চলতি বছরে অথবা ২০১৯ সালের জানুয়ারী মাসে দেশে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। আর নির্বাচনকে ঘিরে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নির্বাচনী আমেজ সৃষ্টি হয়েছে। সরকারী দল ও বিরোধী দলের নির্বাচন পূর্ব কর্মচাঞ্চল্য দেখেই তা বুঝা যাচ্ছে। গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে একটি অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠ ও সবার অংশ গ্রহণ মূলক নির্বাচন এখন সকলের কাম্য। সরকার গঠন ও সরকার পরিবর্তনের স্বীকৃত পদ্ধতির নামই গণতন্ত্র। গণতন্ত্র বিশ্বজনীন রাজনৈতিক পরিভাষা। জনগণের অবাধ ভোটাধিকারের মাধ্যমে সরকার গঠনের পদ্ধতিকেই রাজনৈতিক পরিভাষায় গণতন্ত্র বলা হয়। আর নীতিগতভাবে এ পদ্ধতির যৌক্তিকতা সকলেই স্বীকার করে।
গণতান্ত্রিক প্রত্যেক সরকারের উপর জনগণের সমর্থন থাকুক এটা প্রতিটি গণতান্ত্রিক সরকারেই ঐকান্তিক কামনা। আর এ জন্য অবৈধভাবে ক্ষমতায় আসা একনায়ক সরকার প্রধান নির্বাচিত বলে স্বীকৃত পাওয়ার জন্য গণতান্ত্রিক ভাবে স্বীকৃত এ পদ্ধতির আশ্রয় নিয়ে থাকে। গণতান্ত্রিক পদ্ধতির জনপ্রিয়তাই এর মূল কারন। গণতন্ত্রের মূল নীতি হ’ল নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের সমর্থণ আদায় করে ক্ষমতায় যাওয়া। কিন্তুু নির্বাচন নিরপেক্ষভাবে হওয়া অপরিহার্য। নিরপেক্ষ ভোটে নির্বাচিত সরকারই আত্মবিশ্বাস নিয়ে দেশ পরিচালনা করতে পারে। এ ক্ষেত্রে বিরোধী দল গণতান্ত্রিক সরকারের বৈধ্যতা ও নৈতিক অবস্থানের স্বীকৃতি দিতে বাধ্য।
নির্বাচিত সরকারকে অবশ্য জাতির কল্যাণে তাদের দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে ভূলত্রুটি ধরিয়ে দেয়া এবং সরকারকে পরামর্শ দিতে জনগণের অবাধ স্বাধীনতা থাকা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে অপরিহার্য। দেশের আইন শৃঙ্খলার সীমার মধ্যে থেকে নিয়মতান্ত্রিক বিরোধী দলের ভূমিকা পালনের সুযোগ থাকা গণতন্ত্রের প্রধান হল লক্ষণ। জনগণের সমর্থন ছাড়া অন্য যে কোনভাবে ক্ষমতা দখল গণতান্ত্রিক রীতি নীতির সম্পূর্ণ বিপরীত। শাসনতন্ত্রে সরকার গঠন, পরিবর্তন ও পরিচালনার ক্ষেত্রে মৌলিক নীতিমালা বিধি-বদ্ধ হতে হবে। শাসনতন্ত্রের বিরোধী অন্য যে কোন নিয়মে সরকার গঠন, পরিবর্তন ও পরিচালিত হলে তা-অবৈধ বলে বিবেচিত।
উল্লেখিত মূলনীতিগুলোর একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা যথাযথভাবে পালন করলেই সেখানে প্রকৃত গণতান্ত্রিক সরকারের বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণভাবে ফুঁটিয়ে উঠে। আর তখন গণতন্ত্রকে সম্মৃদ্ধ ও শক্তিশালী বলে ধরে নেয়া হয় জনগণের মতামত এবং তাদের ইচ্ছা ও আগ্রহে গঠিত সরকারই সকলেরই পছন্দনীয় সরকার। সরকার এমন হতে হবে যেন সে সরকারকে জনগণ অবশ্যই তাদের সরকার মনে করে। সরকারকে জনগণের জন্য কাজ করতে হবে। আর সরকার কে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধি কর্তৃক পরিচালিত হতে হবে। প্রকৃতপক্ষে সরকার গঠন ও সরকার পরিবর্তনের বিশেষ পদ্ধতির নামই হ’ল গণতন্ত্র।
গণতন্ত্রে জনগণের সার্বভৌমত্ব স্বীকৃত। সার্বভৌমত্ব হ’ল আইন প্রনয়ণের সর্বোচ্চ শক্তি। আইনের সার্বজনীন সংজ্ঞা হ’ল’’ সার্বভৌম সত্ত্বার ইচ্ছাই আইন। আধুনিক গণতন্ত্রের সংজ্ঞায় জনগণই সার্বভৌম সত্ত্বা। তাই জনগণ ও জনগণের নির্বাচিত পার্লামেন্ট জনগণের প্রতিনিধিদের দ্বারা প্রনয়ণকৃত শাসনতন্ত্র মেনে চলতে বাধ্য। একমাত্র নির্বাচিত পার্লামেন্টই বাস্তবে জনগণের সার্বভৌম শক্তি প্রয়োগ করে থাকে। শাসনতন্ত্র ছাড়া অন্য কিছুই পার্লামেন্ট এর ক্ষমতা খর্ব করতে পারে না। ভাল-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, সত্য-মিথ্যার সিদ্ধান্ত অধিকাংশ লোকের মতামতে মাধ্যমে হতে পারে না, এ সব স্বাশত মূল্যবোধের ব্যাপার। গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে বিরোধীদের আন্দোলনকে অশালীন ভাষা গালিগালাজ দেয়া ঠিক না। গণতন্ত্রমনা মানুষের ভাষাই বলে দেয়, তারা প্রকৃত পক্ষে ধৈর্যশীল। ক্ষমতাসীন দলে থেকে বিরোধী দলকে দালাল বলা বা অশালীন ভাষায় গালি দেয়া অনুচিৎ।
কেননা আইন সরকারের হাতেই থাকে। কারো বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা না নিয়ে গালা-গাল দেয়া গণতন্ত্র রীতিনীতি বহির্ভূত। আইন প্রয়োগ না করে গালা-গাল দেয়া ক্ষমতাসীনদের দূর্বলতারই লক্ষণ প্রকাশ পায়। কেননা সরকারী দলের হাতেই তো ক্ষমতার লাগাম। তাদের অধৈর্য হওয়ার কোন কারন থাকতে পারে না এবং এ সব অশালিন কথা অবশ্যই বলারও কোন কারন থাকতে পারে না। এ কথা অবশ্যই বলা দরকার যে, বিরোধীরা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য অধৈর্য হতে পারে সে ক্ষেত্রে সরকারী দলকে ধৈর্যধারন করে বিরোধী দলকে সুযোগ করে দিতে হবে এবং সংশোধনে আনার প্রচেষ্টাও চালাতে হবে।
কেননা বিরোধীদেরও ক্ষমতায় যাওয়ার অধিকার রয়েছে, এ কথা সরকারী দলকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে। বিরোধী দলকে অবশ্য ক্ষমতা যাওয়ার জন্য ধৈর্যসহকারে অপেক্ষা করতে হবে। গণতন্ত্রে বিশ্বাসীদের কার্যক্রম অবশ্যই গণতন্ত্র সম্মত হতে হবে। বিরোধীরাও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশ। গণতন্ত্রে বিশ্বাসী বিরোধীদের গণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতায় যেতে হলে কার্যক্রম একধরনের এবং বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতায় যেতে চাইলে ভিন্নরুপ কর্মধারা তারা অনুস্মরণ করবে এটাই স্বাভাবিক। তাদের কর্মনীতি ও কর্মপন্থা থেকেই তাদের প্রকৃত চেহারা স্পষ্ঠ হতে বাধ্য। শাসন ক্ষমতা অবশ্যই নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ থেকেই হাসিল করতে হবে। আর এ ক্ষমতা পেতে হলে তা জনগণের ভোটের মাধ্যমে ফায়সালা করতে হবে।
গণতান্ত্রিক পদ্ধতি প্রয়োগ করেই ১৯৯০ সালে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকার পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল। কেননা গণতন্ত্র ও নির্বাচন ব্যবস্থা গণ বিপ্লবের সহায়ক। যারা বিপ্লব চান, নির্বাচনকে বিরোধী মনে না করে তাদেরকে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই এগিয়ে আসতে হবে। কেননা শ্বাশত মূল্যবোধে বিশ্বাসীদের একনিষ্ঠ সরকার গঠন ও পরিবর্তন এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের একটিই মাত্র পদ্ধতি আর তা-হল গণতন্ত্র। এক কথায় নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন ও পরিবর্তন করার পদ্ধতির নামই হল গণতন্ত্র। আর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সুষ্ট, অবাধ নিরপেক্ষ ও সবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রয়োজন বর্তমানে অত্যন্ত জরুরী।