………মোঃ আব্দুল মান্নান
গণমাধ্যম হচ্ছে জনগণের কাছে তথ্য পৌঁছানোর একটি আধুনিক পদ্ধতি। একটি জনগোষ্ঠির জীবনধারা কোন দিকে ধাবিত হচ্ছে বা ধাবিত হবে গণমাধ্যম তা নিয়ন্ত্রণ করে। একটি জাতির উন্নয়নে তাই গণমাধ্যমের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাংবাদিকগণ জাতির বিবেক। মানুষের সামনে ন্যায়-অন্যায়ের মানদণ্ড উপস্থাপনে সাংবাদিকগণ দায়িত্ব পালন করে থাকেন। আদর্শবাদী সাংবাদিকগণের কখনও সমাজে মর্যাদার কমতি হয় না। গণ-মানুষের অধিকার রক্ষায় সাংবাদিকগণ ও সংবাদপত্র কাজ করে থাকে। কোন কারণে যদি কখনও সংবাদপত্র প্রকাশ বন্ধ হয়ে যায় তাহলে তা মানুষের সামাজিক অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে এক ধরনের বাঁধার সৃষ্টি হবে। গণমাধ্যম হলো এমন এক মাধ্যম যা সরকারের ভূল ত্রুটি ধরিয়ে দেয়, যাতে সরকার তা শুধরে নিতে পারে।
বাংলাদেশে সংবাদপত্র একটি গণতান্ত্রিক স্তম্ভ হিসেবে কাজ করছে। আইন, বিচার ও নির্বাহী বিভাগের পর এর স্থান চতুর্থ নম্বরে। পত্রিকা প্রতিষ্ঠানগুলোর খোঁজ-খবর নেয়ার জন্য একটি মন্ত্রণালয়ও রয়েছে এবং রয়েছে সরকারি নীতিমালা ও দেশের সংবিধানে সংযোজিত ৩৯(২) ধারার উপধারার(খ)তে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা।
সাংবাদিকদের দায়িত্ব ঐতিহাসিকের মত। প্রকৃত সাংবাদিকদের মহান কর্তব্য হচ্ছে সত্য উদঘাটন করে তা পাঠক ও দর্শকের সামনে উপস্থাপন করা। কারো প্ররোচনায় কিংবা অন্য কোন ফর্মুলায় নয়, নির্ভূল সংবাদ, নিখুঁতভাবে তুলে ধরাই একজন আদর্শবান সাংবাদিকের কাজ। সাংবাদিকতা কখনই নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে সুবিধাবাদীদের নিকট আত্মসমর্পণ করে না। সাংবাদিকদের আদর্শই হলো নিরপেক্ষতা। সঠিক সময়ে নিরপেক্ষতা ঠিক রেখে সংবাদ পরিবেশনের মাঝেই সাংবাদিকদের স্বার্থকতা নিহিত। তাদের উদ্দেশ্যই হলো অন্যায়, অবিচার ও দূর্নীতির বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ করে সরকারকে সহায়তা করা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ-যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন তাঁর , “যুদ্ধবাজ সাংবাদিকতা বনাম মুক্ত মিডিয়া মিথ” প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘মূল ধারার গণমাধ্যম মূলতঃ কর্পোরেট গণমাধ্যম। বিশাল সংস্থাগুলো তাদের নিয়ন্ত্রণ করে এবং তাদের এজেণ্ডা প্রসারের কাজেই এ গণমাধ্যম ব্যবহৃত হয়। কর্পোরেট এলিটকূল গণমাধ্যমকে ব্যবহার করে মস্তিষ্ক ধোলাইয়ের জন্য, মানুষকে তথ্যদান বা সচেতন করে তোলার জন্য নয়।’ এই হলো হালের সাংবাদিকতা। যারা মিডিয়াতে কাজ করতে আসছেন, তারা অধিকাংশই আসছেন সাংবাদিকতা পেশার সুবিধা হাসিল করে অর্থ ও ক্ষমতা অর্জনের জন্য। তাদের স্বার্থ ও পক্ষপাতিত্ব মনোবৃত্তির দরুণ পরিবেশিত সংবাদের বিশ্বাসযোগ্যতাও এখন হারিয়ে যাচ্ছে। যে কারণে বড় বড় সংবাদ সংস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। হয়তঃ এমনও দিন আসতে পারে, যে দিন সত্য উদঘাটনের স্বার্থে পেশার মান অক্ষুণ্ণ রাখতে তা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবে। তবে তা নিয়ন্ত্রণ করা না হলে বড় ধরনের দূর্যোগ নেমে আসতে পারে সাংবাদিকতা পেশার ওপর। এখনই সময়, যারা এ পেশা বেছে নিয়েছেন তাদের সকলেরই উচিৎ সোচ্চার হওয়া এবং এ পেশার অমর্যাদার গ্লানি বুকের ভিতর পাথরের মত চেপে বসার আগেই তা সংশোধন বা নিজেদের শোধরানো জরুরী। কেননা কিছু পত্রিকার মালিক, পত্রিকা পাঠকের দোরগোড়ায় পৌছাতে ও এর বিড়ম্বনা রোধে জরুরী পরিস্থিতি মোকাবেলায় বা সংকট উত্তরণের কৌশলকে কাজে লাগিয়ে বেকারত্ব নিরসনের নামে পরিচয়পত্র নামক “আইডি কার্ড” প্রদান করে সাংবাদিকতার মহান পেশাকে কলঙ্কিত করছেন এবং তাদের নিজেদের প্রয়োজনে সাংবাদিক নিয়োগ দিয়ে তাদের ব্যবসায়িক বিরূপ পরিস্থিতির মোকাবেলা করছেন।
রাষ্ট্রের ৪র্থ স্তম্ভের এ মাধ্যমটিতে যারা তৃণমূল পর্যায়ে কাজ করছেন, তাদের নিরাপত্তা ও আর্থিক বিষয়ের প্রাপ্তির ক্ষেত্রে এসব পত্রিকার মালিকদের কোন দৃষ্টি নেই। বিশেষ করে যারা মাঠ পর্যায়ে কাজ করেন, তারা কতটা কষ্টে চলেন তা একমাত্র ভুক্তভোগীরাই জানেন। এসব সংবাদপত্রের অফিস থেকে তারা কোন আর্থিক সহায়তা তো পান না উপরন্ত পরিচয়পত্র নিতে এবং পত্রিকার জন্য অগ্রিম টাকা দিতে তাদেরকে এমনিতেই নাজেহাল অবস্থায় পড়তে হয়। এরপরও রয়েছে সরকারি-বেসরকারি বিজ্ঞাপনের চাপ এবং পত্রিকাগুলো নগদ টাকায় কিনে তা পাঠকের কাছে বিনামূল্যে সরবরাহ করতে হয় তৃণমূল পর্যায়ের এসব সাংবাদিকদের; যা অপ্রিয় সত্য। এ কথাটুকুতে কারো কষ্ট লাগতে পারে কিন্তু এটাই নির্মম বাস্তবতা। পেশার ক্ষেত্রে এ দৈন্যতার কারণে অনেক সাংবাদিককে হলুদ সাংবাদিকতার অপবাদ নিতে হয়। আর আদর্শবান সাংবাদিকগণ পেশা দায়িত্বের মর্যাদা সংকটে পড়ছেন এ কারণেই।
তৃণমূল সাংবাদিকতার এ সংকট উত্তরণ এখন খুবই জরুরী। এ কারণে যারা জাতীয়ভাবে এ পেশার নেতৃত্বের আসনে রয়েছেন তাদেরকে অবশ্যই এগিয়ে আসতে হবে এ সংকট উত্তরণে। নচেৎ সাংবাদিকতা পেশা আগামীতে ভাবমূর্তির চরম সংকটে পড়তে পারে।
লেখক- কলাম লেখক ও সাংবাদিক