Wednesday, 12 March 2025, 12:05 AM

চিরবিদায়ের আগের দিনটি যেভাবে কেটেছিল সালমানের

ডেস্ক রিপের্টঃ নব্বই দশকে বাংলা সিনেমায় ধূমকেতুর মতো সালমান শাহের আবির্ভাব। যাকে ভালোবেসে ‘অমর নায়ক’ উপাধি দিয়েছেন ভক্তরা। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি জয় করেছিলেন অসংখ্য ভক্তের হৃদয়। আবার হারিয়েও গেছেন অল্প সময়ের মধ্যেই।

ক্যারিয়ার স্থায়ী হয়েছিল মাত্র চার বছর! এ সময়ের মধ্যেই ২৭টি ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি। আগামীকাল এ নায়কের মৃত্যুবার্ষিকী। দিনটি উপলক্ষে সালমান শাহকে নিয়ে বিভিন্ন সময় ব্লগ কিংবা গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন তথ্য নিয়ে পৃষ্ঠাজুড়ে এ আয়োজন।

পারিবারিক পরিচয়

১৯৭১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন সালমান শাহ। তার পারিবারিক নাম চৌধুরী শাহরিয়ার ইমন। রাশি বৃশ্চিক। পরিবারের বড় ছেলে। দাদার বাড়ি সিলেট শহরের শেখঘাটে। যে বাড়ির নাম এখন ‘সালমান শাহ হাউস’। নানার মূল বাড়ি ছিল মৌলভীবাজারে। বর্তমানে সিলেটের দারিয়া পাড়ায়। ১৯৯২ সালের ১২ আগস্ট বিয়ে করেন তিনি। তার স্ত্রীর নাম সামিরা।

মিডিয়ায় যেভাবে শুরু

১৯৮৫-৮৬ সালের দিকে হানিফ সংকেতের গ্রন্থনায় ‘কথার কথা’ নামে একটি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান প্রচারিত হতো। এর কোনো একটি পর্বের জন্য হানিফ সংকেত নিজের কণ্ঠে ‘নামটি ছিল তার অপূর্ব’ শিরোনামে একটি গান রেকর্ড করেন। এর জন্য বিশেষভাবে ভিডিও নির্মাণ করেন। একজন সম্ভাবনাময় সদ্য তরুণ তার পরিবারের নানা ধরনের ঝামেলার কারণে মাদকাসক্ত হয়ে মারা যায়- এমনই ছিল গানের থিম। এই গানের ভিডিওতে অভিনয়ের মাধ্যমে প্রথম মিডিয়ায় আসেন সালমান শাহ। গানের গল্পে প্রধান চরিত্র অপূর্বর ভূমিকায় অভিনয়র করেন তিনি। তখন অবশ্য ইমন নামেই পরিচিত ছিলেন তিনি। সে সময় মিউজিক ভিডিওটি বেশ জনপ্রিয়তা পেলেও নিয়মিত টিভি পর্দায় দেখা না যাওয়ার কারণে ইমনকে ভুলে যান দর্শকরা।

একনজরে সালমান

* মূল নাম : চৌধুরী শাহরিয়ার ইমন

* জন্ম : ১৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১

* মৃত্যু : ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৯৬

* বাবা : কমর উদ্দিন চৌধুরী ষমা : নীলা চৌধুরী

* স্ত্রী : সামিরা

* উচ্চতা : ৫ ফুট ৮ ইঞ্চি ষরাশি : বৃশ্চিক

* প্রথম ছবি : কেয়ামত থেকে কেয়ামত

* শেষ ছবি : বুকের ভেতর আগুন

* প্রথম নায়িকা : মৌসুমী

* সর্বাধিক ছবির নায়িকা : শাবনূর (১৪টি)

* মোট ছবি : ২৭টি

* বিজ্ঞাপনচিত্র : মিল্কভিটা, জাগুরার কেডস, গোল্ড স্টার টি, কোকাকোলা, ফানটা।

* ধারাবাহিক নাটক : পাথর সময়, ইতিকথা

* একক নাটক : আকাশ ছোঁয়া, দোয়েল, সব পাখি ঘরে ফেরে, সৈকতে সারস, নয়ন, স্বপ্নের পৃথিবী।

চিরবিদায়ের আগের দিনটি যেভাবে কেটেছে

১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর রাতে বা সকালের কোনো এক সময় মৃত্যু হয় সালমানের। তার আগের দিন অর্থাৎ ৫ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় ‘প্রেমপিয়াসী’ ছবির ডাবিং করতে এফডিসিতে যান সালমান শাহ। ওখানে এ ছবির নায়িকা শাবনূর আগে থেকেই ডাবিংয়ের জন্য অবস্থান করছিলেন।

এফডিসিতে পৌঁছানোর কিছুক্ষণ পর সালমান তার বাবাকে ফোন করে বলেন, তার স্ত্রী সামিরাকে নিয়ে এফডিসির সাউন্ড কমপ্লেক্সে আসার জন্য। ফোন পাওয়ার পরপরই সালমানের বাবা সামিরাকে নিয়ে এফডিসি আসেন। শ্বশুরের সঙ্গে সাউন্ড কমপ্লেক্সে এসে সামিরা দেখতে পান সালমান ও শাবনূর ডাবিং রুমে খুনশুটি করছেন। সালমানের ঘনিষ্ঠরা বিভিন্ন সময় বলেছেন, সালমান প্রায়ই শাবনূরের সঙ্গে এ ধরনের খুনশুটি করতেন সামিরাকে উত্তেজিত করে তোলার জন্য। এটা করে তিনি আনন্দ পেতেন।

কিন্তু সেদিনের বিষয়টি আনন্দময় ছিল না। সালমানকে শাবনূরের সঙ্গে খুনশুটি করতে দেখে রেগে যান সামিরা। সালমানের বাবা চলে যাওয়ার পর সামিরাও দ্রুত গাড়িতে ওঠেন। ‘অবস্থা জটিল’ বিষয়টি বুঝতে পেরে একই গাড়িতে ওঠেন সালমান শাহ ও চিত্রপরিচালক বাদল খন্দকার। কিন্তু গাড়িতে বসে সালমানের সঙ্গে কথা বলেননি সামিরা। তাকে বোঝাতে থাকেন বাদল খন্দকার।

গাড়ি এফডিসির গেট পর্যন্ত গেল সালমান প্রধান ফটকের সামনে নেমে যান। তার সঙ্গে বাদল খন্দকারও নামেন। সেখানে কিছুক্ষণ আড্ডাও দেন। অথচ কর্মজীবনের তিন বছরে একবারের জন্য গেটে আড্ডা দেননি সালমান। বিষয়টি তখনকার নিরাপত্তাকর্মীদের দৃষ্টি এড়ায়নি। তারা কানাঘুষাও করছিলেন এ নিয়ে। এরপর ডাবিং রুমে ফিরে গেলেও ঠিকমতো ডাবিং হয়নি।

ওইদিন রাত ১১টার দিকে নিউ ইস্কাটন রোডের ইস্কাটন প্লাজার বি-১১ নম্বর ফ্ল্যাটে সালমানকে পৌঁছে দিয়ে বিদায় নেন বাদল খন্দকার। সামিরাও তখন ঘরে। কিন্তু সালমানের সঙ্গে কোনো ধরনের কথা বলেননি তিনি। সাড়ে ১১টার দিকে বেডরুমে গিয়ে টিভি দেখেন সালমান। ১২টার দিকে তার মোবাইলে একটি ফোন আসে। তিনি বাথরুমে গিয়ে কথা বলেন।

কথা বলা শেষে বেরিয়ে টিভি বন্ধ করে অডিও ক্যাসেট ছাড়েন। এ সময় আরও একটি ফোন আসে। এবার মুখ খোলেন সামিরা। সন্ধ্যার ঘটনা নিয়ে দু’জনের বাকবিতণ্ডা শুরু হয়। উত্তেজিত হয়ে সালমান মোবাইল ফোন সেটটি ভেঙে ফেলেন। এতে সামিরা বেশ ক্ষুব্ধ হন। ব্যাগ গুছিয়ে ধানমণ্ডি ২৭ নম্বরে ফুফুর বাসায় যাওয়ার উদ্দেশে বাসা থেকে বের হয়ে যান। সালমানের পিএ আবুলকে ইন্টারকমে কথা বলতে বলেন।

আবুল ইন্টারকমে অ্যাপার্টমেন্টের দারোয়ানকে গেট না খুলতে নিষেধ করেন। গেটে বাধা পেয়ে সামিরা আবারও ফ্ল্যাটে ফিরে আসেন। তখন সালমান তাকে সকালে ফুফুর বাড়ি পৌঁছে দেবেন বলে কথা দেন। এরপর সামিরা বেডরুমে চলে যান।

৬ সেপ্টেম্বর সকাল থেকেই ‘তুমি শুধু তুমি’ ছবির শুটিং ছিল। সেখানে উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও সালমান ঘুমাতে থাকেন। সকাল সাতটার দিকে সালমানের বাবা ছেলের ফ্ল্যাটে আসেন। সামিরা গেট খুলে দেন। সালমানের বাবা বলেন- ‘মা, ভাই ও তাকে নিয়ে সিলেটে যাবেন।’ এ সময় সিদ্দিক নামের এক প্রযোজকও আসেন। কিন্তু সালমান ঘুম থেকে না ওঠায় কিছুক্ষণ অবস্থানের পর সালমানের বাবা ও সিদ্দিক চলে যান।

এরপর সামিরা তার বেডরুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। বেলা ১১টার দিকে সালমান ঘুম থেকে উঠে কাজের মেয়েকে ডেকে পানি ও চা পান করেন। কিছুক্ষণ পর ড্রেসিংরুমে ঢুকে ভেতর থেকে দরজা লক করে দেন। ঢোকার আগে সহকারী আবুলকে বলেন- ‘আমাকে যেন কেউ ডিস্টার্ব না করে’। অনেক সময় পেরিয়ে গেলেও ড্রেসিংরুম থেকে সালমানকে বের না হতে দেখে আবুল চিন্তায় পড়ে যান। সাড়ে ১১টার দিকে সামিরাকে জাগিয়ে বলেন- অনেকক্ষণ আগে ড্রেসিংরুমে ঢুকলেও তার কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না।

সামিরা দরজার ডুপ্লিকেট চাবি খুঁজে বের করে ড্রেসিং রুমের দরজা খুলে দেখেন ফ্যানের সঙ্গে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে আছেন সালমান! সঙ্গে তখন আবুলও ছিল। তাদের ডাকে পাশের বাসার কাজের মেয়েও উপস্থিত হয়। এ সময় সামিরা ও সালমানের দুই কাজের মেয়ে সালমানকে উঁচু করে ধরেন। পাশের বাসার কাজের মেয়ে দড়ি কেটে সালমানকে নামিয়ে আনেন। দড়িটি ছিল ব্যায়ামের যন্ত্র থেকে বের করা। ধারণা করা হয়, সালমান ফ্যান পর্যন্ত ওঠেন ঘরে থাকা একটি কাঠের মই দিয়ে।

ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় থেকে সালমানকে নামানোর পর পাশের বাসার কাজের মেয়ে বলে- ‘শরীর এখনও গরম। উনি মরেননি।’ তখন মাথায় ও গায়ে তেল মালিশ করা হয়। ততক্ষণে সামিরা তার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী রুবিকেও খবর দেন। পাশেই তার বিউটি পার্লার। তিনিও চলে আসেন। রুবি এসে সালমানের শুশ্রূষায় অংশ নেন।

খবর পেয়ে হাউজিং কমপ্লেক্সের ম্যানেজারও আসেন। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে শুটিংয়ের খবর নিতে প্রডাকশন ম্যানেজার সেলিম এসে সালমান শাহকে মরার মতো পড়ে থাকতে দেখে সালমানের বাবাকে খবর দেন। খবর পেয়ে সালমানের বাবা, মা ও ছোট ভাই ছুটে আসেন ঘটনাস্থলে।

তারা গিয়ে সালমানকে হাসপাতালে দ্রুত নেয়ার প্রস্তুতি নেন। কিন্তু এ সময় লিফটের যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে আরও ১৫ মিনিট দেরি হয়। পরে হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানকার চিকিৎসকরা তাকে ভর্তি করতে অস্বীকৃতি জানালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানকার কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

মৃত্যু নিয়ে সালমানের পরিবারের অভিযোগ

সালমানের মৃত্যুর পর তার বাবা রমনা থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা করেন। পরবর্তী সময়ে তার মা সালমানের স্ত্রী, শ্বশুর, শাশুড়িসহ কয়েকজনকে আসামি করে আদালতে হত্যা মামলা করেন। সালমানের মায়ের অভিযোগ- স্ত্রী সামিরার সঙ্গে বিতর্কিত ব্যবসায়ী ও চলচ্চিত্র প্রযোজক আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের অবৈধ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। এ দুজন মিলে সালমানকে হত্যা করেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সামিরাও পালটা অভিযোগ করেন, সালমানের মা-ই আজিজ মোহাম্মদ ভাইসহ অনেক পুরুষকে তার বাড়িতে নিয়ে আসত। এটা নিয়ে সালমান ও তার বাবা নীলার ওপর বেশ ক্ষুব্ধ ছিলেন।

// Disable right-click context menu // Disable text selection // Disable dragging of images and text // Disable copy events // Disable common keyboard shortcuts for copying // Check for Ctrl/Command key combinations with C, X, S, or P