ইসলামিক স্টেট খিলাফত রাষ্ট্র গঠন করতে চায়, তারা চায় তাদের মতাদর্শের বাইরের সবাইকে ধ্বংস করে দিতে। সিরিয়া থেকে ইরাক, ইরাক থেকে লিবিয়া, এখন সেসব দেশ থেকে বাংলাদেশে ঘাঁটি গাড়তে চায় তারা। আইএস মনে করে বাংলাদেশ ভৌগলিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় অবস্থিত। এখান থেকে তারা ভারত উপমহাদেশ দখল করবে, দখল করবে মধ্য এশিয়া। উত্তর আফ্রিকা ও ইউরোপের কিছু অংশ দখলের পরিকল্পনাও আছে তাদের। দখলকৃত অঞ্চলের নামকরণও করে ফেলেছে তারা! ভারতীয় উপমহাদেশের নাম তারা দিয়েছে ‘খুরাসার’। আর স্পেন, পর্তুগাল ও ফ্রান্সের একসঙ্গে নাম দিয়েছে ‘আন্দালুস’।
আইএসের এই যে পরিকল্পনা সেটাকে আপনি এক কথায় বলতে পারেন ‘ইউটোপিয়া’ অথবা ‘বোকার স্বর্গ’। কেন বোকার স্বর্গ সেটা বলছি। পৃথিবীতে বর্তমানে লোকসংখ্যা হবে সাতশ কোটির ওপরে। মার্কিন গবেষণা সংস্থ্যা পিউ রিসার্চ অনুযায়ী ২০১০ সালে পৃথিবীতে লোকসংখ্যা ছিল ৬৮০ কোটি। আর সেসময় মুসলমানের সংখ্যা ছিল ১৫৭ কোটি। দুনিয়ার মোট জনসংখ্যার প্রায় ২৩ শতাংশ মুসলমান। এদের ২০ শতাংশেরই বসবাস এশিয়ায়। এখন সকল মুসলমান কি আইএসের অনুসারী? বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তে, যারা শিয়া, তারা? যারা সুফীপন্থী তারা? এমনকি যারা সুন্নি, তাদেরও তো আইএসের খিলাফতে ঈমান নাই। তাহলে কিসের বলে এত হুমকি দিয়ে যাচ্ছে আইএস? সারা দুনিয়ায় আইএসের যোদ্ধা হবে কুড়ি থেকে ত্রিশ হাজার। এসব যোদ্ধা আর বলতে পারেন চোরাই তেল বিক্রি ও তাদের অধ্যুষিত এলাকার ব্যাংক ও জনগণের লুটপাটের বিপুল অর্থের জোড়েই তারা হম্বিতম্বি করছে। অবশ্য তাদের কাঁধে বন্দুক রেখে মদতদাতা ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র যে ফায়দা লুটছে সেই অভিযোগ এরই মধ্যে পুরনো হয়েছে।
সম্প্রতি (গত ৫ জুলাই) যুদ্ধ বিধ্বস্ত সিরিয়ার রাকা থেকে তিন বাংলাদেশি তরুণ হুমকি দিয়েছে ১ জুলাই গুলশানে যেমন নৃশংস হামলা চালানো হয়েছে, সেরকম হামলা না কী আরও চালানো হবে। বেশ জোরের সঙ্গেই বলে, গণতন্ত্রকে উড়িয়ে দিয়ে তারা এই অঞ্চলে তাদের ইসলাম, তাদের শরিয়া আইন প্রতিষ্ঠা করবে। কিন্তু তারা কি ভুলে যাচ্ছে শুধু ইসলাম কেন- অন্য যে কোন ধর্ম ও ভাষা- অঞ্চল ভেদে বদলে যায়। বদলে যেতে বাধ্য। তারমানে এই আইএস জঙ্গিরা নৃবিদ্যাটাও ভালো করে জানে না, ধর্ম তো নয়ই। নিজেদের ধর্মটাও যদি ভালো করে জানতো তাহলে ভালোবাসা দিয়ে অন্যের মন জয় করার চেষ্টা করতো, এভাবে মানুষের গলা কেটে, ফতোয়া দিয়ে নারীদের ধর্ষণ করে ধর্মকে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতো না। তারা যে অজ্ঞ সেটা আর কারও অজানা নয়, এক ধরনের কূপমণ্ডুক হয়ে তারা বিশ্ব জয় করতে চায়। ‘বোকার স্বর্গ’টি তারা এমন পন্থায় অর্জন করতে চায়, যা হিটলারের আকাঙ্ক্ষার চেয়েও ভয়াবহ। তাই বলা যায়, আইএস শুদ্ধ ফ্যাসিবাদীই নয়, একই সঙ্গে তারা বর্বর, অমানবিক ও বোকা।
বাংলার মাটিতে যে ইসলাম আছে, সে ইসলাম কখনও গলাকাটার ইসলাম নয়। ১৯৭১ সালে এদেশের কিছু মানুষ পাকিস্তানের বিভাজনকে ‘ইসলামের বিভাজন’ এমন ধোয়া তুলে লুণ্ঠন, খুন ও ধর্ষণ করেছে। সেসব আলবদর, আলশামস, রাজাকারদের এদেশের মানুষ ক্ষমা করেনি। শুধু ক্ষমা নয়, এদেশের মানুষ তাদের ঘৃণা করেছে প্রাণ থেকে। ভুলে গেলে চলবে না পাকিস্তানের সুসজ্জিত ও প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে এদেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই এখনও জীবিত ও সক্রিয়। এদেশের মানুষ অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিয়ে, শোষনহীন দেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে, শুধু মনের জোরকে সম্বল করে ওরকম একটি প্রশিক্ষিত বাহিনী ও দেশীয় কিছু দোসরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছিল। এবং জয়লাভ করেছিল।
এটা একাত্তর নয়। তারপরও এসব কথা বলার কারণ এদেশের মানুষের চরিত্রকে বোঝানো। আর তথাকথিত গুটি কয়েক আইএস, যারা কয়েক মাসের প্রশিক্ষণ নিয়ে এখানে চোরের মতো, কাপুরুষের মতো লুকিয়ে চুরিয়ে নিরীহ, নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করে, পেটের শিশুকে পর্যন্ত রেহাই দেয় না, তাদের বিরুদ্ধে যদি একাত্তরের মতো মানুষ জেগে ওঠে, তাহলে এসব আইএস ভেসে যাবে খরকূটোর মতো। শহুরে মানুষ যারা ফেসবুক ব্যবহার করতে পারেন তারাই বিষয়টিকে হয় তো অনেক বড় করে দেখছেন। ভুলে যাবেন না, শহুরে ফেসবুক ব্যবহারকারী ছাড়াও এদেশে কৃষক, শ্রমিক, ক্ষেতমজুরসহ নানা শ্রেণি পেশার সাধারণ মানুষ আছে। তারাই সংখ্যায় ৯৯ ভাগ। আছে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা এক বিশাল সংখ্যক শিক্ষার্থী, তারা এখনও অসাম্প্রদায়িকতার চর্চা করেন, তাদের মূলবোধ এখনও বিকৃত ও বিক্রিত হয়নি। তারা রাজনীতি সচেতন। কাজেই সামান্য এসব আইএস উড়ে এসে জুড়ে বসার মতো অভিনয় করলেই সেটাকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
বাংলাদেশে এখনও মানুষ নদীর বুকে নৌকা চালাতে চালাতে ভাটিয়ালি গান গায়, এখানকার মানুষ ভাওয়াইয়া গানকেও ভুলে যায়নি। মানুষ জারি, সারি, মুর্শীদি অথবা লালনগীতিকে জলাঞ্জলি দেয়নি। এদেশের মানুষ এখনও নানা উৎসব পার্বনে উজ্জীবিত হয়ে ওঠে গানের সুরে। ঈদের আগে চাঁদরাতে বিদ্রোহী নজরুলই তাদের উৎসবের আগমনী ধ্বনি। পয়লা বৈশাখ অথবা বসন্ত উৎসবে মানুষের ঠোঁটে থাকেন রবীন্দ্রনাথ। আইএস এসব আনন্দ উদযাপনকে যতই ইসলাম বিরুদ্ধ বলুক না কেন, এই ভূখণ্ডের মানুষ সহজে মাথা নোয়াবার পাত্র নয়। আইএস ঈদের জামাতকে ইসলামের বাইরের সংস্কৃতি বলে মনে করে। তাই তো এই আইএস ভাবাদর্শের অনুসারীরা ঈদের দিন, ৭ জুলাই, কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় নামাজ চলাকালে বোমা হামলা চালিয়ে মানুষ খুন করে। মদিনার কাবা শরীফকেও আইএস বলছে অনৈসলামিক, কারণ সেটা নাকি এখন মাজারে পরিণত হয়েছে! সেজন্য সেখানেও আইএস বোমা মেরে মানুষ খুন করেছে। তো এসব করলেই কি মানুষ দীর্ঘদিন ধরে যা হৃদয় দিয়ে পালন করে আসছে সেটা করা ছেড়ে দিবে? সৌদি আরবের মানুষ সেহরি, ইফতারিতে যা খায়, বাংলাদেশ বা ইন্দোনেশিয়ার মানুষ কি তা খায়? খায় না। তাই আপনি চাইলেও এক জায়গার দর্শন অন্য জায়গায় হুবহু গেলাতে পারবেন না। সাধারণ এই বিষয়টি আইএসের তথাকথিত যোদ্ধারা বুঝতে চাইছে না, তারা তাদের প্রবর্তিত ইসলামকে চাপাতে চাইছে সকলের ওপর। এটা ফ্যাসিবাদী আচরণ। ফ্যাসিবাদ গণতন্ত্রকে, জনগণের শক্তিকে পছন্দ করবে না সেটাই তো স্বাভাবিক। তো এমন মৌলবাদী আইএস বাংলাদেশের তরুণদের কি করে আকৃষ্ট করছে?
আগে ধারণা ছিল মাদ্রাসার ছাত্র, যারা দরিদ্র, যারা সার্বক্ষণিক ধর্মীয় আবহে থাকে, তাদেরকে সহজেই দলে টানা যায়, বিশেষ করে আইএসের মতো চরমপন্থী দলগুলোতে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে অবস্থা সম্পন্ন, ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকেও অনেক তরুণ যোগ দিচ্ছে আইএসে। এই বৈপরীত্যে অনেকেই অবাক হচ্ছেন। আমি অবাক হওয়ার কিছু দেখছি না। কারণ একটু মনোযোগ দিলে আপনিও লক্ষ্য করবেন মাদ্রাসা ও ইংরেজি মাধ্যম, দুই রকম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই যারা পড়ছেন তারা দেশীয় সংস্কৃতি থেকে একটু দূরে থাকছেন, শুধু তাই নয়, নিজেদের মাতৃভাষা বাংলা থেকেও তারা দূরে অবস্থান করছেন।
মাদ্রাসায় জোর দেওয়া হয় আরবি ভাষার ওপর। পত্রিকার সংবাদে দেখা গেছে অনেক বেসরকারি মাদ্রাসায় উর্দুতে কথা বলতে বাধ্য করা হয় শিক্ষার্থীদের। ইংরেজি মাধ্যমেও কিন্তু ইংরেজিতে কথা বলতে বাধ্য করা হয়। আমাদের দেশে তিন ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থার ত্রুটি নিয়ে বহুদিন ধরেই কথা হচ্ছে। এখানে তিন ধরনের মানসিকতা নিয়ে শিশুরা বড় হচ্ছে। বর্তমানে দেখা যাচ্ছে অনেক ইংরেজি মাধ্যম মাদ্রাসাও খোলা হয়েছে। ভিনদেশী সংস্কৃতির চর্চা করা মাদ্রাসা ও ইংরেজি মাধ্যমের এই শিক্ষার্থীরা আদতে দেশের মানুষ ও সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। তারা হয় মনে করছে সৌদি আরবই শ্রেষ্ঠ, নয় ইউরোপ, আমেরিকা। মাতৃভাষাকে ভালোবাসলে মানুষ দেশকে ভালোবাসে, দেশকে ভালোবাসলে মানুষ দেশের মানুষকে ভালোবাসে। আর সেভাবেই তারা দেশ গঠনের কাজ করে। হয় তো বলবেন বাকি লোকেদের দেশপ্রেম কি অনুকরণীয়? না, সেটা নয়। সেই জায়গাটাও যদি ঠিক করতে চাই তাহলে এই শিক্ষা ব্যবস্থাকেই আমাদের পাল্টাতে হবে। চুরি করা প্রশ্ন পেয়ে যে পরীক্ষা দেয়, অথবা যে খুব সহজেই নম্বর পেয়ে যায় সে তো শিক্ষাজীবন থেকেই দুর্নীতি শেখে।
মাদ্রাসার ভূগোল যেমন কাবাকেন্দ্রিক, আবার বিজ্ঞান শিক্ষাও ধর্ম প্রভাবিত। ইংরেজি মাধ্যমের ভূগোলও বাংলাদেশ কেন্দ্রিক নয়। তারাও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের মতই বাংলা সাহিত্যের বড় বড় লেখকদের পাঠ করতে পারেন না। এমনকি বাংলা ভাষাটিও তাদের কাছে ‘অপরে’র ভাষা। মাদ্রাসার ছাত্রদের এমনভাবে শিক্ষা দেওয়া হয় যেন বাংলা ভাষা ‘হিন্দুদের ভাষা’। আর ইংরেজি মাধ্যমে বোধ দেওয়া হয় বাংলা হলো একেবারে ‘ছোটলোক’দের মুখের বুলি। তাই তো গর্ব নিয়ে অনেকে বলেন, ‘আমি আবার ভালো বাংলা বলতে পারি না!’ মাদ্রাসার ছাত্ররাও বাংলার চেয়ে আরবি, ফারসি কী উর্দু বলতে পারলে শ্লাঘা বোধ করে। এই দুই শ্রেণির কারও মধ্যেই দেশের সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসা বা মাতৃভাষার চর্চা নেই। মাদ্রাসার বই থেকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সরিয়ে দিতে পারলেই যেন তারা বাঁচে। আর ইংরেজি মাধ্যমের পড়ালেখায় মুক্তিযুদ্ধ যে অবহেলিত সে তো অনেকদিন ধরেই সংশ্লিষ্টরা জানেন।
অথচ কে না জানেন, মাতৃভাষায় জ্ঞানচর্চা না করলে, সেই জাতি জাতিগতভাবে যেমন ঐক্যবদ্ধ হতে পারে না, তেমনি জ্ঞান, বিজ্ঞান ও দর্শনেও পিছিয়ে পড়ে। অবশ্য বাংলা মাধ্যমের পড়ালেখাও যে খুব উন্নতমানের তা কিন্তু নয়। সেখানেও ব্যাপক পরিবর্তন প্রয়োজন। বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের সঙ্কট আবার উল্লিখিত দুই মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের মতো নয়। তাদের মধ্যে একদিকে বঞ্চনার বোধ যেমন আছে, তেমনি আছে ধনী হওয়ার বা কিছু একটা করে ফেলার আকাঙ্ক্ষা। এই দোটানার ভেতর দিয়েও অনেকে চরমপন্থার দিকে আকৃষ্ট হয়। সেটার প্রমাণ আমরা পেয়েছি। সব শিক্ষা মাধ্যম, সব শ্রেণি থেকেই কিশোর, সদ্য যুবকদের মগজ ধোলাইয়ের কাজ চলছে সুচতুরভাবে। এই ধোলাইয়ের জন্য প্রযুক্তির সাহায্য নেওয়া হচ্ছে। সাহায্য করছে এই সময়ের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতাও।
বাংলাদেশে এই যে এখন আইএস ঝড় উঠেছে সেটা আর কিছু নয়, বিগত সাড়ে চার দশক ধরে শিক্ষাকে যে সংস্কার না করে বিভক্ত করে রাখা হয়েছে, ধর্মকে যে যাচ্ছেতাই ভাবে রাজনীতিতে ব্যবহার করা হয়েছে, ধর্মব্যবসায়ীদের যে উদার দৃষ্টিতে দেখা হয়েছে- এটা তারই ফল। কার্ল মার্কসের ভাষায় বললে আমরা এখন এসে একটা গুণগত পরিবর্তন দেখছি। কিন্তু এর পরিমাণগত পরিবর্তন সমাজে ঘটেছে গত কয়েক দশক ধরেই। আমাদের রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবই এর মূল কারণ। এই ফল পাওয়ার শুরুটা কিন্তু এখন নয়। এটা ২০১৩ সাল থেকেই শুরু হয়েছে ব্লগার রাজীব হায়দারকে হত্যার মধ্য দিয়ে। এর কিছুদিন পরই শতশত মাদ্রাসা ছাত্র হেফাজতে ইসলামের কর্মী হিসেবে যখন রাজধানীর মতিঝিলে জড়ো হয়, এবং একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে তখনই মূলত এই পরিবর্তনের গুণগত দিকটি অনেককেই শঙ্কিত করে দেয়। মাদ্রাসা ছাত্রদের এমনভাবে এক সঙ্গে জড়ো হতে পারার পেছনে রয়েছে তাদের শৃঙ্খলিত, সেনাবাহিনীসুলভ বেড়ে ওঠা। মানে তারা এক সাথে থাকেন, সময় ধরে চলেন এবং একটা কড়া শাসনের মধ্যে থাকেন, ঠিক যেমন সেনাসদস্যরা থাকেন। তো এই একটি কারণে মাদ্রাসার ছাত্রদের খুব কম সময়ের মধ্যে যে কোনও জায়গায় জমায়েত করা সম্ভব হয়।
ইংরেজি বা বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে আবার এমনটা সম্ভব নয়। তাতে কী? তাদের জন্য রয়েছে ফেসবুক, টুইটার সহ নানা ধরনের ইন্টারনেট ভিত্তিক অ্যাপ। সেসবের মাধ্যমে তাদের যুক্ত করা হয় এবং পরিচালনা করা হয়। মাদ্রাসার ছাত্ররা যেমন একধরনের ধূসর জীবন যাপন করে, অতিরিক্ত ধর্মীয় আচার আচরণ চাপিয়ে দেওয়ার কারণে, অন্য দুই মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের জীবনও অনেকটা ধূসর। কারণ এদের কারো কাছেই প্রকৃত অর্থে বেঁচে থাকার ‘মহৎ উদ্দেশ্য’ বা ‘লক্ষ্য’ নেই। এই উদ্দেশ্যহীন জীবনে যখন চরমপন্থীরা ‘উদ্দেশ্য’ দান করে তখন তারা সক্রিয় হয়ে ওঠে। মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা সাধারণত গরিব হয়, দারিদ্র ও সিলেবাসের কারণেই তাদের ভবিষ্যৎ আর্থিক বিচারে অনেকটাই পরনির্ভরশীল ও অন্ধকার। একারণে তারা চরমপন্থার দিকে আকৃষ্ট হয়। এক ধরনের বঞ্চনার বোধ তাদের মধ্যে কাজ করে। এই বোধ কিন্তু অন্য শিক্ষার্থীদের মধ্যেও আছে, তবে অভিন্ন রূপে নয়। বাংলা মাধ্যমে পড়া একটি মধ্যবিত্ত ছেলে যখন ইংরেজি মাধ্যমের ছেলেটার মতো ইংরেজি বলতে পারে না বা সামাজিক সুযোগ সুবিধা পায় না তখনও তার মধ্যে হতাশা কাজ করে। বঞ্চনার বোধ কাজ করে। আবার উচ্চবিত্তদের মধ্যে – ‘সব পেয়ে গেছি, এরপর কী? আর কিছু নেই!’ ধরনের আক্ষেপ কাজ করে। জীবনের সব সাধ আহ্লাদ পূরণ হলে মানুষ এক পর্যায়ে বিষণ্ণ হয়ে ওঠে। আবার এসবের সুযোগেই তাদের জীবনে একটি ‘উদ্দেশ্য’ নিয়ে হাজির হয় আইএসের মতো সংগঠনগুলো। তারা রঙিন স্বপ্ন দেখাতে শুরু করে এসব তরুণদের।
এই স্বপ্নের মধ্যে ভুয়া জিহাদি জোশের আদর্শ যেমন আছে, তেমনি আছে অবাধ অর্থ, মাদক ও যৌনতার হাতছানি। উল্লিখিত চারটি বিষয়কে এক করে যে স্বপ্ন হাজির করা হয়, সেটার আকর্ষণেই তরুণরা ঘর ছাড়ছে। এটা বন্ধ করা সম্ভব, তবে সেজন্য দরকার সমন্বিত ও দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা। এবং এই পরিকল্পনায় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে। আমরা জানি, আমাদের জাতীয় বাজেটে সবচেয়ে অবহেলিত খাতগুলোর মধ্যে এই দুটোও আছে।
আর অবহেলা করার সময় নেই। আমাদের বুঝতে হবে ভাষাই মূলত মানুষের সংস্কৃতিকে ধারণ করে। শিক্ষার্থীদের বাংলা ভাষা ও দেশের সংস্কৃতি সংলগ্ন করতে হবে। পাশাপাশি তাদের সিলেবাসকে করতে হবে অভিন্ন, সময় উপযোগী, আধুনিক, বিজ্ঞান সম্মত ও দেশপ্রেম মিশ্রিত। তবেই এদেশের ঐক্যবদ্ধ একটি জাতির উদ্ভব সম্ভব। এমনিতেই এসব তথাকথিত জঙ্গি সংগঠন আইএস এই দেশে সুবিধা করতে পারবে না। আর জাতি যদি চিন্তাচেতনায় এক হয় তাহলে এদেশে আইএসের মতো বিদেশি অপশক্তি প্রবেশের সুযোগই পাবে না। এদেশের পোশাক শ্রমিকদের অধিকাংশই মেয়ে, তারা অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন। এদেশের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, শিল্পী, সংস্কৃতিকর্মীরাও সংখ্যায় কম নন। এদের কেউই আইএসের আদর্শকে মেনে নেবে না।
কাজেই সেই সুদূর সিরিয়া ও ইরাকের যুদ্ধ যদি বেওকুফের মতো বাংলাদেশে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে আইএস, এবং এতে অন্ধের মতো কিছু দেশি তরুণ ঝাপিয়ে পড়ে তবে সেটি হবে তাদের জন্য চরম ভুল। বাংলাদেশের মানুষ গুলশানের ঘটনায় হতবিহ্বল হয়েছে ঠিক, শোকগ্রস্ত হয়েছে, মুষড়ে পড়েছে। কিন্তু ভেঙে পড়েনি। ব্লগার-লেখক-শিক্ষকদের হত্যাকারীদের কিন্তু এদেশেরই শিখণ্ডি ও সাধারণ মানুষ দৌঁড়ে ধরে ফেলেছে। গুলশানের হামলা বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো হলো। তারমানে এই নয় এমন ঘটনা ঘটতে থাকবে, আর এদেশের মানুষ হা করে দেখতে থাকবে।
৫২, ৬৯, ৭০, ৭১, ৯০, সর্বশেষ ২০১৩- এই সাল গুলোতে বাংলাদেশের মানুষ দেখিয়েছে তারা শান্তিপ্রিয় ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী। তারা ন্যায়বিচারে বিশ্বাসী। এদেশে খেলাফতের যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে বলে যে রাকা থেকে তিন বাংলাদেশি হুমকি দিল, তাদের সাহস থাকলে ঢাকার যে কোনও রাস্তায় দাঁড়িয়ে একথা বলুক প্রকাশ্যে, তার নাম নিশানা খুঁজে পাওয়া যাবে না। তারা গণতন্ত্রকে মানে না, এদেশের মানুষকে জবাইযোগ্য মনে করে। আইএস সুদূর সিরিয়া থেকে বলেছে বাংলাদেশে গুলশানের মতো হামলা আরো হবে- এই হুমকি আমাদের সার্বভৌমত্বের ওপর হুমকি। এই বাংলাদেশ রক্তের বিনিময়ে এসেছে। এদেশের মানুষ লড়তে জানে। যারা এই লাল সবুজ পতাকার দেশকে, যারা এই খেটে খাওয়া শ্রমিক-কৃষকের দেশকে, যারা এই শ্রমে ঘামে গড়ে তোলা উন্নয়নশীল দেশকে হুমকি দেয়, তাদের এদেশের মানুষ তীব্রভাবে প্রত্যাখ্যাত করবে। নিজের দেশ থেকে পালিয়ে গিয়ে অন্য দেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে, ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতের যুদ্ধকে যারা নিজের দেশের মানুষের ওপর চাপিয়ে দিতে চায়, সেই গুটি কয়েক কুলাঙ্গারকে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জন্ম নেওয়া বাংলাদেশের লড়াকু ও সংগ্রামী মানুষ এক ফুৎকারেই উড়িয়ে দেওয়ার সামর্থ রাখে।
আইএসের বিপক্ষে এদেশের জনগণের অবস্থান কঠোর হতেই হবে। তবে বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সরকারের অবস্থান হতে হবে কৌশলী। বাংলাদেশকে ভাবতে হবে আইএস যদি নিয়মিত এধরনের হামলা পরিচালনা করতে থাকে তাহলে দেশের ভেতরে এর প্রভাব পড়বে গভীরভাবে। এই প্রভাবে দলে দলে মানুষ দেশ ছাড়তে পারে। মার্কিন সমাজবিজ্ঞানী কেলি গ্রিনহিল যেমনটা বলছেন- ‘উইপন্স অব মাস মাইগ্রেশন’ অর্থাৎ ‘গণহারে দেশত্যাগের অস্ত্র’ হিসেবে কাজ করবে এসব হামলা। অবশ্য এরই মধ্যে দেশত্যাগের আঁচ অনুভব করতে শুরু করেছে ভারত। তো এতে ফায়দা আসলে কার? বাংলাদেশকে বুঝতে হবে এক ঝুড়িতে সব ডিম রাখা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে প্রকাশ্যে যুক্তরাষ্ট্রের মতো পরাশক্তির সমালোচনা, মার্কিন রাষ্ট্রদূত সম্পর্কে প্রকাশ্যে সরকারের মন্ত্রীর কটুক্তি- এসব কতটা যৌক্তিক ছিল, সেটাও সরকারকে ভাবতে হবে। এখনই একটি কঠিন সমীকরণ কষে, দ্রুত কার্যকরী পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ করতে হবে। আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ইরাক, সিরিয়া এসব দেশের উদাহরণ থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে, দ্রুত।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও চলচ্চিত্র গবেষক