Monday, 10 March 2025, 05:34 PM

সংগ্রাম ও সংস্কৃতির স্মারক ফেব্রুয়ারী মাস

…………মোঃ আবদুল মান্নান

 

শুরু হ’ল ভাষার মাস ফেব্রুয়ারী। সংগ্রাম ও সংস্কৃতি স্মারক হয়ে থাকা ফেব্রুয়ারী মাস, বাংলা ভাষাভাষি মানুষের জন্য স্বাতন্ত্রে সমুজ্জ্বল। স্বাধীকার আন্দোলনের বীজ রোপিত হয়েছিল এ ফেব্রুয়ারী মাসেই। নদীমাতৃক আমাদের এ দেশ, ভারতীয় উপমহাদেশের তিন প্রধান প্রবাহ গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদীর ভাটি অববাহিকা। এ উপমহাদেশের আদি ভাষা ‘মাগধি প্রাকৃত’ থেকে উদ্ভূত বাংলা ভাষার বিকাশ ঘটেছিল এ তিন নদীর মিলনস্থল বঙ্গীয় বন্দ্বীপে। আর বর্তমানে এ ভাষা ক্রমে তার বিকাশ ঘটিয়ে উপমাহদেশ ছাড়াও বিশ্বের নানা প্রান্তে বিস্তার ঘটাচ্ছে।৮ম শতকের সেই বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্য্য, যারা মাতৃভাষার পরিচয়ের ক্ষেত্রে অজ্ঞাতই রয়ে গেছে, তাঁরা সে সময় বুঝেছিল এ দেশের মানুষের কাছে বৌদ্ধধর্মের বাণী পৌঁছাতে হলে বাংলা ভাষাতেই ধর্মের বাণী সকলের কাছে বলতে হবে। কিন্তু বাংলা ভাষার লিখিত রূপ তখন পর্যন্ত তৈরী হয় নি। তাই, তাঁরা মমতায় জন্ম দিলেন বাংলা সাহিত্যের ভ্রুণ “শিশু চর্য্যাপদের।”

ধর্ম প্রচারের কৌশল একই রকমের ছিল ‘ডাচ মিশনারী’ দেরও। ১৯ শতকে খ্রীষ্টান মিশনারীগণ ধর্ম প্রচারের ক্ষেত্রে মাতৃভাষার প্রয়োজন বৌদ্ধ ধর্মের প্রচারকদের মত একই রকমভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। তাঁরা বুঝেছিলেন বাংলা ভাষা ভাষী এসব অশিক্ষিত, অর্দ্ধ শিক্ষিত মানুষের সামনে ইংরেজি ভাষায় ‘যিশুর’ বাণী প্রচারে সফলতা আসবে না। তাই, বাংলা ভাষাতে যিশুর বাণী প্রচার এবং তা-বাস্তবায়ন করতে গিয়ে তখন বাংলা গদ্যের যাত্রা শুরু করে “ডাচ মিশনারীগণ।” মধ্যযুগ ছিল বাংলাভাষার পান্ডুলিপি লেখার যুগ। আর যিশুর বাণী শত সহস্র মানুষের কাছে পৌছাতে পান্ডুলিপির ধারণা থেকে বেড়িয়ে এসে, সুদুর ইউরোপ থেকে ছাপাখানা এ দেশে এনে ‘সিরামপুর মিশনে’ স্থাপন করেছিল ডাচ মিশনারীরা। এ ছাপাখানায় প্রথম প্রকাশ হয় “ সমাচর দর্পন।”এ ভাবেই বাংলায় ‘গদ্য সাহিত্য’ চর্চার ভুবন তৈরী হয়েছিল সে সময়। পাল যুগে ৮ম থেকে ১০ম শতকে চর্য্যাপদ চর্চা এবং ১৯ শতকে বাংলা গদ্যের বিকাশের মধ্যখানে সামায়িক ছন্দপতন ঘটেছিল ১১-১২ শতকে সেনরাজাদের শাসনামলে।

তখন সেন শাসক গোষ্ঠীর রাষ্ট্র পরিচালনাকারী কর্তা ব্যক্তিদের বৈরী আচরণের কারণে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চা প্রথম পর্যায়েই থমকে গিয়েছিল। সেন শাসকরা পাল রাজ্যে চাকুরী করতে এস বঙ্গীয় শাসকদের দূর্বলতার সুযোগ গ্রহণ করে রাজ্য ক্ষমতা দখল নেয়। আর তারা নিজেদের শাসন নিষ্কন্টক করতে প্রথমে বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের নিপীড়ন শুরু করে। সেনদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে অনেক বৌদ্ধ তখন দেশ ত্যাগ করে এবং অনেকে হিন্দুধর্ম গ্রহণ করে তাদের সাথে একাত্বতা ঘোষণা করে। সেনরা মানসিক ঔদার্য্যের সাধারণ হিন্দু এবং অন্তাজ শ্রেণীকে কাছে টেনে নিতে পারে নি, বরং একটি মনোস্তাত্বিক ভীতি তাদেরকে তাড়িয়ে বেড়াত সে সময়ে। অবৈধ শাসনের বিরুদ্ধে গণরোষের ভয়ও ছিল সেনদের মাঝে। তাই, সংস্কৃতি বোধহীন করে রাখতে চেয়েছিল তারা তখন বাঙ্গালিকে। তারা বুঝেছিল ভাষা চর্র্চার মাঝ থেকে প্রাণ পাবে বাংলা সাহিত্য। আর এ ভাষা চর্চা, ধর্ম ও সাহিত্যচর্চা, সাধারণ মানুষকে সচেতন করে তুলবে এবং ধর্মের দোহাই দিয়ে তখন শাসন আর শোষণ করার সুযোগ হারাবে শাসক সেনরা।

সেন শাসকদের বৈরী আচরণে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিকাশে তখন ক্ষতি হয়েছে ঠিকই কিন্তু ১৪ শতকে বাহির থেকে আসা ভারতীয় অবাঙ্গালী শাসকরা পরবর্তীতে সে সংকট ঘুচিয়ে বাংলা সাহিত্যের বিকাশকে শুধু সমর্থনই দিল না বরং তারা পৃষ্ঠপোষকতায় ভরিয়ে দিল। মঙ্গলকাব্যও পরবর্তীতে বৈষ্ণব সাহিত্য এবং চেতনা চরিত কাব্যের মধ্য দিয়ে হিন্দু কবিরা বাংলা ভাষাকে বিশেষ মর্যাদার জায়গায় পৌছে দিয়েছিল।  মুসলমান কবিরাও পিছিয়ে থাকলো না এ সময়। তাঁরাও রোমান্টিক কাব্য, বীরগাঁথা ও জীবনী সাহিত্য রচনা করে বাংলা সাহিত্যকে বিশেষ অবস্থান দাঁড় করালেন। এরপর মুঘোল যুগে যুক্ত হল মার্সিয়া সাহিত্য ও বাউল সঙ্গীত। এ ভাবে বাংলা ভাষা শক্ত ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে এখন দিগন্ত বিস্তার করছে। আর এ জন্য বাংলা ভাষার উত্তরাধিকারী ভাষা নিয়ে গর্ব বা অহংকার বোধ করবেই। কখনও কেউ হঠাৎ এসে ভাষা মূলে আঘাত করলে এ বাঙ্গালী জাতি তা-মানবে কেন?

ভাষার ক্ষেত্রে মানসিকভাবে পাকিস্তানী শাসকদের সাথে সেন বংশীয় শাসকদের ঘনিষ্ঠ মিল খুঁজে পাওয়া যায় । সেন বংশীয় শাসক এবং পাকিস্তানী শাসকদের মনে ছিল একই ধরনের ঔপনিবেসিকতা। ধর্মভিত্তিক এ শাসকদের মনে সব সময়ই কাজ করত বাঙ্গালি জাতিকে শোষণ করার মানসিকতা। ভাষা ও সংস্কৃতি বোধে উজ্জ্বল বাঙ্গালী জাতির প্রতি সব সময় তাদের মনে ভীতি কাজ করত। সেন ও পাকিস্তানি শাসকরা মনে করত, ভাষা চর্চা থেকে বাঙ্গালী জাতিকে বিচ্ছিন্ন করতে পারলেই তারা দেশ প্রেমে শক্তি হারাবে এবং সংস্কৃতি বোধহীন এ জাতিকে তখন নতজানু করা কঠিন হবে না।

পাকিস্তান জন্মের প্রারম্ভিক অবস্থা থেকে তাই ভাষা প্রশ্নে পাকিস্তানী শাসকরা বিতর্কের সৃষ্টি করে ফেলে এবং বাংলা ভাষা ও সাহিত্য চর্চার দীর্ঘ ঐতিহ্যের শক্তিকে বিবেচনায় এনে তারা কেঁড়ে নিতে প্রচেষ্টা চালাতে থাকে বাঙ্গালীর মুখের ভাষা তথা মায়ের ভাষা বাংলাকে। আর বাঙ্গালী জাতি তাই স্বাভাবিক ভাবেই রক্তমূল্যে তাঁদের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিলেন  ১৯৫২সালে ভাষার মাস ফেব্রুয়ারীতে। ১৯৪৮ ও ১৯৫২ সালে ভাষার ক্ষেত্রে বাঙ্গালী জাতি তাঁর পূর্ব ঐতিহ্য ধরে রাখতে  সক্ষম হয়েছিলেন দেশাত্ববোধে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে। তার জ্বলন্ত প্রমাণ রাখলেন ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে। তাই জাতীয়তাবোধ তৈরিতে বাঙ্গালী জাতির  ভাষা আন্দোলন ছিল একটি প্রেরণার শক্তি। কোন বাঙ্গালী তাই ভাষা আন্দোলনের এ মহান মাসটির কথা কখনই ভূলতে পারেন না। ভাষার জন্য আত্মদানকারী শহীদদের বলছি, তোমাদের রক্ত বৃথা যায়নি। বাঙ্গালী জাতি যতদিন থাকবে, তোমরা ততদিন বেঁচে থাকবে তাঁদের অন্তরে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিষ্ট

// Disable right-click context menu // Disable text selection // Disable dragging of images and text // Disable copy events // Disable common keyboard shortcuts for copying // Check for Ctrl/Command key combinations with C, X, S, or P