……………………মাহফুজার রহমান মণ্ডল
যুগযুগ ধরে প্রাকৃতিক দুর্যোগ গতি বদলাচ্ছে। কখন যে কি দুর্যোগ হবে এক মাত্র বিধাতাই জানেন। ঠিক সেই রকম দুর্যোগ এই করোনা। এ কাউকে রেহাই দিচ্ছে না বড়-ছোট, ধনী-গরীব, দেশি-বিদেশী, রাজা-বাদশা, জাত-পাত ইত্যাদি। মুলত এটা একটা সংক্রামক ব্যাধি। নেই কোন নিরাময় ঔষধ, নেই কোন প্রতিশোধক তবে এখন টিকা বের হয়েছে কিন্তু ১০০% কার্যকারী নয়। কিছুটা কার্যকর হলেও ভেরিয়েন্ট হচ্ছে। এর একমাত্র কার্যকারী ঔষধ সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা আর মাস্ক পরিধান করা। বর্তমান(১৮/০৭/২১ইং)তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে সব মিলিয়ে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১১ লাখ ৩ হাজার ৯৮৯ জন এ পর্যন্ত মোট সুস্থ হয়েছেন ৯ লাখ ৩২ হাজার ৮ জন এবং মোট মৃত্যু হয়েছে ১৭ হাজার ৮৯৪ জনের।এই করোনাকালীন সময়ে বাংলাদেশের পূর্ব-দক্ষিণ অঞ্চলে অবস্থান কালীন রোহিঙ্গা শরণার্থী যারা ৩৪টি ক্যাম্পে অত্যন্ত গাদাগাদিভাবে জীবন যাপন করছে তারা কেমন আছে? ঈদই বা তাদের কেমন হবে?
মিয়ানমার সরকার ৮০ দশকে মিয়ানমারের উত্তর প্রদেশ রাখাইনে সংখ্যালঘু মুসলিম রোহিঙ্গা নাগরিকদের নাগরিকত্ব বাতিল করে নিপীড়ন চালিয়ে আসছে।বিভিন্ন অজুহাতে ২০১৬সালের ৯ই অক্টোবরের পর ২৫শে অগাস্ট’২০১৭ইং রাতে রোহিঙ্গাদের উপর ভয়াবহ নির্যাতন শুরু করে। এরপর থেকে দিনের পর দিন নির্বিচারে গণহত্যা, ধর্ষণ-লুণ্ঠন ও আগুনে পুড়িয়ে মারাসহ অনৈতিক কার্যকলাপ শুরু করে।২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসের হিসেব অনুযায়ী, ২৫ আগস্ট ২০১৭ সালে মায়ানমারের সামরিক বাহিনীর দ্বারা শুরু হওয়া গণহত্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে প্রায় ৬,৫৫,০০০ থেকে ৭,০০,০০০ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। বিগত তিন দশক ধরে মায়ানমার সরকারের সহিংস নির্যাতন থেকে ৩,০০,০০০ এর অধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসে অবস্থান করছে। এই মুহূর্তে কক্সবাজারে সব মিলিয়ে অন্তত ১১ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে। জন্মের হার যদি নিমন্ত্রণ করা না যায় দেশ ছাড়ার আগে অদূর ভবিষ্যৎ-এ এই সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হতে পারে।
করোনায় আক্রান্তের কথা বলতে গেলে গত ২০ জুন’২১ পর্যন্ত ক্যাম্পগুলোতে করোনাভাইরাসে অন্তত ২০ জন মারা গেছেন এবং ১ হাজার ৫৬৬ জন শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। দিন দিন যে এর সংখ্যা কমবে তা নয় বরং বাড়বে। যারা দায়িত্বে আছেন তাঁদের দায়িত্ব আরও বাড়াতে হবে। একটু ভুলের জন্য যেন শোকের চেয়ে রোগে না মরে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। তাঁদের দায়িত্বে আছে বাংলাদেশ সরকার ও ইউএনএইচসিআর সাথে আছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা যাঁরা প্রতিনিয়ত দেখাশোনা করছেন।খাদ্যের যেন অভাব না পরে গডাউনে চাল-ডাল মজুদ আছে। শীতে শীতবস্ত্র বিতরণ থেকে শুরু করে সাধারণ পোশাক পর্যন্ত বিতরণ করা হয়। বাসস্থানের জন্য নানানমুখী পরিকল্পনা রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো ভাসানচরে রোহিঙ্গা স্থানন্তর। স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করার জন্য এনজিওগুলোর স্বাস্থ্যকর্মী উঠেপড়ে লেগেছে। এছাড়াও শিক্ষা ব্যাবস্থার উপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। রোহিঙ্গা শিশুরা যেন সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয় তার জন্য ছোট ছোট পাঠশালা স্থাপন করা হচ্ছে।
কোন সমস্যা সমাধান করা যে কত কঠিন তা বাস্তবে না দেখলে বুঝা যায় না। ঠিক সেই রকম রোহিঙ্গা সমস্যা যা মোকাবেলা করা অনেক কঠিন। বিগত দিনগুলোতে রহিঙ্গাকের কর্মকাণ্ড দেখলে মাথা খারাপ হয়ে যায় প্রায়- আশ্রয় দেওয়া হয়েছে কিন্তু স্থির থাকতে চায় না। ভালোর মধ্যে যেমন খারাপ থাকে ঠিক সেই রকম কিছু রোহিঙ্গা ইয়াবা ব্যাবসা থেকে শুরু করে রাহাজানি, চুরি ও ছিনতাই কাজেও লিপ্ত ছিল। এমন কি সমুদ্র পারি দিয়ে মালয়েশিয়া গিয়েছে আবার সমুদ্র পথে ডুবে মারা গিয়েছে। দেশে বিভিন্ন জেলা থেকে জ্বাল পাসপোর্ট তৈরি করে সৌদিআরব পর্যন্ত গিয়েছিলো তারা।
এতো অন্যায় অত্যাচারের পরেও আমাদের দেশের সরকার তাদেরকে ভালরাখার জন্য নোয়াখালীর ভাসানচরে সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্পে এখন পর্যন্ত ১৮ হাজার ৫২১ জন রোহিঙ্গা নতুন ঠিকানায় রেখেছেন। আরও ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে উক্ত ভাসানচরে নিয়ে যাবে বলে চেষ্টা চলছে। তাদের সেখানে বসবাসের জন্য মৎস্য, পশু বা আবাদি জমিতে ফসল ফলানোর ব্যাবস্থা করা হচ্ছে। ক্ষুদ্র কুঠির শিল্প থেকে শুরু করে অনেককে উদাক্তা হওয়ার সুযোগ করানো হচ্ছে যেন নিজে স্বাবলম্বী হতে পারে। তবে এটাও শুনা গেছে যে অনেক রোহিঙ্গা ভাসানচর থেকে রোহিঙ্গা কাম্পে ফিরে এসেছে। আবার অনেকেই ভাসানচর যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
সামনে ঈদ-উল-আযহা তাই ভাসানচরে ঈদ করার জন্য দুই শতাধিক গরু প্রেরণ করা হয়েছে।এছাড়া ২৮০০ রোহিঙ্গাকে ঈদ উপহার হিসেবে ১৩ ধরনের জীবিকার সামগ্রী পাঠিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উপহারসামগ্রীর মধ্যে রয়েছে মাছ ধরার ৮০০ জাল, ১০০টি সেলাই মেশিন, ৫০টি রিকশা ভ্যান, দেশি পাঁচ হাজার হাঁস, দেশি পাঁচ হাজার মুরগি, চুল কাটার ৪৫ সেট সরঞ্জাম, জুতা সেলাইয়ের ২৮ সেট সরঞ্জাম, রিকশা ভ্যান মেরামতের ২৫ সেট সরঞ্জাম, ইলেকট্রিশিয়ানের মেশিনপত্র ৭ সেট, কাঠমিস্ত্রির যন্ত্রপাতি ৫০ সেট, মুদিদোকানের জিনিসপত্র দেওয়া হয় ১০০ জনকে, দেশি ছাগল ১০০টি ও ২০০ জনকে দেওয়া হয় মাছের পোনা। ঈদের নামাজ যেন সঠিকভাবে হয় সে ব্যবস্থা করা হয়েছে।
তাহলে বুঝা যাচ্ছে এবারে রোহিঙ্গাদের ঈদ একবারেই খারাপ যাবে না। এটা হলো ভাসানচরের রোহিঙ্গাদের কপাল কিন্তু কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের কি আবস্থা? হ্যাঁ, তারাও খারাপ থাকবে না কারণ এনজিও ও সরকারীভাবে অনেক ব্যাবস্থা গ্রহন করা হবে। সঠিকভাবে পরিবেশন করা হলে তাদের ঈদ ভালোই যাবে আশারাখি।
এখন আমদের কথা একটু না বললেই নয় যে, রোহিঙ্গারা ভালোভাবেই ঈদ করবে আর আমাদের কর্মজীবী মানুষ যারা এই করোনার আঘাতে জর্জরিত তাদের ঈদ কিভাবে যাবে তার কোন ফায়সালা নেই? হ্যাঁ, আছে। এই লকডাউন জননেত্রী প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ৩২শ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছেন। আর এই বরাদ্দ সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হলে আমাদের কিছুটা হলেও সমস্যা সমাধান হবে। আরও আমাদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে কবে এই রোহিঙ্গা আমাদের দেশ ছেড়ে চলে যাবে? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা সংকট নিরসনসহ স্থায়ী সমাধানে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭২তম অধিবেশনে পাঁচ দফা এবং ৭৪তম অধিবেশনে চার দফা প্রস্তাব রাখেন। এগুলো বাস্তবায়ন হলে রোহিঙ্গা সংকট নিরসন হবে ইনশাআল্লাহ্।
তবে ইউনাইটেড নেশনস হাই কমিশনার ফর রিফিউজিস (ইউএনএইচসিআর) এর মতে বর্তমানে প্রায় ৮ কোটি মানুষ নিজ ঘর, বাড়ি ছেড়েছে, এমনকি দেশ ছেড়েছে। এর মধ্যে রোহিঙ্গারাও পরে। মানুষে সুখ-দুঃখে মানুষ দাঁড়াবে এটাইতো কাম্য হাওয়া উচিৎ। এই ঈদ-উল-আযহায় সকলেই ত্যাগে শিক্ষা গ্রহন করুক দেশে শান্তিময় আবহাওয়া বিরাজ করুক। ঈদ হোক আনন্দের প্রতীক। সবশেষে আর একটা কথা না বললেই নয়- জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদে সোমবার(১২/০৭/২০২১ইং) রাতে এক প্রস্তাব পাস হয়েছে, যাতে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর পক্ষে জবাবদিহিতা, তাদের উপর চালানো নিপীড়নের বিচার এবং তাদের নিজ দেশে প্রত্যাবাসনের উপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এই প্রস্তাবটিকে বাংলাদেশের জন্য একটি ‘বড় মাইলফলক’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
লেখক – সাহিত্যিক, সম্পাদক ও কলামিস্ট