Sunday, 22 December 2024, 08:59 AM

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০ হাজার শিক্ষার্থীর আর্তি শুনুন

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ই (জবি) দেশের একমাত্র পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে শিক্ষার্থীদের আবাসিক কোনো ব্যবস্থা নেই। প্রতিষ্ঠার ১০ বছর পেরিয়ে ১১ বছরে পা রাখলেও ভালো না লাগা, স্বতন্ত্র এবং অসঙ্গতিপূর্ণ ‘আবাসিক হল না থাকার’ উপমাটি বিশ্ববিদ্যালয়টি এখনও দূর করতে পারেনি। ‘অনাবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়’ বিশেষণটি এখন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০ হাজার শিক্ষার্থীর গলার কাঁটা হয়ে উঠেছে। শিক্ষার্থীরা দিনের পর দিন হলের স্বপ্ন বুনে গেলেও তা অধরাই থেকে যাচ্ছে।

একদিন আমিও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে আবাসিক হলের স্বপ্ন দেখতাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির পর থেকেই শুনেছি হলের নানা আশ্বাস। এক/দুই বছরের মধ্যে হল হবে, এই হলের কাজ শুরু হয়েছে, হল উদ্ধার হয়েছে, নতুন হল বুঝি হয়েই গেল- এমন আশার কথা শিক্ষার্থী জীবনে প্রতিনিয়ত শুনেছি। কথাগুলো শুনতে খুব ভালো লাগত, মনে আশার সঞ্চার হত, হতাশা কেটে যেত, অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মতোই পরিবেশ পাবো- এমন কত আশা-প্রত্যাশাই না মনে স্থান করে নিত। কিন্তু বাস্তবতা হলো শিক্ষার্থী জীবন শেষ করে আমি এখন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষক, তবুও হলের দেখা মেলেনি।

আমার বিশ্বাস আজ যারা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, তাদের মনেও এমন স্বপ্ন বাসা বাঁধাটাই স্বাভাবিক। তাহলে কি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০ হাজার শিক্ষার্থী কেবল বছরের পর বছর অনাবাসিক হলের স্বপ্ন দেখে যাবেন? তাদের স্বপ্ন কি কখনো ডানা মেলবে না? তারা কী মেসের বাসিন্দা হিসেবেই উচ্চ শিক্ষার সময়কাল অতিবাহিত করবেন? হল জীবনের স্বাদ থেকে তারা কি আজীবনই বঞ্চিত থাকবেন? তারা কি মেধাবী নয়, তারা কি ভর্তি যুদ্ধে নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়নি। এখানকার শিক্ষার্থীরা কি দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখছেন না। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কি মানবসম্পদ তৈরি করছে না। তাহলে এই বৈষম্য কেন? এমন নানা প্রশ্ন আজ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মনে উঁকি দিচ্ছে। কিন্তু মিলছে না উত্তর।

তবে আজ সময় এবং সুযোগ এসেছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই অসঙ্গতি কাটিয়ে উঠার। ‘হল না থাকার’ উপাধিটি মুছে ফেলার। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়েরও আবাসিক হল থাকবে- এ জন্য চাই বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০ হাজার শিক্ষার্থীর প্রতি একটু সহানুভুতি, সাহায্য-সহযোগিতা। এতে পরিপূর্ণভাবে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের হল জীবনের তৃপ্তি মিটবে এবং নানা সুবিধা ভোগ করবেন শিক্ষার্থীরা। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০ হাজার শিক্ষার্থীদের চিরদিনের স্বপ্ন পূরণের হাতছানি দিচ্ছে নাজিমউদ্দিন রোডের পুরোনো ‘ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার’ এর জায়গা।

আবাসিক হলের সমস্যা সমাধানে অনেকটাই পথ দেখাতে পারে পুরনো কারাগারটি। চকবাজারের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার কেরানীগঞ্জে স্থানান্তরিত হওয়ায় খালি জায়গায় হল নির্মাণের স্বপ্ন দেখছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) শিক্ষার্থীরা। সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন থেকে চিঠিও পাঠানো হয়। তবে চিঠির কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। সম্প্রতি ওই জায়গায় জাদুঘর ও পার্ক করা হবে- এমন খবর ঘোষণার পর আবার আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা।

এদিকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান বলেছেন, ‘‘পুরান ঢাকায় হল করার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা নেই। কেন্দ্রীয় কারাগারের জায়গা খালি হওয়ায় সেখানে হল তৈরির স্বপ্ন দেখছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। এজন্য কিছু জমি চেয়ে সরকারের কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে এক বছরের বেশি সময় আগে। কিন্তু কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।’’

শিক্ষার্থীদের আবাসন সমস্যা নিরসনে নাজিমউদ্দিন রোডের পুরোনো ‘ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার’-এর খালি জমি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে (জবি) চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত দেয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় একাডেমিক কাউন্সিল সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। ৮ আগস্ট জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৮-তম জরুরি একাডেমিক সভা উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান-এর সভাপতিত্বে তাঁর সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলের সদস্যবৃন্দ শিক্ষার্থীদের ও প্রতিষ্ঠানের বৃহত্তর স্বার্থ বিবেচনায় শিক্ষার্থীদের আবাসিক সমস্যা সমাধানকল্পে নাজিমউদ্দিন রোডস্থ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার স্থানান্তরের পর উক্ত ভূমি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়-এর অনুকূলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় একাডেমিক কাউন্সিল সরকারের নিকট আহ্বান জানান। একই সাথে একাডেমিক কাউন্সিলের সদস্যবৃন্দ ছাত্র-ছাত্রীদের তাদের স্বাভাবিক শিক্ষাকার্যক্রম ব্যাহত হয় এরকম কর্মসূচি থেকে সরে আসার আহ্বান  জানান।

প্রস্তাবিত ভূমি পাওয়া গেলে সেখানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং জাতীয় চার নেতার নামে জাদুঘর, গবেষণাকেন্দ্র, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র এবং আবাসিক হল নির্মাণ করা হবে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় জাতীয় নেতৃবৃন্দের জন্ম-মৃত্যু দিবস পালনসহ তাঁদের স্মৃতি রক্ষার্থে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করবে। এ কাজটি অন্য যেকোন প্রতিষ্ঠানের চেয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ই ভালোভাবে করার সক্ষমতা রাখে বলে একাডেমিক কাউন্সিল মনে করে।

জগন্নাথ বিশ্বাবিদ্যালয়ের সঙ্গে মিশে আছে ড. দীনেশ চন্দ্র সেন,  আতাউর রহমান খান, ড. আনিসুজ্জামান, শাহরিয়ার কবির, শেখ ফজলুল হক মনি, ব্রজেন দাশ, কাজী ফিরোজ রশীদ, ডা. মোস্তফা জালাল মুহিউদ্দিন (সাংসদ), মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, নজরুল ইসলাম বাবু (সাংসদ), আলী ইমাম, প্রবীর মিত্র, এটিএম শামসুজ্জামান, ফকির আলমগীরসহ দেশে-বিদেশে বিখ্যাত অনেকের নানা স্মৃতি।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যমান আবাসন সমস্যা সমাধানের জন্য পুরনো ঢাকায় পর্যাপ্ত কোনো জায়গাও নেই। দখলকৃত হলের কয়েকটি উদ্ধার করা হলেও সেগুলোতে শিক্ষার্থীদের অবস্থান করার মতো পরিবেশ নেই। কাজেই নতুন হল নির্মাণ ছাড়া আর কোনো পথ দেখা যাচ্ছে না। আর একটি বিষয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এতো সংখ্যক শিক্ষার্থীর আবাসিক হলের ব্যবস্থা তাৎক্ষণিকভাবে করতেও পারবে না। আবাসিক হল নির্মাণের দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে। কাজেই শিক্ষার্থীরা পুরনো কারাগারের জায়গার যে দাবি তুলেছে, তা সরকারকে বিবেচনা করতে হবে। সরকারের উচিত হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট সমস্যা সমাধানে সঠিক পথ বের করা। সেক্ষেত্রে পুরনো কারাগারের জায়গা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে দেয়া সম্ভব হলে, তাতে কোনো কার্পণ্য দেখানো উচিত নয়। কারণ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসন সমস্যা দূর করার জন্য পুরনো কারাগারের জায়গাটিই হতে পারে একটি মাইলফলক। আর যদি নিতান্তই কারাগারের জায়গা দেয়া সম্ভব না হয় তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সমস্যা সমাধানের অন্য কোনো ব্যবস্থা সরকারকে গ্রহণ করতে হবে।

শিক্ষা খাতে এই সরকারের অবদান আকাশচুম্বী। যথাযথ শিক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে এই সরকার দিনরাত কাজ করে যাচ্ছে। শিক্ষাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে সমাধান করছে শিক্ষকদের সমস্যাসহ নানা সংকট। কাজেই বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ সর্বাগ্রে বিবেচনা করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে পুরনো কারাগারের জমি প্রদানের জন্য সরকার সকল করণীয় ঠিক করবে। এজন্য সকল বাধা অন্তরায় পেরিয়ে সর্বোচ্চ উদার মনমানসিকতার পরিচয় দিয়ে প্রধানমন্ত্রী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০ হাজার শিক্ষার্থীকে আবাসিক হলের সুবিধার সাথে যুক্ত করবেন- এমনটিই প্রত্যাশা।
লেখক : প্রভাষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়