Tuesday, 11 March 2025, 07:55 AM

এক বছরে দুই সহস্রাধিক লাশ বেওয়ারিশ দাফন

ডেস্ক রিপোর্টঃ রাস্তার পাশে বৃদ্ধ নারীকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করে বনানী থানা পুলিশ। এরপর ময়নাতদন্ত শেষে লাশটি বেওয়ারিশ হিসেবে খুব দ্রুত আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পরে লাশটি জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়। এভাবে চলতি মাসের ১৯ তারিখ পর্যন্ত ঢাকাসহ সারা দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে উদ্ধার করা ১৮ জনের লাশ আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের মাধ্যমে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়। একইভাবে গত বছর দুই হাজার ১৯টি লাশ বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়েছে। রাজধানীর মুগদায় আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের কার্যালয়ে নথি ঘেঁটে গত শুক্রবার এ তথ্য জানান সেখানকার ডিউটি অফিসার মাহমুদুল হাসান।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিভিন্ন দুর্ঘটনা, অপরাধীদের অন্তঃকলহ, অন্যান্য বিরোধ, ছিনতাইকারীদের আঘাত, ট্রেনে কাটা পড়া—এসব এই মানুষগুলোর মৃত্যুর কারণ। এ ছাড়া আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধের পর অনেক লাশ বেওয়ারিশ হিসেবে আঞ্জুমানের মাধ্যমে দাফন করা হয়। অনেক সময় হত্যার পর লাশ গুম করতে নদীতে, রেললাইনসহ বিভিন্ন জায়গায় ফেলে রাখা হয়। এতে লাশগুলোর পরিচয় শনাক্ত করা যায় না। পরিবারের সদস্যদের খোঁজ পাওয়া যায় না। এসব লাশই সাধারণত বেওয়ারিশ হিসেবে আঞ্জুমানে পাঠানো হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে থানায় অপমৃত্যু মামলা দায়ের করে প্রাথমিক তদন্ত শেষে ছবি তুলে লাশ আঞ্জুমানের হাতে তুলে দেয় পুলিশ। পরিচয় শনাক্তের জন্য ওই ছবি সারা দেশের থানাগুলোতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক মনে করেন, কোনো মানুষেরই পরিচয় শনাক্ত না করে দাফন করা উচিত নয়। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, প্রতিটি মানুষেরই পরিচয় আছে। পরিবার আছে। কোনো না কোনো মা-বাবার সন্তান সে। ছোট থেকে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত সে পরিবারের সঙ্গেই থাকে। অবশ্যই পরিচয় শনাক্ত করেই প্রতিটি মানুষের দাফন হওয়া উচিত।

রিয়াজুল হক বলেন, পরিবেশ পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার কারণে নানা অপঘাতে মানুষের মৃত্যু হয়। আবার অনেকে অসুস্থ হয়েও মারা যায়। তবে কেউই অজ্ঞাতপরিচয় নয়। প্রত্যেকেরই আলাদা পরিচয়, নাম ও পরিবারের সদস্য আছে। তাই পরিচয় শনাক্ত করে এসব লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা উচিত। পাশাপাশি মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধান করতে তদন্ত করতে হবে। এ বিষয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সতর্ক হওয়া উচিত।

তিনি যোগ করেন, অনেক সময় মানুষের মাথায় সমস্যার কারণে পরিবার থেকে হারিয়ে যায়, আবার দীর্ঘদিন ধরে নিখোঁজ থাকে। পরিবারের লোকজন দীর্ঘদিন ধরে খোঁজ করে পায় না। একসময় তারা হতাশ হয়ে পড়ে। অপঘাতে নিহত কারো লাশ কোথাও থেকে উদ্ধার হলে পরিবারের জন্য খোঁজ করা কঠিন হয়ে পড়ে। এ ক্ষেত্রে পুলিশ অপমৃত্যু মামলা করে তদন্ত করতে পারে। যতক্ষণ পর্যন্ত পরিচয় শনাক্ত না হয় লাশগুলো সরকারি হিমঘরে (মরচুয়ারি) রেখে তদন্ত চলতে পারে।  তিনি বলেন, পরিচয় শনাক্ত না করে লাশ দাফন করাটা মানবাধিকার লঙ্ঘন।

উদ্ধার করা লাশ কত দিন দাফন ছাড়া মরচুয়ারিতে রাখা যাবে, দেশে তার ধরাবাঁধা কোনো নিয়ম নেই। লাশ সংরক্ষণে রাখার সমস্যার কারণে পুলিশ প্রাথমিক তদন্তের পরপরই আঞ্জুমানের মাধ্যমে দাফন করে ফেলে। মৃতদেহ রাখার জন্য সব সরকারি হাসপাতালে মরচুয়ারি নেই। ঢাকা মেডিক্যালসহ পুরনো হাসপাতালগুলোতে থাকলেও নতুন হাসপাতালগুলোতে এখনো মরচুয়ারির ব্যবস্থা নেই। এ ছাড়া আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামেও কোনো মরচুয়ারি নেই বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।

জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, লাশ উদ্ধারের পর পুলিশ তদন্ত করে অনেক সময় নাম ও পরিচয় উদ্ঘাটন করতে পারে না। পরে লাশগুলো দাফন করা ছাড়া উপায় থাকে না। এ কারণে দাফনের জন্য লাশগুলো আঞ্জুমান মুফিদুলে পাঠানো হয়। তবে প্রয়োজন ছাড়া তাড়াহুড়া করে তদন্ত করা ঠিক নয়। তদন্তের প্রয়োজন আছে। আবার বাস্তবতা হলো, লাশগুলো সংরক্ষণে রাখারও পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। যেগুলো আছে সেখানে এসব লাশ রাখতেও অনেক খরচ হয়।

আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম সূত্র জানায়, আঞ্জুমানে লাশ সংরক্ষণের জন্য কোনো মরচুয়ারি নেই। অবশ্যই আঞ্জুমানেও মরচুয়ারি থাকা উচিত। দেখা গেছে, লাশ আঞ্জুমান কর্তৃক দাফন করার পর অনেকে এসে নিহতের ছবি দেখে স্বজনের লাশ শনাক্ত করে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বছর বেওয়ারিশ হিসেবে দুই হাজার ১৯টি লাশ আঞ্জুমানের মাধ্যমে দাফন করা হয়েছে। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ৫৫, ফেব্রুয়ারিতে ৬০, মার্চে ১৮১, এপ্রিলে ৬৮, মার্চে ১১৯, জুনে ৪৭, জুলাইয়ে ৯২, আগস্টে ৭৪, সেপ্টেম্বরে ৪৯, অক্টোবরে ৮১, নভেম্বরে ৭৫ এবং ডিসেম্বরে ১১৮টি লাশ বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়। আর চলতি বছরের গতকাল শনিবার পর্যন্ত ১৮টি লাশ বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়।

বনানীর ওই বৃদ্ধার লাশ উদ্ধারের বিষয়ে জানতে চাইলে বনানী ধানার এসআই শাহীন মিয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, তিন দিন খোঁজ করেও ওই বৃদ্ধার স্বজনদের পাওয়া যায়নি। লাশের ফিঙ্গারপ্রিন্ট পরীক্ষা করে দেখা গেছে, জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যভাণ্ডারেও তাঁর নাম নেই। এরপর লাশটি দাফনের জন্য আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামে পাঠানো হয়।

কেন আরো তদন্ত করে তাঁর পরিচয় শনাক্তের চেষ্টা করা হয়নি জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রাথমিক তদন্তে মনে হয়েছে, ওই নারী ভিখারি ছিলেন। শীতের কারণে তাঁর মৃত্যু হতে পারে। তিন দিনের তদন্তে এর চেয়ে বাড়তি কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। ভিখারির টাকা ছিনিয়ে নিতে কেউ শ্বাস রোধ করে তাঁকে হত্যা করেছে কি না এ রকম সন্দেহে তদন্ত হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাঁর শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। এ কারণে হত্যার বিষয়টি তদন্তে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।

এই বৃদ্ধার লাশ উদ্ধারের এক সপ্তাহ আগে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের দরগাবাড়ী কবরস্থানের পাশ থেকে এক যুবকের লাশ উদ্ধার হয়। লাশটি মিটফোর্ড মেডিক্যাল কলেজ মর্গে পাঠায় পুলিশ। দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার এসআই বছির উদ্দিন লাশটি উদ্ধার করেছিলেন। তিনি বলেন, তাঁকে ছুরি মেরে হত্যা করা হয়েছে। তাঁর পরিচয় পাওয়া যায়নি। পরিবারের লোকজনও তাঁর খবর নেয়নি। তদন্তে পরিচয় শনাক্ত করতে না পেরে লাশটি আঞ্জুমান মুফিদুলে পাঠানো হয়েছে।

গত ১২ দিনে কারওয়ান বাজার ও কুড়িল বিশ্বরোডসহ আরো কয়েকটি এলাকা থেকে মোট ১০টি লাশ উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে হাত, পা ও মাথা বিচ্ছিন্ন অবস্থায় একটি দেহ উদ্ধার হয়। এর মধ্যে দুটি লাশের পরিচয় শনাক্ত না হওয়ায় আঞ্জুমানে পাঠানো হয়।

এ ছাড়া সম্প্রতি বুড়িগঙ্গা নদীর ফরাশগঞ্জ ঘাট ও নৌ পুলিশের ফাঁড়িসংলগ্ন পানিতে ভাসমান অবস্থায় দুটি লাশ উদ্ধার হয়। তাদের মধ্যে একজনের মাথায় জখমের দাগ পায় পুলিশ। এর একটি লাশ আঞ্জুমানে পাঠানো হয়। এর আগে গত ১ জানুয়ারি কেরানীগঞ্জের লাকরিচর এলাকার তুলসীখালী সেতুর কাছে ধলেশ্বরী নদীতে বস্তাবন্দি অবস্থায় একটি লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তার পরিচয় শনাক্ত হয়নি, হত্যার কারণও উদ্ঘাটন করতে না পেরে লাশ আঞ্জুমানে পাঠায় পুলিশ।

আঞ্জুমান মুফিদুলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বেওয়ারিশ লাশ দাফনের আগে তার ছবি তুলে রাখা হয়। প্রতিদিনই কেউ না কেউ এসে স্বজনদের খোঁজ করে। তবে বিকৃত লাশ দেখে বেশির ভাগই শনাক্ত করতে পারে না। আবার কিছু লাশ ছবি দেখে শনাক্ত হয়। এ ক্ষেত্রে তারা যদি লাশ নিতে চায় তবে সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশের কাছে তাদের পাঠানো হয়। আইনগতভাবে পুলিশের মাধ্যমে কবর থেকে লাশ উঠিয়ে হস্তান্তর করা হয়।

K/K/N.

// Disable right-click context menu // Disable text selection // Disable dragging of images and text // Disable copy events // Disable common keyboard shortcuts for copying // Check for Ctrl/Command key combinations with C, X, S, or P