একজন সম্ভবত আজমত চাচার মত পরিস্থিতিতে পরেই বলেছিলেন ‘বিপদ যখন আসে তখন চার পাশ দিয়েই আসে’
নীল নয়না আবার এসে রিসিপশনে বসেছে। মুখটা হাসি হাসি। রুপবতী মেয়েদের হাসি মুখ দেখলেও ভাল লাগে। মেয়েটার হাসির রহস্য টা জানা দরকার তবে এখন আমার তা জানতে ইচ্ছা করছে না।
তমাল কে ফোন দিয়ে বলেছিলাম রক্ত ব্যাবস্থা করতে পারবে কিনা?
ও বলেছে পারবে।
আমি ওকে হাসপাতালের ঠিকানা টা মেসেজ করে পাঠিয়ে দিলাম।
আমি ডেস্কের সামনে দাঁড়িয়ে আছি ।
-এক্সকিউজ মি,আমি কি রিপোর্ট টা আজ পাবো?
-সরি এখনও আসে নি,আপনি বরং কাল আসুন!
আমার বলতে ইচ্ছা হয়েছিল ,তাহলে আমাকে ১৩ টা টাকা দেন, একটা চা আর সাথে একটা সিগেরেট খেয়ে বাসায় চলে যাই। কিন্তু বলতে পারি নাই!আমি ‘আচ্ছা’ বলে চলে এলাম।
কুয়াশায় ল্যামপোস্টের হলুদ আলো রহস্য তৈরী করেছে। আমি রহস্যের ভিতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। ল্যামপোস্টের খাম্বার মধ্যে জমে উঠা বিন্দু বিন্দু শিশির কনার টপ করে মাটিতে পরে যাওয়ার শব্দটা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি..
—মিঠুন মাহাবুব
ময়মনসিংহ