ডেস্ক স্পোর্টসঃ পুরো ঢাকা শহরের নজরদারিতে এবার বসছে ২১ হাজার ২০০ ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা (সিসিটিভি)। এর মধ্যে ৫২০০ ক্যামেরা স্থাপন করবে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। যদিও এই ৫২০০ ক্যামেরার বাস্তবায়ন নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের মধ্যে চিঠি চালাচালি চলছে। ডিএনসিসি কর্তৃপক্ষও তাদের মতামত জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সরকারি এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগে স্থাপিত ৫২৪২টি সিসিটিভি ক্যামেরার সঙ্গে আরও ২১ হাজার ক্যামেরা বসানো হলে পুরো ঢাকার অলিগলি নজরদারির মধ্যে চলে আসবে। গোপনে ধারণকৃত এসব ফুটেজ সংরক্ষিত থাকবে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষে। নির্দিষ্ট মেয়াদের পর পূর্বের ফুটেজগুলো মুছে দেওয়া হলেও গুরুত্বপূর্ণ ফুটেজগুলো সংরক্ষিত থাকবে বিশেষ আর্কাইভে। চাইলেই আর অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকছে না।

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকাবাসীকে নিরাপত্তা দিতে গত ১০ বছরে পুলিশের নেওয়া তিন প্রকল্পের ১০০  কোটি টাকা পানিতে গেছে। ৬১ কোটি টাকার প্রকল্পের ১৫৫টি ক্যামেরা এখনো বুঝে নেয়নি পুলিশ। এসব নিয়ে কম জল ঘোলা হয়নি।

অতীতের নেতিবাচক অভিজ্ঞতাগুলো সামনে রেখে ভবিষ্যৎ প্রকল্পগুলোর নকশা করা উচিত। প্রয়োজনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সফলভাবে বাস্তবায়ন করা হয়েছে এমন প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো উচিত বলে মনে করেন তারা।

নগর-পরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলী মোবাশ্বের হোসেন বলেন, জীবনযাত্রা সহজীকরণ তথা আধুনিকায়নের জন্য উন্নত প্রযুক্তি প্রয়োজন। তবে যে কোনো প্রযুক্তি সংযোজনের আগে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে এর পেছনের মানুষগুলো ঠিক আছে কি না। তিনি আরও বলেন, ঢাকার ট্রাফিক সিগন্যাল ব্যবস্থা পৃথিবীর অন্যতম আধুনিক ব্যবস্থা। কিন্তু পুরো নগর অব্যবস্থাপনার কারণে এটি কাজই করছে না। সিসি ক্যামেরা দিয়ে গোটা রাজধানী ঢেকে দিলেও কোনো কাজ হবে না। যদি এর পেছনের লোকেরা সৎ এবং দক্ষ না হন।

উল্টো এ দিয়ে ক্ষতিই বেশি হবে। ২০১৩ সালের জুলাই মাসে রাজধানীর গুলশান শপার্স ওয়ার্ল্ডের সামনে যুবলীগ নেতা রিয়াজুল হক, ২০১৫ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর গুলশানে ইতালির নাগরিক তাভেলা সিজার, ২০১৬ সালের ২৫ এপ্রিল কলাবাগানে ইউএসএআইডির কর্মকর্তা জুলহাজ মান্নান ও তার বন্ধু মাহবুব রাব্বী তনয় হত্যাকাণ্ড ছাড়াও অনেকে হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ। সর্বশেষ গত ৫ ডিসেম্বর রাজধানীর বনানীতে মুন্সী সিদ্দিকুর রহমানের খুনিদের ছবিও মিলেছে সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজে।

এরই মধ্যে দুই খুনি নিহত হয়েছে গোয়েন্দা পুলিশের সঙ্গে বন্দুক যুদ্ধে। ডিএমপির দেওয়া তথ্য বলছে, গত দুই বছরে রাজধানীর ৫০টি থানায় ৬১৬টি, পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট ও এর আশপাশে ৬৯২টি সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো হয়েছে। গুলশান, বারিধারা ও নিকেতন সোসাইটির সহযোগিতায় ওইসব এলাকার পথে পথে বসানো হয়েছে ৮৫০টি সিসিটিভি ক্যামেরা। এ ছাড়া, বিভিন্ন বাসাবাড়িতে নিজস্ব উদ্যোগে আরও অসংখ্য সিসিটিভি ক্যামেরা রয়েছে। লালবাগ ও কোতোয়ালিসহ পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় প্রায় এক হাজার ৭০০ সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো হয়েছে।

পুলিশের একক উদ্যোগে রাজধানীর প্রবেশমুখগুলো ছাড়াও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে তিন হাজারের বেশি সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো হয়েছে। গুলশান, বনানী, বারিধারা ও নিকেতন সোসাইটির ক্যামেরাগুলোর নিয়ন্ত্রণ কক্ষ গুলশান জোনের সহকারী কমিশনারের (এসি) কার্যালয়ে। এই নিয়ন্ত্রণ কক্ষের সঙ্গে আবদুল গনি রোডের ডিএমপির কন্ট্রোল রুমের সংযোগ রয়েছে। এ ব্যাপারে গুলশান জোনের এসি রফিকুল ইসলাম বলেন, সিসিটিভি ক্যামেরাগুলো ‘এলওসিসি’ ট্রাস্টের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে।

এর কন্ট্রোল রুমে তিনজন পুলিশ কর্মকর্তা ও দুজন প্রকৌশলী সার্বক্ষণিকভাবে কাজ করছেন। আমাদের টার্গেট হলো ১২০০ ক্যামেরা স্থাপন। এরই মধ্যে প্রায় এক হাজার ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। এলজিইডি মন্ত্রণালয় ও ডিএনসিসি সূত্র বলছে, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ৫২০০টি সিসিটিভি ক্যামেরা, ৩৯ হাজার এলইডি লাইট, কানেকটিভি এবং কন্ট্রোল রুমের জন্য ৪৪২ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন করেছে একনেক। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করার বিষয়টি উল্লেখ করে এ সংক্রান্ত জিও (গভর্নমেন্ট অর্ডার) সম্পন্ন হয়েছে চলতি বছরের মার্চ মাসে।

এরই মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ। শিগগিরই এই প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ার কথা। তবে গত অক্টোবর মাসে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এলজিইডি মন্ত্রণালয়কে চিঠির মাধ্যমে অবহিত করা হয় পুলিশও সিসিটিভি স্থাপনে একটি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। একইসঙ্গে ডিএনসিসির আলাদাভাবে সিসিটিভি স্থাপনের বিষয়টি নতুন করে ভেবে দেখে মতামত চাওয়া হয়। পরে এলজিইডি মন্ত্রণালয় থেকে ডিএনসিসিকে এ বিষয়টি অবহিত করে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তাদের মতামত চায়।

গত নভেম্বর মাসেই এলজিইডি মন্ত্রণালয়কে নিজেদের সক্ষমতার বিষয়টি উল্লেখ করে মতামত দেয় ডিএনসিসি। ডিএনসিসির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (বিদ্যুৎ) লে. কর্নেল মো. আজাদুর রহমান বলেন, আমাদের প্রয়াত মেয়রের ব্যক্তিগত উদ্যোগেই গুলশান, বারিধারা এবং নিকেতন সোসাইটির মাধ্যমে ১২০০ সিসিটিভি ক্যামেরা বসানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। ডিএনসিসির বাকি এলাকাগুলো সিসি ক্যামেরার আওতায় আনার জন্য ওনার উদ্যোগেই ৪৪২ কোটি টাকার ওই প্রকল্প প্রস্তাব পাঠানো হয়েছিল। পরে তা একনেকে পাস হয়।

সূত্র বলছে, ডিএমপি কন্ট্রোল রুমের আধুনিকায়নের জন্য ১৯৯৮ সালে ৬১ কোটিরও বেশি টাকা ব্যয়ে কন্ট্রোল রুমের জন্য নতুন ভবন নির্মাণ, ট্রাফিক পুলিশের জন্য মেসেজ ডিসপ্লে বোর্ড ও সিসি ক্যামেরা স্থাপনের কাজ শুরু হয়। ২০০৭ সালে রাজধানীর ৫৯টি পয়েন্টকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে সিসিটিভি বসানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ২০১০ সালে প্রকল্পটির কাজ শেষ হলেও তা বুঝে নেয়নি পুলিশ। বর্তমানে ১৫৫টি ক্যামেরার অধিকাংশই অকেজো। বিষয়টি নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়েছে। তবে সম্প্রতি সিসিটিভি বিষয়ে পুলিশ সদর দফতর প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার একটি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রাথমিক কাজ শেষ করেছে। পুলিশ সদর দফতরের টেলিকম অ্যান্ড ইনফরমেশন ম্যানেজমেন্টের প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি (চলতি দায়িত্ব) বিনয় কৃষ্ণ বালা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ১৫৫টি ক্যামেরার তথ্য ডিএমপির কাছ থেকে নিতে হবে।

তবে রাজধানীকে নিবিড় পর্যবেক্ষণের আওতায় নিয়ে আসতে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে। এর বাস্তবায়ন হলে নগরীর নিরাপত্তায় অনেক কাজে আসবে। ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান বলেন, অপরাধ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সিসিটিভি ক্যামেরা খুব প্রয়োজন। ৫ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে রাজধানীর কোনো অলিগলিও বাদ থাকবে না। রাস্তায় কোনো মানুষজন নেই, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো সদস্যও নেই, কিন্তু সিসিটিভি ক্যামেরা আছে। তার মানে সেখানে আপনার অগোচরে আপনাকে অনুসরণ করা হচ্ছে। আপনার সব ধরনের কার্যক্রম সেখানে রেকর্ড হচ্ছে। সেখানে কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে অপরাধীকে শনাক্ত করা সহজ হবে।

 

 

B/D/P/N.

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে