একটি আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য ভাষণ বা বক্তৃতার কোন বিকল্প নেই। বিভিন্ন কারনে এ সব ভাষণের কোন কোনটি ইতিহাসে ঠাঁই করে নিয়েছে। এ ভাষণগুলো ছিলো আলোকবর্তিকার মত, যা-ক্রান্তিকালে মানুষকে দিয়েছে মুক্তির পথ। ৭ই মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণটির বিশ্ব স্বীকৃতির পর্যালোচনায় “মেমোরী অব দ্যা ওয়ার্ল্ড” তালিকায় স্থান দেয়া হয়েছে। এ তালিকার মাধ্যমেই ইউনেস্কো বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ করে।
একটি ভাষণ একটি জাতির ভবিষ্যৎ বদলে দিতে পারে, হয়ে উঠতে পারে আশা-আকাঙ্খার মূর্ত-প্রতীক। ৭ই মার্চের ভাষণটি যে সমগ্র জাতিকে একটি অনবদ্য ঐতিহাসিক অদৃশ্য রাখিবন্ধনে আবদ্ধ করতে সক্ষম, সে নিরিখেই তা-সন্দেহাতীতভাবে পৃথিবীর ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ বক্তৃতা সমুহের মধ্যে প্রধানতম।
১৮ মিনিটের বক্তৃতায় এত কুশোলী শব্দচয়ন, এত অনন্য সাধারণ প্রত্যয়দৃঢ়, উচ্চারণ এবং স্বাধীনতার এমন স্পষ্ঠ দিক নির্দেশনা, সত্যি বলতে হয় এটাই ছিল স্বাধীনতার ঘোষণা এবং পরাধীনতার বক্ষবিদীর্ণ করে স্বাধীনতার কাঙ্খিত সূর্য্যকে ছিনিয়ে আনার জন্য প্রদর্শিত অনন্য রণকৌশল; যা বঙ্গবন্ধু সুনিশ্চিত হয়ে বলেছিলেন।
তিনি বলেছিলেন, “ আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তোমাদের যার যা কিছু আছে, তা-নিয়েই শত্রু মোকাবেলা কর, তাঁর প্রত্যয়- দৃঢ় কণ্ঠে সেদিন একথাই উচ্চারিত হয়েছিল যে, “রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দিব, তবু দেশকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ।”
১৯৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধ বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। পাকিস্তানি শাসন আর শোষণ অতি অল্প সময়ে বাঙালী জাতিকে অতিষ্ঠ করে তোলে। সে কারণে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৬ এর ৬ দফা আন্দোলন এবং ১৯৬৯ এর গণ আন্দোলন ও ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে ৯ মাসেই অর্জিত হয় চূড়ান্ত বিজয়। স্বাধীকার এবং স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে পরিচালিত সকল তৎপরতায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা ক্রমান্বয়ে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে উঠতে থাকে। তিনি ধর্ম নিরপেক্ষতা, অসাম্প্রদায়িকতা, গণতন্ত্র, বাঙালী জাতীয়তাবাদ ও সমাজতান্ত্রিকী মূল্যবোধের সাথে নিজেকে একাত্ম করেছিলেন।
তাঁর এ বিকাশ অন্যান্য সব নেতা থেকে পৃথক করে এক অভূতপূর্ব মর্যাদায় ও বৈশিষ্টে অধিষ্ঠিত করেছিল। অসাম্প্রদায়িকতা, ধর্ম নিরপেক্ষতা, মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে তাঁর জুড়ি ছিলনা সে সময়। ৬০ এর দশকের মধ্যবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু যুগান্তকারী “৬ দফা” প্রণয়ন করেন এবং তিনি নিজেই নেতৃত্ব দিয়ে বাঙালী জাতীয়তাবাদী চেতনাকে সুসংহত করেছিলেন মূলত ৬ দফার মধ্যেই নিহিত ছিল বাংলাদেশের অভ্যূদয়ের বীজ।
দীর্ঘকাল ব্যাপী রাজনৈতিক আন্দোলন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যূদয়কে অবশ্যম্ভাবী ও অপ্রতিরোধ্য করে তুলেছিলেন তিনি। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের কবল থেকে আমরা যে মেকী স্বাধীনতা পেয়েছিলাম, সে আন্দোলনও ওতোপ্রতোভাবে জড়িত ছিলেন শেখ মুজিব। নবলব্ধ পাকিস্তানে যে সাধারণ মানুষের স্বার্থরক্ষার বিষয়টি অধিকার পাবে না, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের আর্থ-সামাজিক সকল ন্যায়সংগত ও স্বাভাবিক প্রত্যাশা এবং গণতান্ত্রিক অধিকার যে উপেক্ষিত, নিষ্পেষিত ও লঙ্ঘিত হবে তা বুঝতে দেরী হয়নি বঙ্গবন্ধুর।
সে কারণে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই বঙ্গবন্ধুকে আমরা স্বৈরাচারী, অগণতান্ত্রিক পাকিস্তানী শাসকদের বিরুদ্ধে দীপ্ত প্রতিবাদী ভূমিকা গ্রহন করতে দেখি। সে সময় বিভিন্ন শোভাযাত্রা-হরতালে অংশগ্রহনের অজুহাতে পাকিস্তান সরকার ১৯৪৮ সালের মার্চ ও সেপ্টেম্বরে পরপর ২ বার গ্রেফতার করেছিল বঙ্গবন্ধুকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের ন্যায্য স্বার্থরক্ষার সংগ্রামে নেতৃত্ব দেয়ার অভিযোগে ১৯৪৯ সালের মার্চ মাসে বঙ্গবন্ধুকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কার করা হয়েছিল। এরপরও তিনি আরও নানান অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে জীবনে বহুবার গ্রেফতার হন এবং কারাবাস ভোগ করেন। একাধিকবার তাঁকে ফাঁসিতে ঝুলানোর চেষ্টা করেছিল পাকিস্তানি শাসকরা। আগরতলা ষড়ষন্ত্র মামলার সময়ে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছিল।
প্রকৃতপক্ষে যা ছিল “পিন্ডি ষড়যন্ত্র” মামলা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে বঙ্গবন্ধু যখন পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি, তখন মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েও তিনি তাঁর আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। আপোষকামিতাকে প্রশ্রয় না দিয়ে তিনি সর্বদা তাঁর ইস্পাতকঠিন মনোবল অক্ষুন্ন রেখেছিলেন। আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই বঙ্গবন্ধুর সাংগঠনিক দক্ষতার দ্রুত বিকাশ ঘটে। তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে তদানিন্তন মুসলিম লীগের ভরাডুবি ঘটেছিল এবং তখন প্রগতিশীল যুক্তফ্রন্ট পাকিস্তানের সরকার গঠন করে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়।
শেখ মুজিবুর রহমান তখন মন্ত্রীসভায় অন্তর্ভূক্ত হয়ে শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। এরপর পাকিস্তানী শাসকদল অতিঅল্প সময়ে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক যুক্তফ্রন্ট সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে এবং বঙ্গবন্ধুসহ আওয়ামীলীগ নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করে। সে সময়ও তারা বঙ্গবন্ধুকে মৃত্যুদন্ড দেয়ার পাঁয়তারা করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিব্র আন্দোলনের মুখে তাঁকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। মুক্তি লাভ করে তিনি পুনরায় দেশব্যাপী আন্দোলনকে সুসংহত করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন।
১৯৬০ এর দশকের শেষ দিকে ১৯৬৯ এর গণ-বিক্ষোভসমূহ এবং ১৯৭০ এর গণআন্দোলনকে সঠিক পথে পরিচালনা করে বঙ্গবন্ধু যেভাবে দূর্বার জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলেছিলেন এবং দেশবাসীর চিত্তে স্বাধীনতার আকাঙ্খাকে যেভাবে তুঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁর কোন তুলনা করা সম্ভব নয়। এরপর ১৯৭১ সালের ১ জানুয়ারী থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত পাক হানাদার বাহিনীর হাতে বন্দি হওয়ার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত প্রকৃতপক্ষে তদানিন্তন
পূর্ব পাকিস্তান হয়ে উঠেছিল স্বাধীন বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের সফল অধিনায়ক। এক অসাধারণ ও অসহযোগ আন্দোলন পরিচালিত হয়েছিল তখন বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই। যার ব্যাপ্তিতে শান্তিপূর্ণ প্রয়োগ, দৃঢ়তায় এবং সর্বাত্মক শতভাগ সফলতায় বিশ্ব ইতিহাসের সামনে এক অভূতপূর্ব নজির স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। ফলশ্রতিতে ১৯৭০ এর জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামীলীগের নিরঙ্কুশ বিজয়ও নিশ্চিত হয়েছিল সেদিন।
বাঙ্গালী জাতির মুক্তি এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে যাঁর এত আত্মত্যাগ সেই মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই আমাদের স্বাধীনতার মূল স্থপতি; আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রধান সারথি ও অগ্নিপুরুষ। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি স্ব-শরীরে আমাদের মাঝে না থাকলেও ৯ মাসের এ রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধারা এবং অবরুদ্ধ বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষ তাঁর আদর্শকে হৃদয়ে ধারণ করেই সামনের দিকে এগিয়ে গেছে। তাঁর ৭ই মার্চের ভাষণ ও স্লোগান “জয় বাংলা” কে কণ্ঠে ধারণ করেই দেশকে শত্রুমুক্ত করে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য মরণপন করে লড়ছিল এ দেশের মুক্তিকামী মানুষ।
প্রকৃতপক্ষে আমাদের স্বাধীনতা, আমাদের বিজয়, সবকিছুই যেন ৭ই মার্চের ভাষণ থেকে পাওয়া আগাম বিজয় বার্তা। বঙ্গবন্ধু বাঙালী জাতির জনক, বাঙালীর স্বাধীন রাষ্ট্রের স্থাপতি, আবার শৃঙ্খলিত বাঙালী জাতির শিকল ভাঙ্গার যুদ্ধের তিনিই যোগ্য সেনাপতি। তাই, দেশের মানুষ তাঁকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। তুরস্কের জনক- কামাল আতাতুর্ক হারিয়ে যাওয়া তুরস্কের যেভাবে জন্ম দিয়েছিলেন, নুতনরূপে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, তেমনিভাবে শেখ মুজিবুর রহমানও বাঙালী জাতিকে তথা বাংলাদেশকে নুতনরূপে বিশ্বের দরবারে পরিচিত করেছেন, জন্ম দিয়েছেন একটি নতুন দেশের।
জাতির সামনে এখন তাই নুতন সূর্য উদিত হয়েছে এবং জাতির জনক ও বাংলাদেশের স্থপতিকে চিনে নিতে দেশের সর্বস্তরের মানুষের বিন্দুমাত্র ভুল হয় নি।
আসল কথা হল সমগ্র জাতিকে তিলতিল করে একটি জাতীয় ঐক্যের মোহনায় দাঁড় করতে সক্ষম হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুই। তাই, তাঁর দেওয়া ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণটি আজকে বিশ্ব স্বীকৃতিলাভ করেছে। যে ভাষণে তিনি তাঁর নিজস্ব অবস্থান ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছিলেন, “ আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না, জনগণের অধিকার চাই।”
সম্প্রতি ইউনেস্কোর “মেমোরী অব দ্যা ওয়ার্ল্ড” তালিকায় জাতির জনক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণকে স্থান দিয়ে জাতির জনকের মর্যাদাকে আরও শক্তিশালীভাবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে এবং বিশ্বের দরবারে বাঙ্গালী জাতির মর্যাদাকে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিষ্ট