মো. মিঠুন মিয়া
যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বর্তমানে আমরা তথ্যনির্ভর সমাজ ব্যবস্থার দিকে অগ্রসর হচ্ছি। যেখানে তথ্যের গুরুত্ব এবং তাৎপর্য অপরিসীম। বলা হচ্ছে তথ্যই ক্ষমতার উৎস এবং ধনী-গরিবের মান নির্ধারক। সুশাসন এবং সকল বিষয়ে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার অন্যতম পন্থা হলো অবাধ তথ্য প্রবাহ। সঠিক তথ্যই সরকার এবং জনগণের মধ্যে সেতুবন্ধন রচনা করে। যা একটি কল্যাণকর রাষ্ট্রের অপরিহার্য অংশ। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ এবং বহিঃবিশ্বের যাবতীয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে তথ্য।
তথ্য কী ? ‘তথ্য অধিকার আইন ২০০৯ মোতাবেক “তথ্য” অর্থে কোন কর্তৃপক্ষের গঠন, কাঠামো ও দাপ্তরিক কর্মকান্ড সংক্রান্ত যে কোন স্মারক, বই, নকশা, মানচিত্র, চুক্তি, তথ্য-উপাত্ত, লগ বহি, আদেশ, বিজ্ঞপ্তি, দলিল, নমুনা, পত্র, প্রতিবেদন, হিসাব বিবরণী, প্রকল্প প্রস্তাব, আলোকচিত্র, অডিও, ভিডিও, অংকিতচিত্র, ফিল্ম, ইলেকট্রনিক প্রক্রিয়ায় প্রস্তুতকৃত যে কোন ইনস্ট্রুমেন্ট, যান্ত্রিকভাবে পাঠযোগ্য দলিলাদি এবং ভৌতিক গঠন ও বৈশিষ্ট্য নির্বিশেষে অন্য যে কোন তথ্যবহ বস্তু বা সেটির প্রতিলিপিও তথ্যে অন্তর্ভুক্ত হবে, তবে শর্ত থাকে, দাপ্তরিক নোট সিট বা নোট সিটের প্রতিলিপি এর অন্তর্ভুক্ত হইবে না;’ তথ্য হলো তাই যা আমাদের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা এবং অনুধাবনের সাথে জড়িত।
তবে তথ্যের প্রয়োজনীয়তা সব সময়ই ছিল। প্রাচীনকালে শাসকগোষ্ঠীরা রাজ্য পরিচালনার কাজে তথ্যের উপকারিতা অনুভব করেছিলেন। সম্রাট অশোক পাথর এবং স্তম্বে খোদিত তার আদেশ সাম্রাজ্যের সর্বত্র এবং বাইরেও প্রজ্ঞাপন করেন। তিনি তথ্য সংগ্রহের জন্য দেশে এবং বিদেশে গুপ্তচর নিয়োগ করেন। সুলতানি আমলে ‘বারিদ ই-মামালিক’ বা গোয়েন্দা প্রধান কর্তৃপক্ষের সাম্রাজ্যের তথ্য সরবরাহ করার দায়িত্ব পালন করতেন। সুলতান আলাউদ্দিন খলজির মুনহি বা গুপ্তচররা সুলতানকে অতি তুচ্ছ বিষয়সমূহও অবহিত করত।
একুশ শতাব্দিতে এসে তথ্যের গুরুত্ব বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন এর সাথে যুক্ত হয়েছে প্রযুক্তি। ফলে তথ্য-প্রযুক্তির এই যোগসাজোস আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রাকে করেছে আরামপদ, সহজতর এবং হয়রানিমুক্ত। প্রযুক্তির সুবাদে আমরা তথ্যের মহাসাগরে ডুবে আছি। বিন্দুমাত্র সময় তথ্য থেকে দূরে থাকার কোনো সুযোগ নেই। হাতের নাগালে তথ্য প্রাপ্তির এই পথ দেখিয়েছে প্রযুক্তির নতুন নুতন আবিষ্কার। সকালে ঘুম থেকে উঠে রাতে ফের ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তথ্যের আলোকে প্রতিদিনের কার্যাবলী সম্পাদন করতে হয়। তথ্যের আলোকে বেড়ে উঠছে আমাদের নতুন প্রজন্ম। তথ্যের এই সহজ প্রাপ্তিতে বর্তমানে আমাদের তরুণ সমাজ সবচেয়ে বেশি উপকৃত হচ্ছে। সামাজিক মিডিয়ার মাধ্যমে তারা বিনোদনের সাথে তথ্যসমৃদ্ধ হয়ে উঠছে। তাদের সময় এখন নিরবে কাটছে তথ্যের আবরণে।
তথ্য এখন বাতাসে ভেসে বেড়ায়। পথঘাটে, যানজটে, আলাপ আলোচনাকালে মুঠোফোনসহ নানা ইলেকট্রনিক ডিভাইসের মাধ্যমে আমরা যুক্ত হতে পারছি বিশাল তথ্যভান্ডারে । তথ্য পেতে সেই পুরানো দিনের ভোগান্তি আর পোহাতে হয় না। পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকে যেকোনো মুহূর্তে সব বিষয়ে তথ্য প্রাপ্তির এই সুবিধা আমাদের জীবনযাত্রার মান শত গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। বর্তমানে আমরা একটি জ্ঞাননির্ভর সমাজ ব্যবস্থায় বসবাস করছি। জ্ঞানের মূল উৎসই হলো তথ্য। আমাদের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা এবং অনুধাবনের সাথে ওতপোতভাবে জড়িত তথ্য। তথ্যই মানুষের জ্ঞানকে শাণিত করে। সঠিক তথ্য জ্ঞান রাজ্যে সংযোজন এবং বিয়োজন ঘটিয়ে মানুষকে সুপথে পরিচালিত করে। পক্ষান্তরে ভ্রান্ত তথ্য সমাজকে বিপথগামী করে।
বর্তমান সরকার তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিতকরণের পাশাপাশি জনগণের তথ্য জানার অধিকারকে অগ্রাধিকার দিয়েই ‘তথ্য অধিকার আইন ২০০৯’ প্রণয়ন করেছে। বাংলাদেশের সংবিধানে চিন্তা, বিবেক ও বাক-স্বাধীনতা নাগরিকগণের অন্যতম মৌলিক অধিকার হিসাবে স্বীকৃত এবং তথ্য প্রাপ্তির অধিকার চিন্তা, বিবেক ও বাক-স্বাধীনতার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। জনগণ প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক ও জনগণের ক্ষমতায়নের জন্য তথ্য অধিকার নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক। জনগণের তথ্য অধিকার নিশ্চিত করা হলে সরকারী, স্বায়ত্তশাসিত ও সংবিধিবদ্ধ সংস্থা এবং সরকারী ও বিদেশী অর্থায়নে সৃষ্ট বা পরিচালিত বেসরকারী সংস্থার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি পাবে, দুর্নীতি হ্রাস পাবে ও সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। সরকারী, স্বায়ত্তশাসিত ও সংবিধিবদ্ধ সংস্থা এবং সরকারী ও বিদেশী অর্থায়নে সৃষ্ট বা পরিচালিত বেসরকারী সংস্থার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে বিধান করা সমীচীন ও প্রয়োজনীয়।
এই তথ্য অধিকার আইনের আলোকে যেকোনো প্রতিষ্ঠান তথ্য প্রদানে বাধ্য। তা নিশ্চিত করার জন্য গঠন করা হয়েছে তথ্য কমিশন। আর দেশের জনগণ যাতে তথ্যসমৃদ্ধ হয়ে এ সকল প্রতিষ্ঠানের ওপর নজর রাখতে পারে এবং এ সকল প্রতিষ্ঠান যেন তাঁদের নিকট দায়বদ্ধ থাকে, তার ব্যবস্থা গ্রহণ করা। তথ্য অধিকার আইনটির সুষ্ঠু প্রয়োগের মাধ্যমে জনগণ এ অধিকার পাবেন বলে তথ্য কমিশন দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে। এর ফলে জনগণ যেমন তথ্য অধিকার সম্পর্কে সচেতন হচ্ছে পাশাপাশি তারা কি করে এর প্রয়োগ ঘটাবে সে সম্পর্কেও জানতে সক্ষম হচ্ছে।
তথ্যের অবাধ প্রবাহ নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি সমাজ ও রাষ্ট্রে জনগণের ক্ষমতায়নকেও প্রতিষ্ঠিত করে। রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমে স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা নিশ্চিতের মাধ্যমে সমাজে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় তথ্য অধিকার আইনের বিকল্প নেই। বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রধান অন্তরায় দুর্নীতি। আমরা সবাই দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ চাই। রাষ্ট্রের শাসকশ্রেণি থেকে বিভিন্ন ব্যক্তি দুর্নীতির সাথে যুক্ত। আমাদের সমস্ত অর্জনকে কলুষিত করছে এই সমস্যাটি। বিশ্বের কাছেও আমরা হেয়প্রতিপন্ন হচ্ছি। কিন্তু দুর্নীতিমুক্ত সমাজ বিনির্মাণে তথ্যই হচ্ছে প্রধান অস্ত্র। বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, তথ্যের অবাধ সরবরাহের সঙ্গে দুর্নীতি হ্রাসের সম্পর্ক রয়েছে। দুর্নীতির ধারণা সূচকের ভিত্তিতে দেখা যায়, যেসব দেশ (বিশেষ করে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোর মধ্যে ফিনল্যান্ড) তথ্য অধিকার আইন গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছে, তারাই সর্বনিন্ম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় স্থান পেয়েছে। তথ্য অধিকার আইন নাগরিকের ক্ষমতায়নের সঙ্গে জড়িত। নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র এবং এর অঙ্গসংগঠন, রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব, প্রশাসন ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীলতা নিশ্চিত করে তথ্য অধিকার।
রাষ্ট্রের প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানের সার্বিক কর্মকান্ড সম্পর্কে জনগণ যদি সঠিক তথ্য জানতে পারে, তাহলে অনেক ক্ষেত্রে সুফল লাভ করা সম্ভব। সরকারের সকল সেক্টরের স্বচ্ছতাও নির্ভর করে অবাধ তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিত করার উপর। প্রকৃত তথ্য গোপন করে অনেকে দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে বাড়তি সুযোগ-সুবিধা নিয়ে থাকে। এমন প্রবণতা কেবল কমাতে পারে তথ্য অধিকার আইনের যথাযথ প্রয়োগে। অনুরূপভাবে সরকার প্রত্যেক ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের নিকট থেকে তাদের কর্মকান্ডের তথ্য নিয়ে দুর্নীতিরোধ করতে পারে।
বর্তমান সরকারের আমলে তৃণমূল পর্যায়ে তথ্যসেবা গ্রামীণ জনপদের চিত্র আমূল বদলে দিয়েছে। পোস্ট অফিস বা ব্যাংকে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে বিদ্যুৎ বিল পরিশোধের ঝামেলা নেই। মাঠের কৃষকের কৃষি পরামর্শ নিতে ছুটতে হয় না স্থানীয় কৃষি অফিসে। নিজের স্বাস্থ্য সেবার প্রাথমিক কাজটুকু তারা সেরে নিতে পারছেন হাতের নাগালের তথ্যসেবা কেন্দ্র থেকে। শুধু এগুলোই নয়, প্রায় ৬০ ধরনের সরকারি ও বেসরকারি সেবা গ্রহণ করছেন তারা। গ্রামীণ মানুষের জীবনযাত্রার আমূল পরিবর্তন এনে দিয়েছে ইউনিয়ন তথ্যসেবা কেন্দ্র (ইউআইএসসি)। এখন ঘরে বসেই তারা জানতে পারছে কৃষি সংক্রান্ত তথ্য, স্বাস্থ্যসেবাসহ মাঠ পর্চার মতো জটিল বিষয়ের সহজ সমাধানও। এই তথ্যসেবা কেন্দ্র থেকে বিভিন্ন রকম সনদ প্রদান, ই-মেইল, ইন্টারনেট, ছবি তোলা, অনলাইনে বিভিন্ন সরকারি ফরম পূরণ, জমির খতিয়ানের আবেদন ও সরবরাহ, মোবাইল ব্যাংকিং, জীবন বীমা, বিদ্যুৎ বিল গ্রহণ, বিমানের টিকিট করা, পরীক্ষার ফলাফল জানা প্রভৃতি কাজ করা হচ্ছে।
স্কাইপিতে ভিডিও কলের মাধ্যমে প্রবাসী ছেলের সঙ্গে কথা বলতে পারছেন তার বৃদ্ধা মা। কম্পিউটারের মনিটরে সরাসরি দেখে নেন সাত সমুদ্র তের নদী ওপারে থাকা তার বুকের মানিককে। গ্রামীণ মানুষের জীবনকে প্রযুক্তির সঙ্গে একাকার করে দিয়েছে ইউনিয়ন তথ্যসেবা কেন্দ্র। হাতের কাছেই এমন অনেক কিছুই পাচ্ছেন, যা আগে ছিল না। সামান্য একটু কাজের জন্য যেখানে উপজেলা এবং জেলায় যেতে হতো, এখন ইউনিয়ন পরিষদ তথ্যসেবা তা মিটিয়ে দিচ্ছে। এতে সময় এবং অর্থ বেচে যাচ্ছে। গ্রামীণ জনপদের মানুষের জীবন বদলে দিয়েছে ইউনিয়ন তথ্য সেবাকেন্দ্র।
জন্ম নিবন্ধন বা মৃত্যু সনদ, কম্পিউটার কম্পোজ, ই-মেইল, ইন্টারনেট, অনলাইনে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি আবেদন পূরণ কিংবা চাকরির আবেদন, বিদেশ যাওয়ার জন্য নিবন্ধন, বিদেশের ভিসা আবেদন এবং ভিসা যাচাই, ছবি তোলা, কম্পিউটার প্রশিক্ষণ সব করা যাচ্ছে ইউনিয়ন তথ্যসেবা কেন্দ্রে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে দেশের প্রতিটি ইউনিয়নে তথ্যসেবা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ২০১০ সালের ১১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ও ইউএনডিপির প্রশাসক হেলেন ক্লার্ক যৌথভাবে দেশব্যাপী ৪ হাজার ৫০১টি ইউনিয়নে তথ্য সেবাকেন্দ্রের উদ্বোধন করেন। গ্রামে এখন দেখা যায় অন্যরকম এক দৃশ্য। সাইকেল চালিয়ে তরুণীরা যাচ্ছেন মানুষের বাড়ি বাড়ি, তাঁর সাথে ল্যাপটপ কম্পিউটার বা নোটবুক ইন্টারনেট ব্যবহার করে তথ্য ও স্বাস্থ্যসেবা দেয়া হচ্ছে, কখনো গ্রামের মেয়েদের বা ছোট ছোট স্কুলের ছেলেমেয়েদের শেখাচ্ছেন কিভাবে ব্যবহার করতে হয় কম্পিউটার। এদের নাম দেয়া হয়েছে ‘ইনফো-লেডি‘ বা ‘তথ্য-কল্যাণী’। তথ্যপ্রযুক্তি-ভিত্তিক সেবাকে তারা নিয়ে যাচ্ছেন সরাসরি গ্রামীণ জনগণের দোরগোড়ায়।
বাংলাদেশ সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য ও ওয়েবসাইটের সমন্বয়ে তৈরি ওয়েবপোর্টাল ‘বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন’-এর উদ্বোধন করা হয়েছে। নাগরিকদের তথ্য ও সেবাপ্রাপ্তি নিশ্চিত, সরকারের কাজের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা তৈরির লক্ষ্যে এই ওয়েবপোর্টাল তৈরি করা হয়েছে বলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক প্রকল্প ‘একসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই)’ জানিয়েছে। পাশাপাশি এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে উদ্ভাবনী ও জনমুখী প্রশাসন প্রতিষ্ঠার প্রয়াস অব্যাহত থাকবে বলেও জানানো হয়েছে। ২৫ হাজার ৪৩টি ওয়েবসাইটকে একই প্লাটফর্মে নিয়ে এসে বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন (www.bangladesh.gov.bd) তৈরি করা হয়েছে। নিঃসন্দেহে এই উদ্যোগ প্রশংসনীয়। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার যে রূপকল্প তাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সক্ষমতা এই উদ্যোগের রয়েছে।
জাতীয় তথ্য বাতায়নের ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখা গেছে, এতে কয়েকটি বিষয় গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরা হয়েছে। মূল মেন্যুগুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ সম্পর্কিত, সেবা খাত, ব্যবসা-বাণিজ্য, আইনবিধি, অর্জন, জেলা বাতায়ন, ই-ডিরেক্টরি। প্রথম পৃষ্ঠাতেই ই-সেবাগুলোর লিংক রয়েছে। প্রথম পাতাতে আরও যেসব বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে সেগুলো হলো পর্যটন, পরিসেবা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, ব্যবসা-বাণিজ্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও মানবসম্পদ, কৃষি, উন্নয়ন অভিযাত্রা। এসব বিষয়ে তথ্যের লিংক প্রথম পৃষ্ঠাতেই রয়েছে। জাতীয় তথ্য বাতায়নের সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছে ৬১টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ, ৩৪৫টি অধিদফতর, ৭টি বিভাগ, ৬৪টি জেলা, ৪৮৮টি উপজেলা, ৪৫৫০টি ইউনিয়নের তথ্য। এ ছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তথ্য, সরকারি ফর্ম, সিটিজেন চার্টার, সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের তালিকা সম্পর্কিত তথ্যের পাশাপাশি ২০ লাখের বেশি কনটেন্ট রয়েছে তথ্য বাতায়নে। সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করলে এগুলো নাগরিকদের নানাবিধ কাজে লাগবে।
গণমাধ্যমের প্রকৃত স্বাধীনতার মাধ্যমেই জনগণের তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত। দেশে গণমাধ্যমের বিকাশ ও অগ্রযাত্রায় বর্তমান সরকার সব সময়ই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। তথ্যের অবাধ প্রবাহকে আরো বিস্তৃত করতে সরকার বাংলাদেশ টেলিভিশন, বিটিভি ওয়ার্ল্ড এবং সংসদ টেলিভিশনের পাশাপাশি ৪১টি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল সম্প্রচারের অনুমতি দিয়েছে। এর ফলে তথ্য প্রকাশ ও প্রচারের ব্যবস্থা সহজতর হয়েছে। এ ছাড়া বেসরকারি মালিকানায় ২৮টি এফএম বেতার কেন্দ্র এবং ৩২টি কমিউনিটি রেডিও সম্প্রচারের অনুমতি দেয়া হয়েছে।
তথ্যের এই অবাধ প্রবাহ শহর এবং গ্রামের জীবনযাত্রার মধ্যে পার্থক্য কমিয়ে আনছে। সমাজের অধিকার বঞ্চিতরা উপকৃত হচ্ছে। নারীর ক্ষমতায়নে তথ্যের ভূমিকা তাৎপর্যপূর্ণ। নারীরা এখন ঘরে বসেই তথ্য পেতে পারছে। এতে তারা এখন অনেক কিছু জানে বোঝে এবং সে অনুসারে পদক্ষেপ গ্রহণ করে। কানাডিয়ান যোগাযোগবিদ মার্শাল ম্যাকলুহান বহু আগে আমাদের ‘বৈশ্বিক গ্রাম’ এর স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। তিনি আরো উল্লেখ করেছিলেন, আধুনিক প্রযুক্তিই হবে তাঁর সেই স্বপ্ন পূরণের প্রধান নিয়ামক। ম্যাকলুহানের সেই ভবিষ্যদ্বাণী আজ বাস্তবায়িত হয়েছে। বিজ্ঞানের কল্যাণে অত্যাধুনিক সব বাহনের সুবাদে পুরো বিশ্ব এখন মানুষের হাতের মুঠোয়। পৃথিবীর এক প্রান্তের তথ্য মুহুর্তের মধ্যে পোঁছে যাচ্ছে অপর প্রান্তে।
২০১৪ সালে গ্রামীণ এলাকায় তথ্য প্রযুক্তির প্রসারের জন্যে আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছে বাংলাদেশ। সাড়ে চার হাজারের মতো ইউনিয়নের লাখ লাখ মানুষের কাছে কম্পিউটার ও ইন্টারনেট সেবা পৌঁছে দেওয়ার জন্যে জাতিসংঘের একটি সংস্থা- ইন্টারন্যাশনাল টেলিকম ইউনিয়ন- আইটিইউ বাংলাদেশকে সরকারকে এই সম্মান দিয়েছে। জেনেভায় তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বিভিন্ন খাতে মোট দশটি দেশকে এই পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের হয়ে এই পুরস্কার গ্রহণ করেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ। তথ্যই হয়ে উঠুক আমাদের প্রধান সমাজ রাষ্ট্র ও দেশ পরিচালনার প্রধান শক্তি। বিশ্বের অন্যান্য উন্নত দেশের মতো বাংলাদেশের তথ্যসেবা ব্যবস্থা আরো এগিয়ে যাক। এ লক্ষ্যে সরকারের আরো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার এখনই সময়। তথ্যের আলোকে সুগম হোক আগামীর পথচলা।
লেখকঃ- প্রভাষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়