………………….মোঃ আব্দুল মান্নান                                                                           

শুরু হলো ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি। সংগ্রাম ও সংস্কৃতির স্মারক হয়ে থাকা ফেব্রুয়ারি মাস বাংলা ভাষাভাষি মানুষের জন্য স্বাতন্ত্রে সমুজ্জ্বল। স্বাধিকার আন্দোলনের বীজ রোপিত হয়েছিল এ ফেব্রুয়ারি মাসেই। নদীমাতৃক এ দেশ ভারতীয় উপমহাদেশের তিন প্রবাহ গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদীর ভাটি অববাহিকা। এ উপমহাদেশের আদি ভাষা ‘মাগধি’ যার প্রচলিত নাম প্রাকৃত। কোন পূর্বাঞ্চলীয় রুপ থেকে বাংলা ভাষা প্রত্যক্ষভাবে উদ্ভুত। তিন নদীর মিলনস্থল বঙ্গীয় বদ্বীপে, উদ্ভূত বাংলা ভাষার বিকাশ ঘটেছিল। বর্তমানে এ ভাষা ক্রমে তার বিকাশ ঘটিয়ে উপমহাদেশ ছাড়াও সারা পৃথিবীতে এর বিস্তার ঘটাচ্ছে।

বাংলা ভাষার নামের দেশ বাংলাদেশ। আমাদের ভাষার নাম বাংলা, ভাষার নামেই নামাঙ্কিত দেশ, বাংলাদেশ। আমাদের জাতিসত্তার স্বরুপ সন্ধানে ভাষা প্রত্মতার অন্যতম প্রধান সূত্র। বাংলা ভাষা আত্মপ্রতিষ্ঠা ও আত্মমর্যাদার লড়াইয়ে নজিরবিহীন ইতিহাসের স্রষ্টা। প্রাকৃতজনের ভাষা হিসেবে তাকে জন্মলগ্ন থেকেই সংগ্রামে লিপ্ত হতে হয়েছে, কালে কালে সে সৃষ্টি করেছে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। ভাষা সংগ্রামের সুফলতার মধ্যেই বাঙ্গালীর মাতৃভক্তি ও স্বকীয়তার বহিঃপ্রকাশ। এ দেশে আগত বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর ভাষার প্রভাব আজকের দিনের সুগঠিত বাংলা ভাষার গঠনে প্রকৃত অবদান রয়েছে বলে ভাষা পন্ডিতগণের ধারনা। ভাষা হচ্ছে সংস্কৃতির বাহন। জাতিরাষ্ট্র গঠনের অন্যতম প্রধান উপাদানও হচ্ছে ভাষা।

বাংলা ভাষা এখন নানা প্রকার বাঁধা অতিক্রম করে পৃথিবীর অন্যতম ভাষাশৈলীতে চিহ্নিত ও বাংলা ভাষা এখন পৃথিবীর ৮ম বৃহত্তম ভাষা। ৮ম শতকের বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্য, মাতৃভাষার পরিচয়ের ক্ষেত্রে যারা অজ্ঞাতই রয়ে গেছেন, তারাই সে সময় বুঝেছিলেন এ দেশের মানুষের কাছে ধর্মের বাণী পৌছাতে হলে বাংলা ভাষাতেই তা সকলের কাছে বলতে হবে। তবে সমস্যা ছিল তখন পর্যন্ত বাংলা ভাষার লিখিত রুপ তৈরী হয় নি। তাই তারা মমতায় জন্ম দিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের ভ্রূণ “শিশু চর্যাপদের”।

মধ্যযুগ ছিল বাংলা ভাষার পাণ্ডলিপি লেখার যুগ। মানুষের কাছে ধর্মের বাণী পৌছাতে পাণ্ডলিপির ধারণা থেকে বেড়িয়ে এসে সুদুর ইউরোপ থেকে ছাপাখানা এ দেশে এনে “সিরামপুর মিশনে” স্থাপন করেছিল ডাচ মিশনারীরা। পালযুগ ৮ম থেকে ১০ম শতকে চর্যাপদ চর্চা এবং ১৯ শতকে বাংলা গদ্যের বিকাশের মধ্যখানে সাময়িক ছন্দপতন ঘটেছিল ১১-১২ শতকে সেন রাজাদের শাসনামলে। সেন শাসকদের বৈরী আচরণের কারণে বাংলা ভাষা ও বাংলা সাহিত্য চর্চা প্রথম পর্যায়েই থমকে গিয়েছিল।সেন শাসকরা সংস্কৃতি বোধহীন করে রাখতে চেয়েছিল বাঙ্গালিকে। সেনরা মনে করত ভাষা চর্চার মাঝ থেকেই প্রাণ পাবে বাংলা সাহিত্য। আর এ ভাষা চর্চা, ধর্ম ও সাহিত্য চর্চা সাধারণ মানুষকে সচেতন করে তুলবে এবং ধর্মের দোহাই দিয়ে তখন শাসন আর শোষণ করতে সুযোগ হারাবে তারা। সেন শাসকদের বৈরী আচরণে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের যথেষ্ঠ ক্ষতি হয়েছিল। তবে বাহির থেকে আসা ভারতীয় অবাঙ্গালী শাসকরা পরবর্তিতে সে সংকট ঘুচিয়ে বাংলা সাহিত্যের বিকাশকে শুধু সমর্থনই দেয়নি বরং তারা পৃষ্ঠপোষকতায় ভরিয়ে দিয়েছিল। মঙ্গলকাব্য,  বৈষ্ণব সাহিত্য ও চেতনাচারিত কাব্যের মধ্য দিয়ে হিন্দু কবিরা বাংলা ভাষাকে বিশেষ মর্যাদার জায়গায় পৌছে দিয়েছিলেন। মুসলিম কবিরাও পিছিয়ে ছিলেন না; তারাও রোমান্টিক কাব্য, বীর গাঁথা ও জীবনী সাহিত্য রচনা করে বাংলা সাহিত্যকে বিশেষ অবস্থানে দাঁড় করিয়েছিলেন।

আমরা বাঙ্গালী যে ধ্বনিময় সংকেতের সাহায্যে মনের ভাব প্রকাশ করি তাহাই বাংলা ভাষা। যা আমাদের মাতৃভাষা।

বাংলা ভাষা সংগ্রামশীল। সে কারণেই এ ভাষা বিকাশমান। বাংলা ভাষা যে সংগ্রামশীল তার প্রমাণ কবি সৈয়দ সুলতান ও কবি আব্দুল হাকিম প্রমূখের বক্তব্যে। ১৬ ও ১৭ শতকে বাংলা ভাষা অবজ্ঞাকারী ও বিরোধিতাকারীদের বিরুদ্ধে তা যুক্তিগ্রাহ্যভাবে সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিলেন। এ ভাষা লড়াই করেছে সংস্কৃত-আরবি-ফারসি ও উর্দূর সাথে, বারু বাংলা, সাধু বাংলা ও প্রাদেশীক বাংলার সাথে। লড়াই করেছে ধর্মতন্ত্র, সামন্ত্রতন্ত্রের সাথে। তাই বাংলা ভাষা এখন আবেগের ভাষা, তন্ত্রের ভাষা, সুগভীর অনুভূতির-অনুভবের ভাষা এবং এখন তা জ্ঞানের ভাষা, বিজ্ঞানের ভাষা, প্রযুক্তির ভাষা। আজ এ ভাষায় বিজ্ঞান-দর্শন-অধিবিদ্যা-অংক বিদ্যাসহ যে কোন ভাষায় তাত্ত্বিক-প্রায়োগিক আলোচনা করা যায়। সূক্ষ্মতম অনুভূতি, গভীর ভাব হ্রদয়াবেগ প্রকাশিত হয় এ ভাষায়। বাংলা ভাষা পৃথিবীর ভাব-বৈচিত্র্য এবং চিন্তা-চেতনাকে আত্তীকরণ করে চিন্তা-চেতনায়, ব্যবসায়-মেধায় বাংলা ভাষা ও বাঙ্গালী জাতি আজ পৃথিবীর আর সবার সাথে সমভাবে-সমতালে চলছে ও এখনও আরো বেশি চলার প্রত্যাশা বাঙ্গালী জাতির।

বাঙ্গালী জনগণ, সাধারণ ভাষায় বলতে গেলে বাঙ্গালী জাতি হিসেবে এমন এক শ্রেনীর লোককে বুঝায় যাদের রক্তে নানা জাতির মিশ্রণ হতে পারে কিন্তু তারা ভাষায় এক; কারণ তারা সবাই বাংলা ভাষায় কথা বলে। এদের মধ্যে বামুন, কায়েত, বদ্যি আছে, রাজপূত, ছত্রী, বৈশ্য আছে, যারা নিজেদেরকে খাটি বা মিশ্র আর্য বলে মনে করে। আরও অনেকে আছে যাদের উৎপত্তি হয়েছে দ্রাবিড় বা কোল অর্থ্যাৎ নিষাদ থেকে, মোঙ্গল অর্থ্যাৎ কিরাত থেকে। ব্রাক্ষ্মণ, চন্ডাল, বাউরী-ছত্রী, চট্টগ্রামের চাকমা, উত্তর বাংলার রাজবংশী, পশ্চিম বাংলার মহিষা, হিন্দুস্থান থেকে আসা পশ্চিমা মুসলমান, কত বর্ণের বা সম্প্রদায়ের মানুষ, যাদের মূল বংশগত উৎপত্তি পৃথক, তারা এখন সকলেই বাঙ্গালী, বাংলাভাষি জাতির সামিল হয়ে গিয়েছে।

বাংলা ভাষা তার আত্মপ্রতিষ্ঠা ও আত্মমর্যাদার লড়াইয়ে এক অনন্য ইতিহাসের স্রষ্টা। মায়ের ভাষার কথা বলার অধিকার রক্ষার জন্য বাঙ্গালী জাতিকে রক্ত দিতে হয়েছে যার নজির ইতিহাসে বিরল। প্রায় দুই হাজার বছরের সংগ্রামের ইতিহাস ১৯৫২ এর ২১ শে ফেব্রুয়ারীতে রফিক, শফিক, জব্বার, সালাম, বরকতসহ অনেক ভাষাপ্রেমী যুবক বুকের তাঁজা রক্ত দিয়ে স্বার্থন্বেষীদের দূরভিসন্ধি নস্যাৎ করে দেয় এবং এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ এর পাকিস্তানী সামরিক জান্তার সঙ্গে ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলার পূর্বাংশে স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। বাঙ্গালীর ভাষাতাত্ত্বিক পরিচয়ের ক্ষেত্রে বাঙ্গালী জাতি বাংলা ভাষার আত্মসংগ্রামের ইতিহাসের প্রতি একবার দৃষ্টি ফেরাতে তাই ভাষা সংগ্রামের লড়াইয়ে সফলতার মধ্য দিয়েই বাঙ্গালীর দেশপ্রেম, মাতৃভক্তি ও স্বকীয়তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। তাই বলতে হয় যে কোন সংকট মূহুর্তে ভাষাই বাঙ্গালীর প্রেরণাদাত্রী। কোন বাঙ্গালী তাই ভাষা আন্দোলনের এ মহান মাসটিকে ভূলতে পারে না।  

 

লেখক ও সাংবাদিক

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে