বিদ্যাবুদ্ধি, মেধার কঠোর পরিচর্যা ও অনুশীলন করতে হয়। লেখার জন্য লেখককে পড়তে হয়, জানতে হয় এবং চিন্তা করতে হয়। এটা যে কত কঠিন এবং শ্রমসাধ্যতা বর্তমানে জনপ্রিয় লেখকদের দুষ্প্রাপ্যতার ক্রমহ্রাসমান হার দেখলেই বুঝা যায়। একজন লেখকের জন্য বিষয়টি বড়ই কঠিন। কেননা প্রতিষ্ঠানের সমস্ত প্রয়োজনীয় কাজ শেষ করে হিসেব করে চলতে হয়। একজন লেখককে পাঠকদের জন্য ব্যতিক্রমধর্মী শিক্ষনীয়, প্রয়োজনীয় অথচ আকর্ষণীয় বিষয়াদি বর্ণনার জন্য নিরন্তর চেষ্টা করতে হয়। মানুষ যখন প্রতিটি কর্মচিন্তা ও চেতনায় কেবল নিজের কথা ভাবে এবং নিজের অহংকারবোধকে প্রাধান্য দেয় তখন পৃথিবীর সবকিছু থেকে সে নিজেকে বিছিন্ন করে ফেলে। একজন মানুষ যদি মনে করে সবাই তার হুকামত চলবে, তার কথা শোনবে, তার মতামতকে প্রাধান্য দেবে এবং তার সিদ্ধান্তের বাইরে কেউ কথা বলবে না অর্থাৎ দৈনন্দিন কোন কাজে তার বাইরে না গেলেই তিনি খুশি। তবে কি আমরা মনে করতে পারি যে, তার উপর সবাই খুশি? কখনই না। আশপাশের সবালোকের ঘৃণা-বিরক্তি তার সব সম্ভাবনা, সুখ-শান্তি নিমিষেই বিলীন হয়ে যেতে পারে। নিজের আশা আকাঙ্খার এবং স্বার্থকে বড় করে দেখার ফলে তার চারপাশে কেবল তারই মত স্বার্থপর আত্মকেন্দ্রিক ও অহংকারী মানুষের ভিড় লেগেই থাকবে। এ ধরনের মানুষের পরিবার, পরিজন ব্যবসায়কি অংশীদার থেকে শুরু করে মন্দ কাজের সঙ্গীরাও সমচরিত্রের অধীকারী হয়ে থাকে। মানুষের আমিত্বমূলক স্বার্থপর মনোভাব এবং আচরণই মানবদেহ, মন ও মস্তিস্কের যাবতীয় রোগ বালাই ও অশান্তির সৃষ্টি করে। ব্যক্তি, সমাজ, দেশ ও জাতির উন্নয়ন এবং অগ্রযাত্রা আমিত্ববাদের কাছে যেন চাপা পড়ে যায়।
মানব জন্মের পরম সার্থকতা হলো, নিজের হাতটি সব সময় অন্যের সাহায্যে এগিয়ে দেওয়া। আপনি যদি আশা করেন যে, সবাই আপনার আশা পূর্ণ করে দিবে তবে জেনে রাখুন এ পৃথিবীর কারো দায় পড়েনি আপনার আশা পূরণ করার। আপনার সুখ, অর্থবিত্ত, ক্ষমতা এবং উল্লাসের মধ্যে নিজের সফলতা না খুঁজে বরং ভাবুন দুঃখের দিনে আপনার চোখের পানি মুছে দেওয়ার মত কজন লোক আপনার রয়েছে, অথবা মৃত্যুর পর কতজন লোক আপনার কথা স্বরণ করে অশ্র“সিক্ত নয়নে একান্তে আপনার জন্য প্রার্থনায় মগ্ন থাকবে। একটি জাতীয় দৈনিকে একজন সনামধন্য কলামিস্ট লিখেছেন পৃথিবীর সর্বকালের সর্বনিকৃষ্ট শব্দ হলো আমি। আমি কখনই আমরা ছাড়া সার্থক হয় না। পৃথিবীর কোন ভোগ বিলাস, আনন্দ, বিনোদন, ভ্রমণ কোন কিছুই একার দ্বারা সম্ভব হয় না বা একাকী করা যায় না। আর এ সবের জন্য মানুষের দরকার সঙ্গী। সঙ্গী, সাথী নিয়ে কেউ যখন জীবন শুরু করে তখন সে সেই আমি থেকে আমরা এর বৈশিষ্ট্য গ্রহণ করে।
তাই আমি থেকে আমরাতে পরিবর্তিত হওয়ার জন্য মন-মাসসিকতার পরিবর্তন আনতে হবে। সর্বদা চাওয়া-পাওয়ার জন্য হাত না বাড়িয়ে আপনি যদি চিন্তা করেন আমি এ যাবতকালের পরিবার পরিজন, দেশ ও জাতির জন্য কি করেছি, কি উদ্দেশ্যে করেছি, আগামী দিনের জন্য কি করব, তাহলে আপনি সকল সংকীর্ণতার গণ্ডি থেকে বের হওয়ার রাস্তা খুঁজে পাবেন। আপনি যদি কেবল চাইতেই থাকেন, তবে আপনাকে ব্যথা, বেদনা, অপমানে এবং তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের মত গ্লানী সহ্য করতেই হবে। আর আপনি যদি নিঃশ্বার্থভাবে দিতে চান তবে কেউ আপনাকে বাঁধা দেবে না, বরং সবাই কৃতজ্ঞতা, শ্রদ্ধা ও ভালবাসার বন্ধনে আপনাকে জড়িয়ে ফেলবে। আপনার দেয়ার মাঝে যদি কোন প্রতিদান, ধন্যবাদ বা কৃতজ্ঞতা লাভের সামান্যতম আশা-আকাঙ্খার বা অভিলাষ থাকে তাহলে আপনি কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌছাতে পারবেন না। মানুষ বড়ই কৃতজ্ঞ জাতি- তারা কোনদিন নিঃস্বার্থ পরোপকারীকে ভূলে না। মানুষ হিসেবে সফল হওয়ার পথে দুনিয়া এবং আখিরাতের সবচেয়ে বড় বাধটি হলো অহংবোধ।
অহংকারী মন আল্লাহর ক্ষমা এবং দয়া দাক্ষিন্য লাভ করতে পারে না। তার সমস্ত ভাল কাজ শেষে মন্দ কাজে পরিণত হয়। আল্লাহ বলেন- অহংকার হলো আমার ইজ্জত বা চাঁদর। সে ব্যক্তি জমিনে অহংকার করে সে যেন আমার চাঁদর নিয়ে টানাটানি করে। কাজেই অহংকার, দাম্ভিকতা ইত্যাদি থেকে মুক্ত না হয়ে আমি কখনই আমরা হতে পারে না। একজন অহংকারী মানুষ তার অহংবোধের জন্য দুঃখ প্রকাশ করলে ধরে নেয়া যায় সে ব্যক্তি অহংকারমুক্ত মানুষ। একজন মানুষ তার অহংকারী কৃতকর্মের জন্য দুঃখ প্রকাশ করলে এবং মানুষকে তার আপন সত্বার চেয়ে বেশি মূল্যয়ণ করলে মুলত; তাকে সম্মানিত করতে পারে। দুঃখ প্রকাশের মাধ্যমে আপনি নিজের অহংবোধকে অবদমিত করে অন্যের মাঝে মানবিকতার ফুল ফোঁটাতে পারেন এবং অন্যের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য নিজের আত্মার দরজা খুলে দিতে পারবেন। আপনার দুঃখ প্রকাশটি যেমন নিঃশ্বার্থ এবং আন্তরিক হতে হবে তেমনি হতে হবে নিঃশর্ত। শর্তযুক্ত দুঃখপ্রকাশে হিতে বিপরীত হয়। আপনি সম্পূর্ণ আন্তরিকতা এবং স্বার্থ ত্যাগ করে দুঃখ প্রকাশ করলেন কিন্তু মনে মনে আশা করলেন, লোকজন আপনার দুঃখ প্রকাশকে সরলদৃষ্টিতে এবং আন্তরিকভাবে গ্রহণ করবে।
আপনি হায়তো ভাবলেন, আপনি সমাজে মহা ক্ষমতাধর ব্যক্তি। নিজের মহত্ব প্রকাশের জন্য আপনি অধীনস্থদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছেন, সুতরাং অধিনস্থদের উচিৎ কৃতজ্ঞতা ও সম্মান সহকারে আপনার দুঃখ প্রকাশকে সাদরে গ্রহণ করা। আপনার এ ধরণের মানসিকতা যদি থাকে তবে ধরে নেয়া হবে আপনি আপনার হামবড়া ভাব ও অহমিকা থেকে বের হতে পারেন নি। কেননা, দুঃখ প্রকাশ হলো নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা। আর ক্ষমা চাওয়ার এটি হলো সর্বোৎকৃষ্ট উপায়। ক্ষমা বা প্রার্থনা সফল করার জন্য দরকার একান্ত অনুশোচনায় এবং অশ্রবারী বর্ষন। মাথা ও কাধ সামনের দিকে বাঁকাতে না পারলে মানুষ কখনও অহংবোধের পাঁপ থেকে মুক্তি লাভ করতে পারে না। মানুষ যাতে সাবলীলভাবে এ কাজটি করতে পারে সে জন্য প্রকৃতিগত ভাবেই তাকে আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টি করেছেন। তাঁর কাছে শ্রদ্ধাবনত সেজদা এবং অনুশোচনার অশ্র“কে মানুষের মুক্তির অন্যতম বৈশিষ্ট বলে বর্ণনা করা হয়েছে। মানুষ যখন ভুল করে এবং তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে, তখন তাকে বলা হয় সৎ মানুষ। যখন কোন মানুষ কোন বিষয় সম্পর্কে শতভাগ নিশ্চিত না হয়ে দুঃখ প্রকাশ করে তখন তাকে বলা হয় জ্ঞানী। আমাদের সকলের মাঝে এমনি মানসিকতার উদয় হোক এটাই প্রত্যাশা।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিষ্ট