ইতিহাসে ভয়াবহ, জঘন্যতম বর্বরচিত গণত্যার অনেক কিছুই লেখা রয়েছে। এ গুলোর মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সংঘটিত হয়েছিল ইহুদিদের উপর চালানো গণহত্যা। যর নাম ‘হলকাষ্ট’। এডলফ হিটলারের অধিনস্ত জার্মান বাহিনী, যার নাম ছিল নাৎসী সামারিক বাহিনী। তদানিন্তন ইহুদী জনগোষ্ঠীর অর্ধেকেরও বেশি অংশকে বন্দি শিবিরে হত্যা করেছিল নাৎসী বাহিনী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এডলফ হিটলারের নেতৃত্বে ক্ষমতাসীন ন্যাশনাল সোশ্যালিষ্ঠ জার্মান ওয়ার্কার পার্টী কর্তৃক পরিচালিত গণহত্যায় তখন অমানুমানিক ষাট লক্ষ ইহুদীসহ সংখ্যালঘু জাতি-গোষ্ঠীর অনেক মানুষ প্রাণ দিয়েছিল। অনেখ লেখক ও অন্য সব জনগোষ্ঠীর সংজ্ঞার আওতায় না এনে তারা শুধু ইহুদী গণহত্যাকেই ‘হলকাষ্ঠ’ নামে অভিহিত করেছে। নাৎসী অত্যাচারের সব ঘটনা আমলে নিলে নিহতের সংখ্যা দাঁড়াতে পারে নব্বই লাখ হতে এক কোটি দশ লাখের মত।
আর রাজা লিওপোল্ডের গণহত্যা। বেলজিয়ামের রাজা দ্বিতীয় লিওপোল্ড ইতিহাসে কুখ্যাত হয়ে আছে তার নেতৃত্বে পরিচালিত গণহত্যার জন্য। সে ছিল বেলজিয়ামের সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের প্রধান। লিও পোল্ড ইন্টারন্যাশনাল আফ্রিকান সোসাইটি নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলে। সংগঠনটির বাহ্যিকরূপ ছিল সমাজ সংস্কার। কিন্তু এর আঁড়ালে চালান হত দাস ব্যবসা। তারা আফ্রিকার কঙ্গোর মানুষ দিয়েই সে দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ লুন্ঠন শুরু করে। সে অত্যাচারী লিও পোল্ড, কঙ্গোর মানুষের উপর ভয়াবহ ্অত্যাচার, জুলুম, অঙ্গছেদ ও মৃত্যুদন্ডের মত শাস্তি দিয়ে তার একনায়কত্ব কায়েম করে। তার অনুগত সেনাবাহিনী দ্বারাই এ সব কর্মকান্ড চালাত লিও পোল্ড। তার বাহিনীর নাম ছিল ‘ ফোর্স পাবলিক’। সে সময়ের নৃশংস হত্যাকান্ডে প্রাণ হারিয়েছিল কঙ্গোর প্রায় এক কোটিরও বেশি মানুষ। সেনাবাহিনীর গুলি যাতে অপচয় না হয় সে জন্য সরকারী নির্দেশে প্রতিটি গুলির বিপরীতে একটি করে মানুষের কব্জি জমা করতে হ’ত সেনাবাহিনীকে। এরপর রুয়ান্ডার গণহত্যা, বসনিয়ার গণহত্যা, নানকি ট্রাজেডি, কম্বোডিয়ার খেমারুজদের জঘন্যতম গণহত্যা। সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী নরদম সিহানুকেই ক্ষমতাচ্যুত করে জেনারেল লনলন জঘন্যতম এ গণহত্যা চালান। ঐ গণহত্যার সময় সে দেশের লোক সংখ্যা ছিল সত্তুর লাখ। সবাই ছিল বৌদ্ধ। কম্বোডিয়ার গণহত্যায় কত মানুষ নিহত হয়েছিল তার কোন সঠিক তথ্য নেই, তবে ঐ সময়ে বেঁচে যাওয়া মানুষের মতামতে জানা গেছে খেমারুজ সরকারের আগে কম্বোডিয়ায় সাত লাখ মুসলমান বসবাস করত। এর মধ্যে পাঁচলাখ মুসলমান গণহত্যার শিকার হয়েছিল সে সময়। এরপরও যুগে যুগে অনেক হত্যাকান্ড সংঘটিত হয় বিভিন্ন দেশে। অত্যাচারী ও নরপিচাস ক্ষমতাশালী শাসকের দ্বারা অনেক নিরীহ মানুষ। জোসেফ স্ট্যালিন কুড়ি লাখের বেশি মানুষকে হত্যা করেছিল নির্বিচারে। আর কৌশল অবলম্বনের মাধ্যমে অসুস্থ্য করেও মেরে ফেলা হয়েছিল প্রায় পনের লাখ মানুষকে। যার নির্মম সিদ্ধান্তে অসুস্থ্য হয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরতে হয়েছিল এ সব অসহায় মানুষকে।
নয়াচীনের সমাজতান্ত্রিক, নেতা মাওসেতুং প্রায় কুড়ি লাখ মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল। এ ছাড়াও মোসেলিনি বার লাখ মানুষ মেরে কুখ্যাত হয়ে রয়েছে ইতিহাসে। ভারতের অশোকা (কলিঙ্গ বেটল) এক লাখ মানুষকে হত্যা করেছে নির্মমভাবে। জর্জ ডব্লিউ বুশ, ইরাকের বিরুদ্ধে পারমানবিক অস্ত্রের অধিকারী হওয়ার মিথ্যা গুজব রটিয়ে ইরাকের প্রায় দেড় লাখ মুসলমানকে হত্যা করে এবং অনেক মানুষকে বিভিন্ন কারাগারে নির্মমভাবে অত্যাচার চালিয়ে অনেক বন্দিকেও মেয়ে ফেলা হয়।
ইতিহাসে আরও একটি কলঙ্কিত দিন হল ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ। এ দিনে বাঙ্গালী জাতির উপর নেমে আসে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর ভয়ংকর অভিশাপ। এ রাতে বর্বর হানাদার বাহিনী ঘুমন্ত নিরস্ত্র বাঙ্গালীর উপর ‘অপারেশন সার্চলাইট’ এর নামে আধুনিক মারনস্ত্র নিয়ে হিংস্রের মত ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তারা একসাথে নৃশংস হত্যাযজ্ঞে অগণিত নিরস্ত্র বাঙ্গালী হত্যা করেছিল। দেশের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী সন্তানদের হত্যার মাধ্যমে নিঃশেষ করে দিয়েছিল দেশের বুদ্ধিজীবিদের। আধুনিক মারনস্ত্রের গোলার আঘাতে দেশের বড় বড় শহরগুলো জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল। মার্কিন সাংবাদিক রবার্ট পেইন, ২৫ মার্চের এ হত্যাকান্ড সম্পর্কে লিখেছেন, সে রাতেই ঢাকাতেই হত্যা করা হয়েছিল সাত হাজার মানুষকে। পাকিস্তানী হানাদারদের এ বর্বরচিত হত্যাকান্ডের স্বীকৃতি খোদ পাকিস্তানী সরকারের প্রকাশিত দলিলেও লেখা রয়েছে। ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে তারা এ দেশের ত্রিশলক্ষ মানুষকে হত্যা করেছিল এবং দু-লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমহানী করেছিল। পৃথিবীর ইতিহাসে জঘন্যতম গণহত্যা গুলোর মধ্যে এটি অন্যতম হিসেবে স্বীকৃত। যে হত্যাকান্ড মুসলিম জাতিকে কলুষিত করেছে। কেননা একমাত্র পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ছাড়া আর কোন মুসলিম বাহিনীর দ্বারা কোন ধরনের হত্যা কান্ডের রেকর্ড ইতিহাসে নেই । আর, বাঙ্গালী জাতি এ জঘন্য হত্যাকান্ডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি চায়।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে মায়ানমারের মুসলিম জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের খুন, ধর্ষণ, লুটপাট এবং বাস্তহারা করে দেশ থেকে বিতারিত করছে ‘নোবেল শান্তি’ পদক প্রাপ্ত নেত্রী অংসান সুচি। মানানমার সেনাবাহিনী কর্তৃক এ বর্বরতম হত্যা ও নির্যাতন থেকে রক্ষা পেতে লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা নারী-পুরুষসহ বৃদ্ধ ও শিশুরা বাংলাদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। উদ্বাস্ত মানুষের ঢল নেমেছে কক্সবাজার জেলায় এবং প্রায় ৭ লাখ রোহিঙ্গার শরনার্থী এসেছে বাংলাদেশে। তারা কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন শরনার্থী ক্যাম্পে অবস্থান করছে।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, পৃথিবীর বুকে সবচেয়ে বড় বড় হত্যাকান্ডগুলো সংঘটিত হয়েছে অমুসলিম ক্ষমতাধর বা রাষ্ট্র প্রধানদের দ্বারা। অথচ এরাই দিনরাত গণতন্ত্র ও মানবতার স্বপ্ন পায়। আর এ নিয়ে জপমালা তৈরি করে মুখে ফেনা তোলে। এ সব মূখোশধারী গণতন্ত্রবাদীদের দ্বারা বিশ্বে বারবার সংঘটিত হচ্ছে বর্বরচিত হত্যাযজ্ঞ। আর ভূলুন্ঠিত হচ্ছে বিশ্ব মানবতার। তাই, বিশ্বমানবতার কাছে প্রশ্ন? প্রথম বিশ্বযুদ্ধ যারা শুরু করেছিল, তারা কি মুসলমান ছিল? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু করেছিল কারা? যারা জাপানের হিরোসীমা ও নাগাসাকিতে আনবিক বোমা বর্ষণ করেছিল, তারাও তো মুসলমান ছিল না। আমেরিকা আবিষ্কারের পর যারা নিজেদের প্রভাব বিস্তারের জন্য উত্তর আমেরিকার ১০০ শত মিলিয়ন এবং দক্ষিণ আমেরিকার ৫০ মিলিয়ন রেড ইন্ডিয়ান কে হত্যা করেছিল তারাও কিন্তু মুসলমান ছিল না। এতে প্রমাণিত হয়, মুসলমানরা শান্তি প্রিয় জাতি। তারা কখনই হত্যা, নির্যাতন, জুলুম ও বর্বরতাকে প্রশ্রয় দেয় না বরং ঘৃণা করে। আর এখন এ সব শান্তি প্রিয় মুসলমানকে ধর্মান্ধ বানিয়ে এবং সাম্প্রদায়িকতার বীজ ঢুকিয়ে মানুষ হত্যায় নিয়োজিত করছে ঐ সব বিশ্বাসঘাতক অমুসলিম। তারা জঙ্গিবাদ দমনের নামে মুসলমানে মুসলমানে সংঘর্ষ ও বিবাদে লিপ্ত করছে এবং মুসলমানদের নামে জঙ্গিবাদের কালিমা লেপন করছে। তাই সময় এসেছে মুসলিমদের এ সব নিয়ে নুতন করে ভেবে দেখার।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিষ্ট