Sunday, 22 December 2024, 09:02 AM

অতিরিক্ত জনসংখ্যা অভিশাপ নয় আশীর্বাদ

…….মোঃ আব্দুল মান্নান

 

মানুষ যে পৃথিবীতে বসবাস করছে, তা মানুষের জন্মের বহু আগ থেকেই বিদ্যমান ছিল। আদিকাল থেকেই মানুষের জীবন যাপন, স্থায়িত্ব, সভ্যতা ও সংস্কৃতির জন্য যাবতীয় উপায়-উপাদানও প্রস্তুত করা ছিল। মানুষ পৃথিবীতে এসে কোন কিছুই সৃষ্টি করে নি বরং পূর্ব থেকে যা-কিছু ছিল, নিজের বুদ্ধি ও শ্রম যোগ করে বিভিন্ন পদ্ধতিতে এ উপাদানগুলো মানুষ ব্যবহার করছে মাত্র।

প্রথম মানুষ থেকে শুরু করে একবিংশ শতাব্দির মানবগোষ্ঠীর প্রয়োজন উপযোগি একটি বস্তুও এমন নয়, যা পূর্ব থেকে পৃথিবীতে মজুদ ছিল না। আর এ কথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে, আগামীতে মানুষের প্রয়োজন পূরণ করার যাবতীয় উপকরণ মহান আল্লাহ ভূগর্ভ, সাগরতল, ভূ-পৃষ্ঠ ও মহাশূণ্যে নিশ্চই মজুদ করে রেখেছেন। কেননা মানুষ এসব বস্তু সৃষ্টি করতে পারে না এবং এগুলোর অবস্থান, পরিমানও আবিষ্কার করে ব্যবহার উপযোগি সময় নির্ধারণ করতেও মানুষের কোন ক্ষমতা নেই ও নেই কোন হাত। এ কথা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাব হয়েছে যে স্রষ্টার পরিবেশনায়, তিনিই মানুষের সঠিক প্রয়োজন হিসাব করে সমস্ত উপকরন পূর্বেই মজুদ করে রেখেছেন। মানুষ যখন জীবন জীবিকার প্রয়োজনে অধিকতর পরিশ্রমে বাধ্য হয়, আর তখনই স্রষ্টার দেয়া সম্পদের ভান্ডার মানুষের হস্তগত হতে থাকে। প্রয়োজনের তাগিদে মানুষ নুতন নুতন সম্পদের অফুরন্ত সম্পদের ভান্ডার খুঁজে বের করতে থাকে ও এ গুলোর ব্যবহার প্রণালীও মানুষ প্রয়োজনে তখন শিখে ফেলে।

পৃথিবীতে জনসংখ্যা বাড়ছে অথচ জীবন যাপনের উপাদান বাড়েনি ইতিহাসে এমন নজির খুঁজে পাওয়া যায় নি। মানুষের এ অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগও ঘটেছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে সৃষ্টিকর্তার দেয়া এ সব অফুরন্ত সম্পদের ভান্ডারও বের হয়ে এসেছে। যা মানুষ পূর্বে কখনও ধারণাও করেনি। সভ্যতার শুর থেকে মানুষ জ্বালানী তেলের দাহিকা শক্তি সম্পর্কে জানত কিন্তু পৃথিবীর বুক চিরে পেট্রোলের উৎপত্তি হবে বা পেল্ট্রোল বের হয়ে আসবে, এ কথা কি মানুষ পেট্রোল আবিষ্কারের পূর্বে জানত? যা দ্বারা মানুষ মোটর, বিমান চালাবে, শিল্প, বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এর প্রভাবে সর্বক্ষেত্রে নুতন গতি শুরু হবে। হাজার বছর পরে বিশেষ পর্যায়ে এসে বিদ্যুতের রহস্য মানুষের কাছে ধরা পড়েছে, এর ফলে শক্তির এক বিশাল ভান্ডার মানুষের হস্তগত হয়েছে, যা মানুষ দেড়শত বছর আগেও কল্পনা করতে পারে নি। মূলত গত দেড়শত বছরের মধ্যে উল্লেখিত আবিষ্কারের কারনে পৃথিবীতে জীবন যাপনের বস্তু ,সামগ্রী ও উপকরণাদী এতই বেড়ে গেছে যে, মানুষ যা স্বপ্নেও ধারনা করতে পারে নি।

এ সব আবিষ্কারের পূর্বে যদি পৃথিবীর মানুষ এ গুলো উপকরণের হিসাব করে জনসংখ্যাকে সে মোতাবেক নিয়ন্ত্রণ করার পরিকল্পনা করত, তাহলে তা হ‘ত নিতান্তই মূর্খতা, যা বর্তমানে ভেবে দেখা দরকার। এতসব হিসাব করে যারা, তারা শুধু বর্তমান সময়ের জ্ঞানকে ভবিষ্যতের জন্য যথেষ্ট মনে করার ভ্রান্তিতেই ভোগে, তারা এ কথা ভূলে যায় যে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে খাদ্য গ্রহণকারীর সংখ্যাই বাড়ে না বরং এর সাথে সাথে উৎপাদন ও উপার্জনকারীর সংখ্যাও সমান তালে বাড়ে। জমি, পূঁজি ও জনশক্তি হচ্ছে উৎপাদনের মূল উৎস। আর এ তিনটির মধ্যে জনশক্তিই হচ্ছে প্রথম সারিতে। যারা অতিরিক্ত জনসংখ্যার চিন্তায় ঘুমকে হারাম করেছে, তারা মানুষকে শুধু সম্পদের ব্যবহারকারী হিসাবেই জেনেছে, সম্পদ উৎপাদনকারী হিসাবে নয়।

বর্তমানে বাংলাদেশের উন্নয়নের মূল চাবিকাঠিই হচ্ছে জনশক্তি। হাজার হাজার কোটির রেমিট্যান্সের টাকা আজ বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকাকে ঘুরিয়ে দিয়েছে। তলাবিহীন ঝুড়ির দেশ হিসাবে আখ্যায়িত দেশ এখন হতদরিদ্র দেশের নামের তালিকা থেকে বেরিয়ে এসে মধ্যম আয়ের দেশের তালিকায় নাম লিখিয়েছে। অধিক জনসংখ্যা এখন জনসম্পদে বা মানব সম্পদে পরিণত হয়েছে। বর্দ্ধিত জনসংখ্যা শুধু নুতন নুতন কর্মক্ষেত্রের পথ সৃষ্টি করে তা নয়, তারা কাজের তাগিদও সৃষ্টি করে। বর্তমানে বাড়তি জনসংখ্যার চাপই বাধ্য করেছে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানসহ অন্যান্য প্রয়োজন পূরণের বাড়তি চাপ। আর এ কারণেই অধিক জনসংখ্যা আপদ নয়, আশীর্বাদ হয়ে আসছে, এ ছাড়া অন্য কিছু ভাবাই বোকামী। দেশের গার্মেন্টস সেক্টরে অসংখ্য নারী শ্রমিক, ঔষধ শিল্পের অভাবনীয় ভাবে বিকাশলাভ, জাহাজ নির্মাণ শিল্প, সফ্টওয়রে সামগ্রী তৈরিতে সাফল্য, চামড়া শিল্প ও অন্যান্য ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র শিল্পের উন্নয়নে সাফল্য এসেছে অধিক জনসংখ্যার চাপের কারনেই। কেননা প্রয়োজনই মানুষকে বাঁচতে শেখায়।

১৯৭১ সালে যখন এ দেশ স্বাধীন হয়, তখন দেশের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি। মানুষ তখন দু-বেলা পেট পুরে খেতে পায় নি। ১৯৭৪ সালে রংপুর অঞ্চলের অনেক মানুষসহ অসংখ্য মানুষ না খেয়ে মারা গেছে খাদ্যাভাবে। মানুষের খাবার জোগানোর জন্য দেশে তখন নঙ্গরখানা খোলা হয়েছিল। কিন্তু এখন দেশে জনসংখ্যা ১৬ কোটির অধিক; অথচ একটি মানুষও এখন না খেয়ে মরে না। কারন ১৯৭৪ সালের দূর্ভীক্ষই মানুষকে শিক্ষা দিয়েছে ভালভাবে বেঁচে থাকার। এ জন্য কিন্তু বাড়তি কোন জমির প্রয়োজন হয় নি, প্রয়োজন হয়নি নতুন সাগর, পাহাড় কিংবা নদ-নদীর। এ গুলো মহান আল্লাহ আগেই মানুষের জন্য সৃষ্টি করে রেখেছেন। মানুষ শুধু বুদ্ধি খাটিয়ে এ গুলোর মধ্যেই ভালভাবে বাঁচার উপকরণ তৈরি করেছে। যদি জনসংখ্যার অধিক চাপ না থাকত, মানুষ কখনই উৎপাদন বৃদ্ধিতে এত আগ্রহী হত না। খাদ্য অভাবে যে দেশের মানুষ না খেয়ে মরত, সে দেশ থেকে এখন খাদ্য রপ্তানি করা হয় বহির্বিশ্বে, যা অবাক হওয়ার মত ঘটনা।

তাই এখন সবাই নিজেকে প্রশ্ন করি, অতিরিক্ত জনসংখ্যা অভিশাপ না আশীর্বাদ? “মুখ দিয়েছেন যিনি রে ভাই আহার দিবেন তিনি,” বর্তমান প্রেক্ষাপট এ মূল্যবান বাক্যটিরই বাস্তব প্রতিফলন।

লেখক: অবসর প্রাপ্ত সরকারী কর্মচারী ও সাংবাদিক।