Sunday, 09 March 2025, 09:02 PM

জাতীয় অংশগ্রহণ ছাড়া জাতীয় বিপদ আমরা কীভাবে সামলাব

দেশের দারিদ্র্য পরিস্থিতি নিয়ে সরকারি-বেসরকারি তরফ থেকে কিছু অনুমান করা এখন দুঃসাধ্য। মহামারির দ্বিতীয় ঢেউয়ের পর পুরোনো পরিসংখ্যান অর্থহীন হয়ে গেছে। গবেষণা সংস্থা ‘সানেম’ নভেম্বর-ডিসেম্বরে জরিপ করে জানিয়েছিল দেশে দারিদ্র্য হার এখন ৪২ শতাংশ। করোনার আগে যা ছিল ২০-২২ ভাগ। আর দ্বিতীয় ঢেউয়ের পর এখন সেটা কোথায় পৌঁছেছে আমরা জানি না। যদি ৫০ ভাগও হয় এবং জনসংখ্যা যদি ১৬ কোটিও ধরি, তাহলে দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা এখন আট কোটি। মুক্তিযুদ্ধের সময়কার পুরো জনসংখ্যার চেয়েও এটা বেশি। ‘কঠোর লকডাউন’-এ এই দরিদ্ররা বিপদে আছে। ভবিষ্যৎ তাদের আরও বিপন্ন। প্রথম ঢেউয়ের সময়কার সহানুভূতিও এবার সমাজে নেই। কারণ, সহানুভূতির ঐতিহাসিক কোষাগার মধ্যবিত্ত নিজেই এবার সংকটে আছে।

বিপুল নতুন দরিদ্র
মহামারির দ্বিতীয় ছোবল নিয়ে বাংলাদেশে এখন মাতম চলছে। কিন্তু মৃত্যু ও সংক্রমণের তথ্য ছাড়া সমাজ-অর্থনীতি নিয়ে হালনাগাদ উপাত্ত নেই কোথাও। করোনার আগে যারা দারিদ্র্যসীমার সামান্য ওপরে ছিল, তারাই মূলত এখনকার ‘নতুন দরিদ্র’।

দেশে মাত্র ১৪-১৫ মাসে এ রকম প্রায় পৌনে ৫ কোটি নতুন দরিদ্র তৈরি হয়েছে। প্রতি বর্গমাইলে এই সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে প্রায় ৮-৯ শ। শহরাঞ্চলে এই সংখ্যা অনেক বেশি। গ্রামে তুলনামূলকভাবে কম। এপ্রিল-মেতে ধান কাটা ছাড়া শ্রমজীবীদের আর তেমন কোনো কাজের সুযোগও নেই। যানবাহন বন্ধ থাকায় ধান কাটার জন্যও যাতায়াত করা যাচ্ছে না।

করোনার দুই ঢেউয়ে কৃষি ছাড়া সেবা ও শিল্প খাতের সবদিকই কমবেশি বিপর্যস্ত। কৃষিতে মারির আঁচড় কম লাগলেও কৃষি এখন অর্থনীতির ১৫-২০ শতাংশ মাত্র। তা ছাড়া শহরাঞ্চলে চাহিদা পড়তির দিকে থাকায় গ্রামীণ কৃষিপণ্যে লোকসানের শঙ্কা বাড়ছে। হাঁস-মুরগি-দুধের খামারিরা ইতিমধ্যে এই অবস্থার করুণ শিকার হয়ে গেছে।

দরিদ্ররা কী নিয়ে ঈদে শামিল হবে
বাংলাদেশে খরচপাতির বড় দুটি উপলক্ষ বৈশাখ ও ঈদুল ফিতর। গত বছর এই দুই উপলক্ষই ব্যবসা শূন্য গেছে। এবারও সেই অবস্থা। এক-দুই মাসের মধ্যে চলে আসবে বর্ষা। বর্ষা মানেই কিছু কিছু অঞ্চলে বন্যা। সব মিলে সামনে ভালো কোনো চিত্র আশা করা কঠিন। অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানো ছাড়া প্রতি বর্গমাইলের ৮-৯ শ নতুন দরিদ্র এবং ৫০০ পুরোনো দরিদ্রের সহসা ভাগ্য পরিবর্তনের কোনো সুযোগ নেই। এদের সামনে এখন বাঁচা-মরার প্রশ্ন। এ রকম মানুষদের বিত্ত নগণ্য, সঞ্চয় সামান্য। করোনাকাল যত দীর্ঘ হবে, লকডাউন যত বাড়বে; এদের কান্নার শব্দও তত ক্ষীণ হয়ে যাবে।

রাজনীতিহীন অবস্থা আর ডিজিটাল আইনে অর্ধমৃত প্রচারমাধ্যমের কারণে এ মুহূর্তে বাংলাদেশ তার এই অভুক্ত-অন্তর্ভুক্ত মানুষদের হালনাগাদ অবস্থা জানতে পারছে সামান্যই। অবাধ তথ্যপ্রবাহের অনুপস্থিতি আমাদের বাড়তি দুর্যোগের দিকে নিয়ে যাচ্ছে কি না, এ বিষয়ে ভাবাটাও জরুরি। আপাতত রোজা পেরিয়ে বাংলাদেশ এমন এক ঈদের দিকে এগোচ্ছে, যখন আট কোটি থালায় খাবারের নিশ্চয়তা নেই।

কেউ মরবে আর কেউ পুরোনো অঙ্কেই মুনাফা করবে, তা হবে না
করোনার প্রথম ঢেউয়ের পর প্রায় ৩৫ লাখ দরিদ্রকে আড়াই হাজার টাকা করে দিয়েছিল সরকার। দ্বিতীয় ঢেউয়ের পরও অনুরূপ একটা উদ্যোগের কথা শোনা যাচ্ছে। এ মুহূর্তে ৩৫ লাখ মোট দরিদ্রের ৫ ভাগ মাত্র হবে। কত দিন কঠোর লকডাউন চলবে অনুমান করা যাচ্ছে না, এই আড়াই হাজার টাকা কত দিনের জন্য দেওয়া হবে, তা–ও অস্পষ্ট।

যদি এই ৩৫ লাখ মানুষ সমসংখ্যক পরিবার থেকে বাছাই হয় এবং তাদের যদি দুসপ্তাহের জন্য এই সাহায্য দেওয়া হয়, তাহলে চারজনের পরিবারে মাথাপিছু দৈনিক বরাদ্দ ৪৫ টাকা। কেবল চালের কেজিই এরই মধ্যে ৫০ ছুঁয়েছে এবং প্রতিদিন সেটা বাড়ছে। কাজ না থাকলে, কাজ করে আয়ের সুযোগ না পেলে এবং বাজার এভাবে ঊর্ধ্বমুখী থাকলে এই দরিদ্র এবং বাকি দরিদ্রের অবস্থা কী দাঁড়াচ্ছে, কল্পনা করা কঠিন নয়। এ রকম অনেকেই আয়রোজগারের একমাত্র উৎস হারিয়ে এখন নগদ অর্থশূন্য অবস্থায় আছে। বড় অংশই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের মানুষ। করোনা চলে যাচ্ছে ভেবে অনেকে ধারকর্জ করে ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে নতুন করে কাজে নেমেছিল। দ্বিতীয় ঢেউয়ে নতুন করে এদের পক্ষে ধারকর্জের জায়গা খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়।

এ রকম মানুষদের এখনই সপ্তাহ ভিত্তিতে অন্তত এক মাস নগদ অর্থ এবং চাল-ডালসহ অতি জরুরি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের সহায়তা দরকার। সহায়তার টার্গেটও ৩৫ লাখ থেকে বাড়ানো অপরিহার্য। সরকারই মুখ্যত এ সহায়তা দিতে পারে। শহরাঞ্চলে এ রকম গরিবদের জন্য কয়েক মাসের বাড়িভাড়া আংশিক হলেও মওকুফ করা যায় কি না, সেটাও ভাবা দরকার। জাতীয় বিপন্নতার কালে বাড়ির মালিকদের ২-১ মাসের জন্য এ রকম ত্যাগ স্বীকারের জন্য সরকারের দিক থেকে আহ্বান ও সিদ্ধান্ত আসতে পারে।

তিতাস গ্যাস, ওয়াসা ও বিদ্যুৎ বিভাগও তাদের বিল আদায়ে গ্রাহককে ৪ থেকে ৬ মাসের কিছু সময়-ছাড় দিতে পারে। না হলে খুদে ব্যবসায়ী ও মধ্যবিত্তের নিচুতলার যারা এখনো দারিদ্র্যসীমা পেরোয়নি, তাদের সেদিকেই ঠেলে দেওয়া হবে। মোবাইল ফোন কোম্পানি এবং অর্থ লেনদেনে যুক্ত ব্যাংকগুলোকেও কিছুদিনের জন্য ফি কমানোর অনুরোধ করা জরুরি। এভাবে জাতীয় অংশগ্রহণ ছাড়া জাতীয় সর্বনাশ আমরা কীভাবে সামাল দেব? কেউ মরবে আর কেউ পুরোনো অঙ্কে মুনাফা চালিয়ে যাবে, তা অমানবিক। সরকারকে এ রকম সবার কাছে মানবিক আবেদন রাখতেই হবে।

অর্থনীতি চালু করতে খাতভিত্তিক কমিউনিটি হাসপাতাল দরকার
মহামারির সঙ্গে যুদ্ধ করে অর্থনীতি পরিচালনা করতে গিয়ে সরকারও এ মুহূর্তে সম্পদ সংগ্রহ এবং বণ্টনের টানাপোড়েনে আছে বলে অনুমান করা যায়। সময়ের প্রয়োজনে দেশকে জিডিপিমুখী উন্নয়ন চিন্তার আদল থেকে মানুষ বাঁচানোর মডেলের দিকে যেতে হবে। কোটি কোটি দরিদ্রকে ঘরে বসিয়ে দীর্ঘ সময় সহায়তা দিয়ে যেতে পারবে না সরকার। বিকল্প অর্থনীতি চালু করাই উত্তম। কিন্তু মহামারিতে যে শরীরী সতর্কতা দরকার, সে রকম মনোভাব সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মাঝে জোরদার না করে সরকার লকডাউন তুলতেও পারবে না। সে জন্য দরকার সংক্রমণ কমানোর কার্যকর উপায় খুঁজে বের করা।

এ ক্ষেত্রে একমাত্র পথ ‘কমিউনিটি’কে কাজে নামানো। প্রশাসনিক ফরমান দিলেই মানুষ মানতে শুরু করবে না। এলাকায় এলাকায় তাদের সেই ফরমানের সঙ্গে একাত্ম করতে পারে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব, শিক্ষক, ইমাম, ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠক প্রমুখ। শত শত বছর ধরে সমাজ এদের কথা শুনে আসছে। এলাকায় এলাকায় এ রকম নেতৃবৃন্দকে সংক্রমণ কমিয়ে আনার টার্গেট বেঁধে দিয়ে সামান্য কিছুদিনের লকডাউন দিলেই দেশের সংক্রমণ পরিস্থিতির প্রত্যাশিত পরিবর্তন ঘটতে পারে।

সংক্রমণ কমিয়ে আনতে রাজনৈতিক পরিচয় নির্বিশেষে কমিউনিটিকে কাছে টানার এখনই শেষ লগ্ন। কিছু কিছু শক্তিশালী আর্থিক খাতকে ফিল্ড হাসপাতাল গড়ার দায়িত্বও নিতে হবে। ব্যাংকগুলো অনায়াসে কর্মীদের প্রতি দায়িত্বশীলতার অংশ হিসেবে বিভাগ পর্যায়ে অন্তত একটা করে হাসপাতাল খুলতে পারে।

একই কাজ জরুরি পোশাক মালিকেরাও করতে পারে। তারা তো কারখানা খোলা রাখতে আগ্রহী। হাসপাতাল তৈরি করে তারা একই সঙ্গে সরকার ও কর্মীদের মাঝে দ্বিমুখী আস্থা সৃষ্টি করতে পারে। বিজিইএমইএর পক্ষে কয়েকটি ফিল্ড হাসপাতাল করা আর্থিক দিক থেকে বড় চ্যালেঞ্জ নয়।

খাতভিত্তিক ফিল্ড-হাসপাতাল হলে নিজ নিজ খাতের কর্মীদের নিয়মিত চেকআপ ও তাৎক্ষণিক চিকিৎসা নিশ্চিত হবে। এভাবেই কেবল দ্রুত অর্থনীতি চালু করা সম্ভব। পূর্ণ মাত্রায় অর্থনীতি চালু করা ছাড়া দারিদ্র্য, ক্ষুধা এবং সামাজিক অস্থিরতা রোখা সম্ভব হবে না। পরিস্থিতি বিপদ রেখা অতিক্রম করবে। ৫৬ হাজার বর্গমাইলে দারিদ্র্য সংখ্যা হিসাবে আট কোটি অনেক বড়।

আলতাফ পারভেজ গবেষক

// Disable right-click context menu // Disable text selection // Disable dragging of images and text // Disable copy events // Disable common keyboard shortcuts for copying // Check for Ctrl/Command key combinations with C, X, S, or P