Sunday, 22 December 2024, 07:56 AM

বরিশালের নদীগুলোতে অবাধে অপরিকল্পিত বালু উত্তোলন, নদী ভাঙ্গনের...

সাব্বির আলম বাবু, বরিশাল প্রতিনিধিঃ বরিশালের কীর্তনখোলাসহ বেশকিছু নদীতে রাতের আধাঁরে বিভিন্ন স্থানে ড্রেজার দিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করার অভিযোগ উঠেছে। আর এর ফলে আগামী বর্ষায় তীব্র ভাঙনের আশঙ্কা করছেন নদী তীরের বাসিন্দারা।


কীর্তনখোলার তীরে বসবাস করা বরিশালের সদর উপজেলার চরকাউয়া, চরমোনাই ও চরবাড়িয়া ইউনিয়নের বাসিন্দারা বলছেন, বালুমহাল ছাড়া নদী থেকে বালু উত্তোলন অবৈধ। তবে সরকার পতনের কয়েকদিন পর থেকে রাতের আধারে কীর্তনখোলা নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে ড্রেজার দিয়ে অবৈধভাবে বালু কাটা হচ্ছে। তাদের অভিযোগ, রাতে ড্রেজার দিয়ে বালু তোলা হলেও দিনে সেগুলো দেখা যাচ্ছে না। দিনের বেলা ড্রেজারগুলো নদী থেকে খালে নয়তো অন্যত্র সরিয়ে রাখা হচ্ছে। ফলে দিনে নদীর দিকে তাকালে কিছু বোঝার উপায় থাকছে না। এভাবে বালু উত্তোলন করা হলে শিগগিরই তীরে ভাঙন শুরু হবে।


রাসেল হোসেন নামে এক বাসিন্দা বলেন, বছরের পর বছরের ভাঙনে চরবাড়িয়া ইউনিয়নের একটি অংশ আজ বিলীন হয়ে গেছে। কত মানুষ নিঃস্ব হয়েছে, তারও হিসাব নেই। কয়েক বছর আগে বেলতলা খেয়াঘাট থেকে চরবাড়িয়া ইউনিয়নের ভাঙার মাথা পর্যন্ত একটি বেড়িবাঁধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু শুধু অবৈধভাবে ইচ্ছেমতো নদী কেটে বালু তোলার কারণে সেটিও এখন ঝুঁকিতে। তিনি বলেন, বালু উত্তোলনের কারণে বাড়ি-ঘর নদীতে বিলীন হওয়ার উপক্রম হলেও যারা এর সঙ্গে জড়িত, তাদের স্থানীয়রা কিছুই বলতে পারেন না। শুধুমাত্র তাদের প্রভাবের ভয়ে সবাই দেখেও না দেখার ভান ধরে থাকে। শুধু প্রশাসনই এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে। বালু উত্তোলন বন্ধ না হলে বাঁধ দিয়েও জমি-বাড়িঘর রক্ষা করা যাবে না বলে জানালেন রহিমা বেগম নামে এক নারী। তিনি বলেন, নদীভাঙনে বহুবার বাড়িঘর হারিয়েছি। এখনো হারানোর অপেক্ষায় থাকি। রাতে যখন ড্রেজার চলার শব্দ হয়, তখন নিজের মনকে বোঝানো ছাড়া প্রতিবাদের উপায় থাকে না।  প্রশাসন যদি কঠোর হয়, তাহলে এদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। শুধু যে কীর্তনখোলা তা নয়, মেহেন্দিগঞ্জের মাসকাটা, কালাবদর, হিজলার ছোট মেঘনা, বাবুগঞ্জ ও উজিরপুর উপজেলার সন্ধ্যা নদীতেও সুযোগ বুঝে মধ্যরাতে ড্রেজার মেশিন চালনার বিষয়টি জানিয়েছেন স্থানীয়রা। বাবুগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা সাইফুল জানান, মধ্যরাতে নদীর এমন স্থানে ড্রেজার চালিয়ে নদীর বালু কাটা হয়, যেখানে প্রশাসনেরও বুঝতে সমস্যা হবে। কারণ উপজেলা সদর কিংবা থানা এলাকা থেকে অনেকটাই দুরে থাকে এসব স্থান।


আবার রাতের বেলা ড্রেজারের দাপট থাকলেও দিনের বেলা নদীতে ঘুরলে কোথাও এসবের দেখা মেলে না বলে জানান মেহেন্দিগঞ্জের বাসিন্দা আশিকুর রহমান। তিনি বলেন, মেঘনার বালুমহাল থেকে বালু কেটে আনতে সময়ের সঙ্গে ব্যয়ও বেড়ে যায়। তাই ইজারাদাররা মধ্যরাতে উপজেলা সদরগুলো থেকে স্বল্প দূরত্বে গিয়ে যত্রতত্র বালু কাটছে। এতে করে নদীর মূল স্রোতধারা পাল্টে যাচ্ছে এবং বর্ষায় ভাঙনের তীব্রতা বিভিন্ন অংশে বেড়ে যাচ্ছে। বর্তমান অবস্থায় অবৈধ ড্রেজিং থামানো না গেলে সামনের বর্ষায় ভোগান্তিতে পড়বে নদীতীরের সাধারণ মানুষ। শুধু যে ড্রেজিং করে বালু কাটা হচ্ছে, তা নয়। বরিশাল সদর ও বাকেরগঞ্জের অনেক জায়গাতেই নদী তীরের মাটি কেটে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। যদিও প্রশাসন অভিযান চালাচ্ছে, তবে একেবারে রোধ করা যায়নি মাটিকাটাও। স্থানীয়দের দাবি, এসব রোধ করতে হলে আভিযানিক দলকে কৌশলী হওয়ার পাশাপাশি মধ্যরাতেই বেশি হানা দিতে হবে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা বলছেন, বালুমহাল ইজারা যেমন তাদের আওতাধীন বিষয় নয়, তেমনি অবৈধ ড্রেজারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা তারা নিতে পারেন না। এ বিষয়ে উপজেলা-জেলা প্রশাসন এবং নৌপুলিশ ব্যবস্থা নিতে পারে। তবে সমীক্ষা না করে নদীতে ড্রেজিং করলে তীর ভাঙাসহ গতিপথ ঘুরে যায়। অবৈধভাবে বালু উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধে শিগগিরই ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানান বরিশাল সদর নৌ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সনাতন চন্দ্র সরকার। তবে শুধু বালু উত্তোলনকারী নয়, এর পরিবহনের সাথে জড়িত অবৈধ বাল্কহেডসহ নৌযানগুলোর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি তুলেছে বাংলাদেশ কার্গো-ট্রলার-বাল্কহেড শ্রমিক ইউনিয়ন।


ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সজল সিকদার বলেন, অবৈধ বালু উত্তোলনের সঙ্গে জড়িত অধিকাংশ নৌযানেরই কাগজপত্র নেই। তাদের কারণে নৌ-দুর্ঘটনাও ঘটছে। তাই এদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।


যদিও বিপদে পড়ার ভয়ে ড্রেজার ও বালু পরিবহনের সঙ্গে জড়িত শ্রমিকরা এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি, তবে নদীতীরের বালু ব্যবসায়ীরা জানান, অবৈধদের কারণে বালুমহাল ইজারা নিয়েও বিপাকে পড়েছেন প্রকৃত ব্যবসায়ীরা। বরিশাল জেলার ১০টি উপজেলার মধ্যে বাকেরগঞ্জ উপজেলায় দুটি, বানারীপাড়ায় তিনটি ও বাবুগঞ্জের একটি পয়েন্টে বালুমহাল ইজারা দেওয়া রয়েছে জেলা প্রশাসনের।