Monday, 10 March 2025, 05:41 PM

শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠনে চাই রবীন্দ্র চর্চা

একুশ শতাব্দির সমাজ ব্যবস্থায় ভিন্ন রূপ পরিলক্ষিত। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাহাঙ্গামা, খুন, রাহাজানি, মনুষ্যত্বের অবমাননা, দুর্বৃত্তদের আগ্রাসন, অহমিকা, অপশক্তির উত্থানসহ নানা অন্যায় ও অসঙ্গতি সমাজে মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। সমাজের সর্বত্রই কেন জানি এক ধরনের বাঁশির বেদনার সুর। মুর্ছে যাচ্ছি আমরা, সেই সাথে প্রকৃতিও। অপ্রত্যাশিত এবং অকল্পনীয় অনেক ঘটনা ঘটছে। যা আমাদেরকে ব্যাপকভাবে নাড়া দেয়। এক দিকে বিশ্ব যেমন জ্ঞানবিজ্ঞান, তথ্যপ্রযুক্তি, শিক্ষা এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু অপশক্তি যেন পিছু ছাড়ছে না। নানা কারণে মানবিকতা অবহেলিত। সমাজের এই বিরূপ অবস্থা থেকে মুক্তির পথ কী ? ধর্মই হতে পারে মুক্তির প্রধান পথ।


ধর্মের মূল কথা হলো শান্তি। পৃথিবীর সকল ধর্মের মূল উদ্দেশ্য মানুষের শান্তি বজায় রাখা। কিন্তু সেই ধর্মের দোহাই দিয়ে বর্তমানে কী চলছে ? ধর্মকে অপব্যাখ্যা দিয়ে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে। ধর্মকে আশ্রয় করে নোংরা রাজনীতি করা হচ্ছে। এক ধর্মের মানুষ অন্য ধর্মের মানুষকে নাস্তিক আখ্যা দিচ্ছে। অনেকে আবার ধর্মকে ব্যবহার করছে ব্যক্তি স্বার্থ সিদ্ধির জন্য। কাজেই যে ধর্ম ছিল শান্তির আঁধার, এখন সেই ধর্মের নামে অশান্তি ছড়ানো হচ্ছে। বিশ্ব সমাজ ব্যবস্থায় যখন এমন রূপ বিরাজমান তখন বার বার মনে পড়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের অমর সৃষ্টিসম্ভারের কথা। তার অসহস্র সৃষ্টিকর্মের মাধ্যমে প্রতিধ্বনিত হয়েছে মানবিকতা, সুন্দর এবং বিশ্বশান্তির জয়গান। তাই রবীন্দ্রনাথকে আজকের সমাজে বেশি প্রয়োজন।


তিনি মানব প্রেমের গান গেয়েছেন, আবৃত্তি করেছেন মনুষ্যত্বের কথা, রচনা করেছেন কল্যাণের পথ। জীবন থেকে মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ পর্যন্ত প্রত্যেকটি মুহূর্ত প্রাণ দিয়ে তিনি অনুভব করেছেন এবং শিখিয়েছেন কীভাবে জীবনকে উপভোগ করতে হয়। তার অমর গান আমাদের প্রাণ ছুয়ে যায়, ডাক দিয়ে যায় প্রকৃতির এবং জাড়া জাগায় শুভকর পথে। অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী, বাংলা সাহিত্যের অন্যতম দিকপাল বিশ্ব কবি, বাংলা ছোট গল্পের জনক কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবনকে উপভোগ করেছেন এবং করাতে শিখিয়েছেন।


কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনাদর্শন, মানবতাবাদ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা সমাজে প্রতিষ্ঠা এবং রবীন্দ্র চর্চাকে সর্বস্তরে ছড়িয়ে দেয়া আজ সময়ের দাবি। তার অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও মানবতাবাদী জীবন দর্শন থেকে শিক্ষা নিতে হবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জমিদার হয়েও এদেশের সাধারণ মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছিলেন। জমিদার হয়েও তার ছিল না কোনো অহংকারবোধ। বর্তমান সমাজে বড় সমস্যা হিসেবে দাঁড়িয়েছে সাম্প্রদায়িকতা। সমাজের প্রত্যেক স্তরে বিরাজমান এই অপ্রত্যাশিত প্রশ্নের মুখে মানবিকতা বিপন্ন। বিষয়টি এমনভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে, ভাবা হচ্ছে মানুষ নয়, ধর্মই বড় কথা। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ অসাম্প্রদায়িকতার এক জলন্ত উদাহরণ। তার লেখায় উঠে এসেছে মনুষ্যত্বের কথা। সবার উপর মানুষ এটিই বড় কথা।


মানুষ হিসেবে জন্ম গ্রহণ করে প্রশ্ন জাগে আমি কেমনভাবে বাঁচবো? যদিও ছোটকালে এমন প্রশ্ন জাগে না কিন্তু বড় হয়ে এমন প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই জাগে। এক্ষেত্রে সবার সাথে বাঁচতে এবং প্রেমের সাথে বাঁচতে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিকর্ম আমাদের প্রতিনিয়ত তাড়া করে। তিনি এই শিক্ষাই দেন, জাতি ধর্ম, বর্ণ, নারীপুরুষ, জাত, ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে মানবিতকার সাথে বাঁচতে। নির্দিষ্ট কোনো গন্ডি  পেড়িয়ে মানুষের সাথে মিলিত হয়ে থাকার মাঝেই প্রকৃত মুক্তির সন্ধার পাওয়া যায় এবং জীবন ও বেঁচে থাকার স্বার্থকতা অনুধাবন করা যায়। মানুষের জীবনের বাইরের প্রাকৃতিক জগতও যে আমাদের ভালোবাসা পেতে চায় তাও দেখিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ।


জীবনের রসবোধ আস্বাদন করতে রবীন্দ্রনাথের শিক্ষার বিকল্প হয় না। আকাশভরা সূর্য তারা সাথে যুক্ত হয়ে উদার মনমানসিকতার দ্বার উন্মোচন করেছেন রবীন্দ্রনাথ। শিল্প, স্মৃতি এবং কল্পনার জগতেও বিচরণ করতে শিক্ষা দিয়েছেন তিনি। মানুষের ভালোবাসার সাথে যুক্ত থেকে আরো প্রসারিত হতে রবীন্দ্রনাথ আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করেন। মানুষের নতুন নতুন পরিচয় অন্বেষ করেছেন তিনি। আর আমরা তার দেওয়া নামে পরিচিত হতে পারলে মানবতার মুক্তি মিলবে। সমাজ বিকশিত হবে। তার সৃষ্টি কর্মের প্রসারতা আমাদের চিন্তার নতুন নতুন দ্বার খুলে দেয়। আমরা যদি এই রবীন্দ্রনাথকে না পেতাম তাহলে কেমন হতো আমাদের চিন্তার জগত- তা আজ ভাবার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা মৃত্যুকে কিভাবে গ্রহণ করবো সে শিক্ষা রবীন্দ্রনাথ আমাদেরকে দেন। তিনি বাঁচার এবং মৃত্যুর কথা বলে মানুষের পুরো জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করার জ্ঞান দিয়েছেন।


পন্ডিতরা বলেন, পৃথিবীতে ধর্ম এবং বিজ্ঞানের মধ্যে তেমন কোন দ্বন্দ্ব নেই। বিভিন্ন ক্রান্তিকাল সময়ে মানুষ সবসময় ধর্মের মুখোমুখি হয়েছেন। আর তাই ধর্মের সঠিক পথ দেখাতে যুগে যুগে পৃথিবীতে অবতারগণ এসেছেন। তাদের দেখানো পথে শান্তি প্রতিষ্ঠায় হিন্দু-মুসলিম সকলে মিলে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন প্রয়োজন। কেননা মানবসেবাই পরমধর্ম। এ পূজায় ত্যাগ ও কল্যাণের মানসিকতা তৈরি হয়। এ কারণেই বিজ্ঞ পন্ডিতরা বলেছেন, ত্যাগ ও সেবার আদর্শই ধর্ম। যে কোনো ধর্মাচরণই হচ্ছে অন্তরের বিষয়। ধর্মাবলম্বনকারীরা বিশ্বাস করেন, ধর্মের উপাস্য ঈশ্বরই বাস করেন মানুষের অন্তরে। তাইতো কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মানুষের অন্তরের এ অন্তঃস্থলটিকেই প্রকৃত দেবালয় হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। রবি ঠাকুরের প্রকৃত দেবালয়টিকে যদি আমরা চিহ্নিত করতে পারি, যদি অনুধাবন করতে পারি যে, ধর্ম আসলে উৎসাহ, উন্মাদনার বহিঃপ্রকাশ নয়, ধর্মের গুরুত্ব নিহিত রয়েছে নিভৃতে ধর্মাচরণের ভেতর, চিন্তা- চেতনায়, মন-মননে। মানবপ্রেমেই ধর্মের প্রকৃত প্রকাশ বুঝতে পারি, তবে অবশ্যই উদার ও মহানুভব চিন্তায় বিশ্বাসী হয়ে সব ধর্ম এবং বর্ণের মানুষকে সমভাবে শ্রদ্ধা-ভক্তির সাথে সম্মান করতে হবে।

তার ছোট গল্পে প্রকৃতি ও মানব জীবনের যে বৈচিত্র্য তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন তার তুলনা হয় না। মানব মনের ভাবনা ও নিসর্গ চেতনা আপন ভুবনে তুলির আঁচড়ে অঙ্কন করেছেন। তার গল্প ধারার একটা বড় অংশই মানুষ ও প্রকৃতির অন্তরঙ্গ মেলবন্ধন। তেমনি তার ছোট গল্পে উঠে এসেছে পল্লীবাংলার সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, প্রেম-বিরহ, বেদনার প্রতিচ্ছবি। তার তীক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ ও জীবন ঘনিষ্ঠ ভাবনায় নানান ভাবে, নানান রূপে প্রকাশ পেয়েছে মানব জীবনের বৈচিত্যময় অনুভুতি। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন অনন্ত জীবন, চিরজীবী মানবাত্মা ও প্রকৃতির চিরন্তন সৌন্দর্যের কবি। মৃত্যুকে তিনি দেখেছেন মহাজীবনের যতি হিসেবে। জীবন-মৃত্যু ও জগৎ-সংসার তাঁর নিকট প্রতিভাত হয় এক অখন্ড রূপে। কাজেই রবীন্দ্রনাথের জ্ঞানে আজকের সমাজব্যবস্থা পরিচালিত হলেই মিলবে শান্তি এবং মুক্তি মিলবে মানবের।


লেখকঃ- প্রভাষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

// Disable right-click context menu // Disable text selection // Disable dragging of images and text // Disable copy events // Disable common keyboard shortcuts for copying // Check for Ctrl/Command key combinations with C, X, S, or P