বিডি নীয়ালা নিউজ( ৮ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ইং)- ডেস্ক রিপোর্টঃ বাংলাদেশে আসন্ন ঈদুল আযহায় পশু জবাইর জন্য ১৮ বছরের নীচে শিশু-কিশোরদের ব্যবহার না করার যে অনুরোধ জানানো হয়েছে সেবিষয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে দেশের কওমি মাদ্রাসাগুলো।
সাধারণত: সারাদেশে কওমি মাদ্রাসাগুলোর শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ কোরবানির পশু জবাই এবং চামড়া সংগ্রহের কাজ করে থাকেন।
তাদের কেউ কেউ বলছেন, ১৮ বছরের নীচে শিশুদের তারা সরাসরি জবাইর কাজে নিয়োজিত করেন না। তবে অনেকেই বলছেন, সরকারের এই নির্দেশনা মানতে গেলে তাদের চামড়া সংগ্রহের মাধ্যমে আয়ের পরিমাণ অনেকটাই কমে যাবে।
বাংলাদেশে শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসেবে দেশে প্রায় ১৪,০০০ কওমি মাদ্রাসা রয়েছে, যার শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ। দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা এ মাদ্রাসাগুলোর আয়ের উৎস মূলত: দান-অনুদান।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বছরের দুটো সময়ে তারা বড় ধরণের আয় করেন, একটি রমজান মাসে যাকাত থেকে এবং অপরটি ঈদুল আযহায় কোরবানির পশুর চামড়া থেকে।
“আমাদের মাদ্রাসার বার্ষিক খরচের দেড় থেকে দুই মাসের খরচ আসে শুধুমাত্র কোরবানির চামড়া সংগ্রহ থেকে। আরো বড় মাদ্রাসাগুলোতে এটা আরো বেশি আসে।” বলেন ঢাকার মোহাম্মদপুরের মোহাম্মদিয়া আশরাফুল মাদারিসের শিক্ষক মোহাম্মদ শাহজালাল খান।
তিনি বলেন, যেহেতু ইসলাম ধর্মের নিয়মে ১৮ বছরের আগেই প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে বিবেচনা করা হয় সেকারণে তারা ১৮ বছরের নীচে পশু জবাই না করার অনুরোধের সাথে একমত নন।
স্নাতক পর্যায়ে অধ্যয়নরত আখতার প্রায় ১৪-১৫ বছর বয়স থেকে পশু জবাই করে আসছেন। ছোট বয়সে পশু জবাইয়ে চাপ অনুভব করেছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “খারাপ লাগলেও এটাকে আমরা খারাপভাবে নিই না, কারণ এটা আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করি। এর মাধ্যমে যেই অর্থটা আসে সেটা দিয়ে আমাদের লালন-পালন করা হয়, আমাদের কিতাবাদি কেনা হয় “।
১৮ বছর বয়সী আরেকজন শিক্ষার্থী আমজাদ হোসেন কোরবানির পশু জবাই করছেন প্রায় ১২ বছর বয়স থেকে। তিনি বলেন, জবাইয়ের ক্ষেত্রে বয়সটা তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি।
অগাস্টে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় জানায় যে, যাদের বয়স এর চেয়ে কম তাদের পশু জবাই না করার অনুরোধ জানানো হয়েছে।
মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়, নির্দেশনাটি আগে থেকেই দেয়া থাকলেও এবার ঈদে এটি কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হবে। অপ্রাপ্তবয়স্ক কাউকে কোরবানির কাজে অংশ না লাগানো হয় সে অনুরোধ করেন কর্মকর্তারা।
এর কারণ হিসেবে অপ্রাপ্তবয়স্কদের শারীরিক ও মানসিক অপরিপক্কতার বিষয়টিও তুলে ধরা হয়।
“১৮ বছরের আগে মানুষের ‘এজ অফ মেজরিটি’ আসে না”। এসময় দেখে দেখে শেখার প্রবণতা থাকে। কোরবানির সময় কিশোরেরা যে গরু জবাই করে সেটার মোটিভটা তার ধর্মীয় জ্ঞান থাকলেও পুরোপুরি বোঝে না। সুতরাং এটি তার মধ্যে ছাপ ফেলতে পারে। ১৮ বছরের নীচে শিশুরা যাতে জবাই না করে এই ব্যাপারে আমাদের সচেতন থাকা উচিত বলে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে আমি মনে করি”। বলেন মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মোহিত কামাল।
ঢাকার আরেকটি কওমি মাদ্রাসা জামিয়া মোহাম্মদিয়া আরাবিয়ার অধ্যক্ষ মৌলানা আবুল কালাম বলেন, তারা ১৮ বছরের নীচে শিশু-কিশোরদের জবাই করার কাজে ব্যবহার করেন না। তবে তারা সহযোগী হিসেবে কাজ করে।
মাদ্রাসাটির একজন শিক্ষক মোবারক হোসেনও বলছিলেন, ১৮ বছর বয়সের নীচের শিক্ষার্থীদের দিয়ে তারা সাধারণত: জবাই-র কাজটি করান না। তবে সরকার থেকে এধরণের অনুরোধ নিয়ে তাদের কেউ কেউ অসন্তুষ্ট।
“অনেকে মনে করেন যে সরকার কওমি মাদ্রাসার ওপর বাড়তি একটি চাপ প্রয়োগের জন্য এমনটা করেছে”। বলেন মি. হোসেন।
সরকারী কর্মকর্তারা বলেছেন, ১৮ বছরের নীচে শিশুরা জবাই বা মাংস কাটার কাজে নিয়োজিত হলে শারীরিকভাবেও আহত হতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে সেটিও তাদের একটি দুশ্চিন্তার বিষয়। আর মানসিকভাবেও সবাই এই কাজের জন্য প্রস্তুত থাকেন না।
স্নাতক পর্যায়ের একজন শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ সিজত বলছিলেন, ১৮ বছরের আগে তারও জবাই করার মত সাহস ছিল না। ১৮ বছর বয়স হবার পর তিনি সাহস করে পশু জবাই করা শুরু করেন।
“শত-শত গুরু জবাই হয় পরিবারের লোকেরা, স্কুল-কলেজের ছেলেরা দেখে। আনন্দ পায় যে আমাদের গুরু জবাই হচ্ছে। এটাতো কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয় না। ইসলামের কাজে কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়া নেই”। বলেন মাদ্রাসা অধ্যক্ষ আবুল কালাম।
মনস্তত্ববিদ অধ্যাপক মোহিত কামাল বলেন, ধর্মীয় অনুশাসনের দিকে শিশুদের মনোযোগী করার ক্ষেত্রে এটিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখার সুযোগ থাকলেও এবিষয়ে সতর্ক থাকা জরুরী। তিনি বলেন, খুব স্বল্পসংখ্যক হলেও প্রতিবছর অপ্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে কিছু রোগী পান যারা পশু জবাইর দৃশ্য দেখে ভয় পায়।
“পশু জবাই করার মোটিভ আল্লাহর উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা। এরকম একটি ইনটেনশন ছোটবেলা থেকে হলে ধর্মীয় অনুশাসনের দিক থেকে একটি ইতিবাচক দিক থাকবে। তারপরও কচি বয়সের শিশুদের আমরা এগুলো থেকে বিরত রাখাই ভাল বলে আমি মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে মনে করি”।
অধ্যাপক কামাল মনে করেন, কোরবানির কাজে নিয়োজিত হলে শিশু-কিশোরদের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে এমনটা নিশ্চিতভাবে বলার সুযোগ নেই। তবে অপ্রাপ্তবয়স্কদের এধরণের সরাসরি কাজ থেকে বিরত রাখাই ভালো।
কওমি মাদ্রাসাগুলোও বলছে, ধর্মীয় কারণে তারা সরকারের এই অনুরোধের সাথে পুরোপুরি একমত নন। তবে তারাও বিষয়টি গুরুত্বের সাথে নিচ্ছেন।
বিবিসি